১৫ আগস্ট বিনম্র শ্রদ্ধায় ব্যানার পোস্টার গেটে শোভা পাক বঙ্গবন্ধু

মাঝে মাঝে মনে হয়, মনের মধ্যের ভাবনাগুলো উন্মুক্ত করে ভাবতে পারলে ভালো হয়। তাহলে অনেক সত্য হারিয়ে যায় না। অনেক সত্যের প্রাণ দীর্ঘ জীবন লাভ করে। কেন এমনটা ভাবছি? কারণ আছে। কারণ থাকে। ১৯৭৫ এর খুব ভোরের কথা মনে আছে। তখন ছোট নই একেবারে, ৭১ ছাড়িয়ে ৭৫ এর ১৫ আগস্ট। খুব ভোরে জেগে উঠে দেখি ঘরে সবাই চিন্তিত। রেডিও নিয়ে ব্যস্ত সবাই। খবর শুনছে সবাই। বিবিসির অস্পষ্ট আওয়াজে ঢাকার খবর। বাসার সবাই চিন্তিত বড় ভাই ঢাকায়। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসহ যে যে বাড়িতে গুলি চলেছে তার যে কোন একটায় তাদের থাকার কথা। জানা যাচ্ছিলো না কিছুই। ধীরে ধীরে সূর্যদয়ের আলোর মতোই খবর ছড়াতে লাগলো। বঙ্গবন্ধু পরিবারসহ নিহত। অবিশ্বাশ্য সকাল। অবিশ্বাশ্য এই খবর। স্তম্ভিত বাংলাদেশ।
সেই রাতের গুলিতে নিহত এক লাশের গন্তব্য ছিলো বরিশাল। বরিশাল ক্রিডেন্স ব্যান্ড দলের অন্যতম সদস্য আব্দুর নাঈম খান রিন্টু। এক গান পাগলের মৃত্য হলো বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারের সাথে। নির্বাক অব্যাক্ত ক্রন্দন চরিদিকে। কারো কোন কথা নেই প্রকাশ্যে। নেতা নেতৃত্ব রাজনীতি দিকভ্রান্ত। সবাই ব্যস্ত তখন নিজেকে নিয়ে। কেউ পালিয়ে, কেউ প্রকাশ্যে প্রতিবাদী হয়ে। কেউ মীরজাফরীয় নীতি গ্রহণে। তারপর খুব দ্রুতই রক্তক্ষয়ী নেতৃত্বের পালাবদল হলো কয়েকবার।
স্বাধীন বাংলাদেশের সূর্য তখন আলোহীন অন্ধকার ছড়াচ্ছে। আমরা দেখলাম ‘বঙ্গবন্ধু’ এই শব্দবিহীন এক বাংলাদেশ। অলিতে গলিতে বিদ্যালয়ের বইয়ের পাতায় কোথাও বঙ্গবন্ধু নেই। যুগ কেটে গেলো চরম বৈরিতায়। ওই বৈরিতা কাটিয়ে আওয়ামী রাজনীতির তখনো ঘুরে দাঁড়ানো হলো না। অপেক্ষার প্রহর গুনে গুনে ক্ষুব্ধ কবি, লেখক, গীতিকার, নট্যকার সাহিত্য ও সাংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষেরা। প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর সন্ধানে ব্যাস্ত হলেন তারা। উচ্চারণ করতে শুরু করলেন কারা হত্যাকরী, কেন এই হত্যা? এর বিচার চাই। কবি শামসুর রাহমান লিখলেন ‘যদি তুমি ফিরে না আসো’। সরাসরি সেই রাত্রির কল্পকাহিনী লিখে ফেললেন নির্মলেন্দু গুণ। গানের সুরে বেজে উঠলো ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই’।
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী মঞ্চ কাঁপিয়ে সারা দেশে প্রকাশ্যে বাংলাদেশে প্রথম প্রশ্ন ছুড়তে লাগলো ‘কারা বঙ্গবন্ধুরে হত্যা করলো কারা এই খুনি’? তাদের ‘ইতিহাস কথা কও’ এই গীতি আলেখ্যটি সারা বাংলার মাঠে প্রান্তরে, হাটে, বাজারে, রাস্তায়, মঞ্চে, শহীদ মিনারে সকল প্রতিবন্ধকতা ও রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মঞ্চস্থ হতে লাগলো। তাদের এই দ্বিধাহীন উচ্চারণ ছিলো বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাই।
