‘ফেক’ আত্মবিশ্বাসে অবনতি

দিনের পর দিন যায়, ম্যাচের পর ম্যাচ, কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটারদের পারফরম্যান্সে কোনও উন্নতি আসে না। উল্টো অবনতি হচ্ছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রাথমিক রাউন্ডে ব্যাটিংয়ে কিছুটা মান থাকলেও সুপার টুয়েলভে শ্রীলঙ্কা ম্যাচের পর থেকেই যেন উল্টো পথে হাঁটছেন মুশফিক-মাহমুদউল্লাহরা। (মঙ্গলবার) দক্ষিণ আফ্রিকার পেস আক্রমণের সামনে দাঁড়াতেই পারেননি। অষ্টমবারের মতো একশ’র নিচে অলআউট লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। এমন ব্যাটিংয়ে ব্যর্থতার মূল কারণ হিসেবে সামনে আসছে যথাযথ প্রস্তুতির অভাব। মূলত বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে ‘ফেক’ আত্মবিশ্বাস সঙ্গী হয়েছিল মাহমুদউল্লাহদের। সেটিই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আনরিখ নর্কিয়া ও কাগিসো রাবাদার বোলিং তোপে ৮৪ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ। যদিও এটি সর্বনিম্ন সংগ্রহ নয়। ২০১৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৭০ রানে অলআউট হওয়ার লজ্জা আছে বাংলাদেশ দলের।
জিম্বাবুয়ে সিরিজের পর থেকেই ব্যাটিং ভোগাচ্ছে। বিশ্বকাপে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার মাহমুদউল্লাহ ও মুশফিকুর রহিম যেভাবে আউট হয়েছেন, সেটি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। অন্য কোনও ব্যাটারও দায়িত্ব নিয়ে খেলতে পারছেন না। বাংলাদেশের ম্যাচে কুড়ি ওভারের ধুম-ধারাক্কা ক্রিকেটের কোনও আমেজ পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রিকেট সমর্থকরা এমন ব্যাটিং দেখে হতাশায় মুখ লুকাচ্ছেন।
জিম্বাবুয়ে সিরিজ শেষে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপের ‘প্রস্তুতি’র অংশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১০টি টি-টোয়েন্টি খেলে মাহমুদউল্লাহরা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে টানা জয়ে দলের আত্মবিশ্বাস সঙ্গী হলেও ব্যাটারদের আত্মবিশ্বাস ছিল তলানিতে। দুই দলের বিপক্ষে সিরিজ জিতলেও সেখানে ব্যাটারদের কোনও ভূমিকা ছিল না। ওই সময় ক্রিকেটার থেকে শুরু করে কোচিং স্টাফরাও বলেছিলেন, জয়ের আত্মবিশ্বাস দলকে বিশ্বকাপে ভালো করতে সহায়তা করবে। বাস্তবে ‘ফেক’ আত্মবিশ্বাস কতটা ভূমিকা রেখেছে, সুপার টুয়েলভের চার ম্যাচের চারটিতে হারের পর তা বোঝা যাচ্ছে।
মিরপুরের ব্যাটিং ব্যর্থতার চিত্রই যেন ফুটে উঠছে বিশ্বকাপে। আরব আমিরাতের ব্যাটিংবান্ধব উইকেট পেয়েও কাজে লাগাতে পারেননি বাংলাদেশের ব্যাটাররা। নাঈম শেখ, লিটন দাস, মুশফিকুর রহিম, আফিফ হোসেন, মাহমুদউল্লাহ- সবাই বাজে শটে আউট হয়েছেন।
শেখ আবু জায়েদ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টস জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানায় দক্ষিণ আফ্রিকা। এই ম্যাচে উইকেট পড়তেও ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট। আগের দিন প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গো বলে দিয়েছিলেন স্পিন নির্ভরতার কথা। সেই হিসেবে একাদশ থেকে কমানো হয়েছে এক পেসারও। কিন্তু খেলা শুরুর পর দেখা গেলো উল্টো। প্রোটিয়ারা তিন বিশেষজ্ঞ পেসার নিয়ে মাঠে নামলেও বাংলাদেশ নেমেছে দুই পেসার নিয়ে। মোস্তাফিজকে বিশ্রামে পাঠিয়ে নেওয়া হয়েছে বাঁহাতি স্পিনার নাসুমকে। ব্যাটিং ব্যর্থতার আগে টস হার, ভুল টিম সিলেকশন ও উইকেট পড়তে না পারাও হারের অন্যতম কারণ।
তবে তার থেকেও বড় কারণ হতে পারে নিকট অতীতে বড় শটস খেলতে না পারার বিষয়টি। ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা ১০ ম্যাচই স্লো ও টার্নিং উইকেটে ব্যাটাররা বড় সংগ্রহ গড়তে পারেননি। বাউন্ডারি কিংবা ওভার বাউন্ডারিতে রান ওঠেনি। ফলে এমন পিচে খেলতে খেলতেই বাংলাদেশের ব্যাটারদের আত্মবিশ্বাস তলানিতে ঠেকেছে। বিশ্বকাপের আগে স্লো উইকেটে খেলে জয় পেলেও আদতে যে বিশ্বকাপ প্রস্তুতি যথার্থ হয়নি, সেটা প্রমাণ করতেই যেন বিশ্বকাপের ব্যাটিং পিচে লিটন-সৌম্য-নাঈম-মুশফিকরা ব্যর্থ হচ্ছেন প্রতিনিয়ত!
