হলুদ, লাল, নীল নয়, সু-সাংবাদিকতার জন্য দায়িত্ব নিতে হবে

হলুদ, লাল, নীল নয়, সু-সাংবাদিকতার জন্য দায়িত্ব নিতে হবে

সংবাদপত্র হচ্ছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আর সাংবাদিকরা হচ্ছে এই স্তম্ভের ভীত। এই ভীত যাতে নড়ে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সংবাদপত্রের ভীত মজবুত রাখতে হলে সংবাদকর্মীদের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে উদ্যোগ নিতে হবে। অনেকেই মনে করেন সংবাদপত্রের ভীত মজবুত করতে হলে ‘হলুদ’ বা ইয়োলো জার্নালিজম বন্ধ করতে হবে। হয়তো কথাটা অনেকাংশে সত্যি। পুরোটা সত্যি নয়। তাই গণমাধ্যমে কেবল হলুদ, লাল, নীলের দোহাই না দিয়ে সুসাংবাদিকতার জন্য রাষ্ট্র এবং গণমাধ্যম শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মালিক-সম্পাদক, প্রকাশকদের দায়িত্ব নিতে হবে।

বর্তমান বাজারে একজন দিনমজুরকে দিন শেষে তার পরিশ্রমিক দেওয়া হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। মাস শেষে একজন শ্রমিক ১৫ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা মজুরী পান। আর গণমাধ্যমে কাজ করেন যারা তারা কি পাচ্ছেন। হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল বাদ দিলে দিন মজুরের সমান মজুরী কজন পান? অনেকেই পান না। কেউ কেউ ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা পান। কোন কোন পত্রিকা এবং চ্যানেল তো টাকাই দেন না। কেবল কার্ড ধরিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন। কর্মীদের এমন বেহাল অবস্থায় রেখে কি রাস্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ মজবুত করা সম্ভব? অবশ্যই নয়। ভীত তৈরির জন্য সিমেন্ট দেবেন না, বালু দেবেন না, রড দেবেন না, তাহলে ভীতটা দাঁড়াবে কিসের ওপর?

গাছ লাগাবেন। তাতে জল দেবেন না, সার দেবেন না, সেই গাছে ফল আশা করবেন তা কি হয়। অযত্ন অবহেলায় গাছ তো আগাছায় রূপ নেবেই। যে কর্মী গণমাধ্যমে কাজ করেন, তার তো সংসার আছে। দিন শেষ তারও তো বাজার করতে হয়। সে কি দিয়ে বাজার করবে? তখন বাধ্য হয়ে সে বিকল্প পথ খোঁজে। আর সেই বিকল্প পথ করে দেয় মালিক-প্রকাশক-সম্পাদকরা। এরপর তারাই আবার বলে বেড়ান হলুদ সাংবাদিকতা বন্ধ করতে হবে। তেঁতুল গাছ রোপন করে ফজলী আম চাইলে হবে?

এক সময় বেশিরভাগ সংবদকর্মীদের প্রতিবেদন পড়ে মানুষ শ্রদ্ধা করতো। এখন সাংবাদিকের নাম শুনলে মানুষ শ্রদ্ধা করে না, ভয় পায়। অনেক সংবাদকর্মী প্রতিবেদন করেন কেবল ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। পরে সেখান থেকে সুবিধা গ্রহণ করেন। সাধারণ নাগরিকদের হয়রানী করতে করতে তারা নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। একজন অন্যজনের চরিত্র হননে নামেন। ঘটছে হামলা-মামলার মতো ঘটনাও। এইধরণের সাংবাদিকতার সুযোগ নিচ্ছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। যারা সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরে সমাজকে সুন্দরের পথে নেবেন, তারা নিজেরাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। এই সুযোগে অন্য পক্ষ মজা দেখেন এবং হামেসাই অপকর্ম করে বেড়াতে সাহস পান। এই দায় অন্যদের ওপর চাপালে হবে না।

হলুদ সাংবাদিকতার দোষ দিয়ে পুরো পেশাকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে। এখান থেকে মুক্তি পেতে গণমাধ্যমকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করা দরকার। দরকার সমাজের অসঙ্গতি দূর করতে সুসাংবাদিকতার চর্চা করা। সেই কাজ করতে হলে অবশ্যই সংবাদকর্মীদের ন্যায্য পারিশ্রমিক দিয়ে তাদের আশ^স্ত করতে হবে। এব্যাপারে পত্রিকার মালিক-প্রকাশ, চ্যানেলের মালিক এবং সম্পাদকদের দায়িত্ব নিতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকেও। সবশেষে দায়িত্ব নিতে হবে সংবাদকর্মীদেরই।

সংবাদকর্মীদের এই রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হলে কর্পোরেট সাংবাদিকতা বন্ধ করারও উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, কর্পোরেট বাড়িগুলো খবরের কাগজে যা লেখেন নিজেরা তা বিশ^াস করেন না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। বড় বড় ওইসব পত্রিকা এবং টেলিভিশনের সম্পাদকরা গার্মেন্টস শ্রমিকের ন্যায্য মজুরী ১৫ হাজার টাকার করার দাবি তুলে ধরেন তার পত্রিকায়। অথচ তার কর্মীর সংসার যে তার দেয়া সম্মানীতে চলে না সে কথা বলেন না। কেউ বললেও তারা তা শোনেন না।

গণমাধ্যমের দুরাবস্থার জন্য অনেকাংশে দায়ি মালিক-প্রকাশকরা। এর পরে দায়ি হচ্ছে সরকার। বিচার বিশ্লেষণ না করে জেলায় জেলায় পত্রিকার অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। এই ধারা বন্ধ করতে হবে। ভালো সম্মানি দিয়ে ইতিবাচক সাংবাদিকতায় তরুণ ও মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে হবে। অর্ধ শিক্ষিত কিংবা তথা কথিত স্বশিক্ষিতদের এই পেশা থেকে দূরে রাখতে হবে। তাহলে সংবাদপত্র শিল্প সত্যিকার রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হতে পারবে।

বর্তমানে নবম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন নিয়ে কথা চলছে। কিন্তু ওই ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন যারা করবেন তারা হচ্ছেন দেশের বড় বড় গণমাধ্যমের সম্পাদকরা। সেখানে সংবাদ কর্মী কিংবা এই পেশার সঙ্গে যুক্তদের রাখা হয় না। তাই ওই ব্যক্তিরা কখনই চাইবেন না ওই ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন হোক। এখানে সরকারের ভূমিকা নেওয়াও অনেকটা কঠিন। কারণ পাছে ওইসব গণমাধ্যম তাদের বিরুদ্ধে লেগে না যায়। আবার এ কথাও সত্য অস্টম ওয়েজবোড চালু থাকলেও সেই সুবিধা কতজন সংবাদকর্মী পাচ্ছেন সেটারও কেউ খোঁজ রাখেন না। তাই হলুদ, লাল, নীল সাংবাদিকতার দিকে ঝুঁকে পরছে বাধ্য হয়ে।

এখান থেকে বের হতে হলে গণমাধ্যমকে সঠিকভাবে দায়িত্ব নিতে হবে। একই সঙ্গে সংবাদ মাধ্যমের সংগঠনগুলোরও দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে লবিং করতে হবে। চড়ে খাওয়ার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। কার্ড দেওয়ার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। তাহলে হলুদ সাংবাদিকতা বন্ধ হবে। আমরা সবাই মিলে যেন সেই উদ্যোগ নেই। সুসাংবাদিকতা চর্চা করি।