এ কথা বলেছি আমরা দিনের পর দিন। বলেছে সারা বাংলাদেশ। আজো তাই ১৫ আগস্ট এলে শোকের কালো ছায়ায় ঢেকে যায় দেশ। যদিও বাঙালির এই শোকের রাস্তাই আবার তৈরি করেছে এই দেশের শক্তির উথান। যেন মৃত বঙ্গবন্ধুই এখনো দাঁড় করিয়ে রেখেছে এই বাংলাদেশ। যেমন সে পড়িয়েছিলো এই জাতির কপালে স্বাধীনতার বিজয় তিলক। তবে ভুল কোথায়!! কেন মনে রাখা যায় না এমন বিপর্যয়? কেন ১৫ আগস্টের জাতীয় শোক দিবসের ব্যানারে-ফেস্টুনে গেটে এখনো প্রতিযোগিতা হয় নানান নেতার নাম লেখার। কেন শ্রদ্ধাটা প্রাণের হয় না কেন মন ষ্পর্শ করে না? কেন ব্যবস্থাপনা থাকে না শোক শেষে শ্রদ্ধার সাথে ব্যানার গুছিয়ে রাখার কিংবা গেট খুলে ফেলার? দেখেছি শোক ব্যানারে ব্যবহৃত পিতার ছবি দিনের পর দিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে একসময় ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গড়াগড়ি যায় রাস্তায়। কেন? এ কোন শোক প্রকাশ? কার জন্য? এ কি জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা, না কি আমাদের নাম প্রচার? এখানেই ভয় জাগে মনে! ভয় জাগে বলতে ইচ্ছে হয় ওরা কারা ওরাতো কেউ নয় জাতির পিতার। ওরা জানে না অবনত শ্রদ্ধা। ওরা জানে না সারিবদ্ধ ফুল হাতে তোমার সামনে দাঁড়াতে।
পিতা, একথা বলা যায় না আজ। শুনলে ক্ষুব্ধ হয় নেতা। তার নির্দেশ পেলে ততোধিক ক্ষুব্ধ হয় পাতিনেতা। জানি না কেন এই ক্ষুব্ধতা সত্যের বিরুদ্ধে? জানি, স্পষ্টতই জানি রাজনীতি মুক্ত দেশ চলে না। সাহিত্য, সাংস্কৃতির মানুষদের কাজ নয় এটি। তবে কোথাও কোন স্খলন চোখ এড়ায় না তাদের। জাতির যে কোন বিপর্যয় স্খলন তাদের ব্যস্ত করে। প্রগতির, সত্যের, সৃষ্টির পথ যখন ভুল পথে চলে, যখন রাজনীতির মানুষেরা কেবলই পথ খোঁজেন মিশে যাওয়ার সময়ের সাথে। তখনি কথা বলতে বাধ্য হয়ে যায় কবিতা, গান, নাটক। এমন ঘটনা নূতন নয় এই দেশে। ১৯৭৫ পরবর্তী প্রতিদিন প্রতিক্ষণে এই রূপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে সাহিত্য-সংস্কৃতি। দাঁড়িয়েছে স্বৈরাচার ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধেও। দাঁড়িয়েছে নিদারুন বৈরিতার মধ্যেও। দাঁড়িয়েছে আঘাত সয়ে সয়ে। ওরা সাংস্কৃতি রুখে দাঁড়ানোর অর্থ জানে এবং বোঝে। তাই ওরা এখানেই বাধা দেয়, আঘাত করে বারাবার। চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে চায় সাহিত্য সাংস্কৃতির কণ্ঠ। যদিও জানি, কঠিন বৈপরিত্য নিয়েও বেঁচে থাকবে এ দেশের সাহিত্য সাংস্কৃতির ধারা চিরোকাল। একই সাথে এও জানি, কঠিন এই সত্য তবুও বলি আমাদের কোন বন্ধু নেই এ দেশে।