বড় দুটি দলের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের পরও বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটারসহ কোচেরা। কিন্তু বিসিবি ও কোচিং স্টাফসহ ক্রিকেটাররা কেউই বিষয়টি আমলে নেননি। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু সাংবাদিকের প্রস্তুতি নিয়ে করা প্রশ্নে বিরক্ত প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘দেখেন যেকোনও ফরম্যাটে খেলি না কেন, জয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জয়টা কিন্তু আত্মবিশ্বাস সবসময় বাড়ায়, হারতে থাকলে মানসিকতা এমনিতেই নেমে যায়। সে হিসেবে জয়ের আত্মবিশ্বাস থাকলে যেকোনও জায়গায় ভালো করা যায়। আর আমাদের বিশ্বকাপ প্রস্তুতি কিন্তু ওমানে গিয়ে শুরু হবে।’
কিন্তু বাংলাদেশ দল ওমানে আগেভাগে গিয়ে প্রস্তুতি নিতে পারেনি। ওমান ‘এ’ দলের বিপক্ষে আনঅফিসিয়াল একটি প্রস্তুতি ম্যাচ জিতলেও শ্রীলঙ্কা ও আয়ারল্যান্ডের কাছে দুটি ওয়ার্ম-আপ ম্যাচ হেরেছে এই ব্যাটিং ব্যর্থতার কারণেই। প্রাথমিক রাউন্ডে স্কটল্যান্ডের কাছে আবারও ব্যাটারদের ভুলে হেরে প্রথম পর্ব থেকেই বিদায় নেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কোনও রকমে দুটি ম্যাচ জিতে সুপার টুয়েলভ নিশ্চিত করলেও মূল পর্বে শ্রীলঙ্কা বাদে কোনও ম্যাচেই ব্যাটিংয়ে ভালো করতে পারেনি মাহমুদউল্লাহরা।
ক্রিকেট বিষয়ক ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোও বাংলাদেশের ব্যর্থতার কারণ হিসেবে ব্যাটারদের লম্বা শটস খেলার অনভিজ্ঞতাকেই সামনে এনেছে। মঙ্গলবার তারা ছেপেছে, ‘অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে যে পিচে বাংলাদেশ খেলেছে, সেটাই মূলত বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে দিয়েছে। সম্ভবত এটা ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ছয় মারার অক্ষমতা লুকানোর জন্য। দুই-একটি ম্যাচে প্রতিপক্ষ সাফল্য পেলেও এই সত্য লুকানোর কোনও সুযোগ নেই যে হোম সিরিজের পিচগুলো কতটা ভয়ংকর ছিল। বাংলাদেশের এই জাতীয় কন্ডিশনে খেলে কোনও উপকার হবে না।’
বিশ্বকাপ শুরুর আগে নিউজিল্যান্ডের অভিজ্ঞ পেসার মিচেল ম্যাকক্লেনাঘান টুইটারে প্রশ্ন তুলেছিলেন এভাবে, ‘জিতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কতদূর?’ শুধু ম্যাকক্লেনাঘানই নন, ভারতের জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলেও এমন উইকেটে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ প্রস্তুতি যথাযথ হচ্ছে কিনা প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা আর ওয়েস্ট ইন্ডিজে যে ধরনের উইকেটে খেলা হচ্ছে; সেটা তাদের বিশ্বকাপ প্রস্তুতির জন্য ভালো হবে কিনা!’
বিশ্বকাপে ব্যাটিং ব্যর্থতার কারণ হিসেবে বিকেএসপির ক্রিকেট উপদেষ্টা নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলেছেন, ‘বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ যে ধরনের উইকেটে খেলেছে, সেখানে খেলে প্রস্তুতিটা ভালো হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। আমি আগেও সেটা বলেছি, ফাইনালি কিন্তু সেটাই হলো। কারণ, বাংলাদেশ ফেক একটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিল। কিন্তু মাঠের ক্রিকেটে এই আত্মবিশ্বাসের কোনও মূল্য নেই। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো।’