এ দেশে মুক্ত চিন্তার মানুষেরা কেবল সময়ের স্বার্থের বলির জন্য। তাই আমাদের কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই পথ চলার। চলেছি অগ্রজোদের পথের চিহ্ন দেখে দেখে। যারা অনেকেই নির্লোভ ছিলেন। যারা সাহিত্য সাংস্কৃতির কর্মকান্ডকে সুস্থ মানুষ সৃষ্টির কর্মদ্যোগ মনে করতেন। আমরা কি এমনটা পারছি? পারবো কি না জানি না। চারিদিকে অর্জনের কাড়াকাড়ি, দম্ভ, বিতশ্রদ্ধা, নিজেই নিজেকে যোগ্য ঘোষণা করা, এমন এক পরিস্থিতিতে মানুষ তৈরির চেষ্টাকে পন্ডশ্রম বলার সুযোগ তৈরি হয়ে যায় কি না? কারণ শুধু মাত্র মুখের কথায়, গায়ের জোরে সবকিছু যখন ঢেকে দেওয়ার সময় আসে তখন সকল প্রকার সৃষ্টিশীলতাই স্থবিরতা লাভ করে।
১৫ আগস্ট জাতির পিতার শাহাদাত বার্ষিকী। জাতীয় শোক দিবস। কি করবো আমরা সেই দিন? নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হবে সর্বত্র। শোকের পোস্টার ব্যানারে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন লেখা থাকবে। দিনভর ফুলেল শ্রদ্ধার্ঘ চলবে ১৫ আগস্টের সকল নিহতদের প্রতিকৃতিতে। মিলাদ মাহফিল ও দোয়া হবে মসজিদে। এর বাইরে আর কী হবে? আমরা কি কোথাও ব্যস্ত হবো এ কথা জানতে কে, কেন, কাদের প্রোরচণায় ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞ? কী চলেছিলো বঙ্গবন্ধুহীন জনপদে? কারা চালিয়েছিলো এই দেশ এবং কেমন করে? এমন কোন আয়োজন কি থাকবে কোথাও? যেখানে কোন একজন নেতা মঞ্চে বসে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী বলে যাবে অর্নগল। আর কর্মীরা জাতির পিতার আত্মজীবনীমূলক বই পড়ে এসে নির্বাক শুনতে থাকবে সেইসব কথা? কেন বায়ান্ন, উণসত্তর, একাত্তর। কেন স্বৈরাচার বিরোধীতা, কেন গণজাগরণ শাহাবাগে, কেন রাতের আঁধারে আগুনে পুড়ে যাচ্ছিলো মতিঝিল, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাইতুল মোকাররম মসজিদের সামনের দোকান। কেন? এর উত্তর কি জানি সবাই, বলতে কি পারবো ঠিকঠাক কেউ প্রশ্ন করলে? আওয়ামী রাজনীতির উত্তরসূরীরা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। আর যারা এমন প্রশ্নের উত্তর জানেন না সেই সব নেতাকর্মীদের নির্দিষ্ট কোন ঘর থাকে না। এরা আজ এক জনের, কাল আর এক জনের। তবু এরাই জায়গা পায়, মূল্যায়িত হয় দলে এবং রাজনীতিতে। মূলত এরাই ক্ষমতা নামক এক ক্ষণস্থায়ী বিষয়ের দম্ভ দেখায়। কারণ এরা জানে, ওরা শুধুই ক্ষমতার, আদর্শের নয়।
এ কারণে দেখেছি ১৯৯৩ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সাথে কাজ করতে করতে। সেদিনও এই জোটের দায় দায়িত্বে ছিলেন জনাব সৈয়দ দুলাল। সাথে আমরাও ছিলাম। মাঝখানে কিছু সময় বাদ দিয়ে আজো তাই। দেখেছি দিনের পর দিন নেতারা এসে কিভাবে তাদের উপস্থিতি সরব করতে আমাদেরকে দূরে ঠেলে দেয়। তারা যেন ভুলে যায় এই অনুষ্ঠানের আয়োজক ভিন্ন। তবু আমরা বছরের পর বছর আয়োজন করে চলেছি ১৫ আগস্ট-এর জাতীয় শোকের অনুষ্ঠান। হয়তো এ কথায় কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন। কিন্তু কেউ না কেউ অবশ্যই স্বীকার করবেন, এমনটাই হয়। এমনটাই হয়েছে অতীতে। নেতার সঙ্গে কর্মীরা এসে সামনের চেয়ার দখল করে হাততালি, জয়ধ্বনি দিয়ে নেতার প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে হল খালি করে চলে যায়।
এদের কাছে বঙ্গবন্ধু কোথায়? কোথায় শ্রদ্ধা? তবু আছি আজো আমরা গুটি কয়েকজন। সরব রাজনিতীর ফাঁক ফোকল গলিয়ে যেটুকু যায়গা মেলে সেখানে দাঁড়িয়েই জাতির পিতাকে অবনত শ্রদ্ধা জানাই। ভুলি নাই তো সেই কথা ১৯৯৩ তে যখন এই জোটের অনুষ্ঠান করার জায়গা মেলেনি অশ্বিনী কুমার হলে। প্রথমবারের সেই অনুষ্ঠান করেছিলাম আমরা বি.ডি.এস এর হলে। হল ভরা মানুষ। শিশুরা আবৃত্তি করে চলেছে ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই’। সেই শিশুরা আজ প্রায় ২৮ থেকে ৩০ বছরের যুবক। সেদিন তারা ফাঁসির দাবি নিয়ে সবাই প্রশান্ত হৃদয়ে দাঁড়িয়েছিলো কঠিন দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের পাশে। সেই অমিত শক্তি ফাঁসির দড়ি পড়তে দেখেছিলো মুজিব হত্যাকারীর গলায়। এই বাংলাদেশ তা দেখেছে।
সময় গড়িয়ে যায়। ক্ষমতার পালাবদলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও চতুর্থ বারের মত রাষ্ট্র ক্ষমতায়। তবু এমন শোকের দিনে নিজেদের নাম পরিচয় না লেখা কোন নেতার শ্রদ্ধার উপস্থাপন দেখি না রাস্তায়। যা দেখি সে শুধুই বিস্ময়। জাতির জনকের শাহাদাত বার্ষিকীতেও সকল ব্যানারে পোস্টারে গেটে শ্রদ্ধা উপস্থাপনকারীর নাম শোভা পায়। কেন এমনটা হয়? অন্তত এক দিন, শুধুমাত্র জাতীয় শোক দিবস ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বার্ষিকীতে সকল ব্যানার পোস্টার গেটে শুধুই শোভা পাক বঙ্গবন্ধুর কথা। তাঁর নাম, তাঁর বাণী, তাঁর সেই বিভৎস রাতের রক্তাক্ত ছবি। যা দেখে নির্দিষ্ট কেউ নয়, সমগ্র বাংলাদেশ যেন মনে করে আজ বাঙালি জাতির কাঁদবার সময়। জাতীয় শোক দিবসের এমন দিনে বঙ্গবন্ধুর নাম ছাপিয়ে যদি কারো নাম লেখা জরুরী হয়ে যায় তাহলে সেই নামের ভীড়ে হয়তো কোন এক ফাঁকে আবার নুতন কোন আগস্ট পথ খুঁজে পায়। আমাদের সকল অর্জনের আত্মতুষ্টির মাঝে এই কথাটা ভুল করেও যেন আমরা কেউ ভুলে না যাই। যেন ভুলে না যাই, এই বাংলাদেশের ভৌগলিক স্বার্বভৌম আকাশ প্রতিটি নদী, সাগর পাহাড়ের সমান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক: বাংলাদেশ আবৃত্তি সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, কলাম লেখক ও সাংস্কৃতিক সংঠক।
আরো পড়ুন-