এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক আবদুল কাইউমের বিদায়

‘আইয়েন বৈঠকখানায় আইয়েন। এউক্কা উকিল পাইছি, ছোট্টখাট্ট, তয় ত্যাজ বারুদের নাহান’। আধুনিক বাংলায়, ‘আসবেন বৈঠকখানায় আসবেন। একজন আইনজীবী পাওয়া গেছে, ছোটোখাটো তবে তেজ বরুদের মতো’। এ ছিলো আবদুল কাইউমের ওকালতি জীবন শুরুর প্রথম দিকে তাঁর সেসময়ের সহকারি (তখন বলা হতো মহুরি) আলী আহমদ সংক্ষেপে আলি মহুরির মূল্যায়ন। এই গল্প আবদুল কাইউমের কাছ থেকেই শোনা।
এই বারুদতেজি আইনজ্ঞ চির বিদায় নিলেন (২২.১১.২০২০) করোনার কড়াল ছোবলে। আবদুল কাইউম তেজি উকিল বটে, তবে তার পেছনে তিনি আরও দৃঢ়, দৃপ্ত এবং আপোষহীন এক ব্যক্তিত্ব। স্কুল ছাত্রজীবনে মুকুল ফৌজ, কলেজ জীবনে ছাত্র ইউনিয়ন; আরও পরে কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৫৬-৫৭ সালে আবদুল কাইউম বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ছিলেন। কলেজ জীবনে সরকার বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে পুলিশের লাঠিপেটা, বুটের আঘাত (তাঁর কপালের মাঝ বরাবর যে ক্ষত চিহ্ন, তা পুলিশের পবিত্র বুটের আঘাতে সৃষ্ট) এবং সবশেষে কলেজ থেকে ‘রাসটিকেট’ মানে বহিষ্কার। বরিশাল ছেড়ে অন্যকেনো কলেজ থেকে আই-বিএ পাশ করে গৌরনদীর উপজেলার গৈলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু। প্রধান শিক্ষক থাকা অবস্থায় আইন অধ্যয়ন। আইন পাশ করে শিক্ষকতায় ইস্তাফা এ্বং বরিশালে আইন ব্যবসা শুরু। দীর্ঘদিন বরিশালে থেকে ১৯৯০-এর দশকে ঢাকা গমন, হাইকোর্টে যোগদান।
বরিশালে সরকারি উকিল (জিপি) এবং ঢাকায় ডেপুটি এটর্ণি জেনারেলের দায়িত্ব পালন। এই সুদীর্ঘ আইন ব্যবসার জীবনে তাঁর কোনো খাঁদ নেই। শেষ দিকে তিনি যেনো সিভিল আইনের বিশ^কোষ। কোনো মামলার বিবরণ কানে শুনেই জুনিয়ারের দিকে তাকিয়ে বলতেন, অমুক বইয়ের অমুক পৃষ্ঠাটা বের করোতো। পৃষ্ঠাটার দিকে চোখ বুলিয়ে, চশমাটা নাক থেকে নামিয়ে বলতেন, হ্যা হবে। হয়েওছে। এমন আবদুল কাইউমকে ঢাকা হাই কোর্টের আইনজীবীদের অনেকেই জানেন। দুচারজন বিচারপতির মুখেও তাঁর এই বৈশিষ্টের কথা শুনা যাবে। আবদুল কাইউম সম্বন্ধে এমন প্রচলিত গুণবৈশিষ্ট্য ব্যখ্যা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার ভাবনা অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।
যদি প্রশ্ন করা হয়, অতীতে মিলিয়ে যাওয়া সে সব বিষয় আবার কেনো? তাঁদের জন্য রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, ‘রাতের সকল তারা থাকে দিনের আলোর গভীরে’।
আবদুল কাইউম ওকালতি করেছেন, সংসার গুছিয়েছেন, অর্থসম্পদ করেছেন- সব কিছু ঠিক। শতভাগ ঠিক। তবে এই ঠিকের মাঝে আরও ঠিক আছে, সেই ঠিক ‘দিনের অলোর গভীরে’ লুকিয়ে থাকা রাতের তারার মতো ঠিক। তা আপন অন্তর্রাজ্যে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কেরই প্রতিচ্ছবি। তিনি কখনো ক্ষণিকের জন্যেও নীতিআদর্শ চ্যুত হননি। পেশাগত কোনো অসদাচরণ বা বিচ্যুতি যেমন নেই, তেমনি নিজ বিশ্বাসের প্রতিও নেই কোনো স্খলন। ধর্মবিশ্বাস, অসাম্প্রদায়িক চেতনা কিংবা মানবতার অমোঘ উচ্চারণ থেকে তিনি একচুলও নড়েননি।
আবদুল কাইউম-এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক বছর চল্লিশের। ১৯৭০ দশকের শুরু থেকে থেকে ২০০০ দশকের শেষ। সাংবদিকতা, সাংবাদিক সমিতি থেকে শুরু করে ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিগত জীবন সর্বত্রই আমাদের পথ চলা সমান্তরাল তালে। সেখানে বয়সের ফারাক কখনো বাধার হয়ে দাঁড়ায়নি। আবদুল কাইউম আমার বন্ধু, ভাই, পথের নিশানা আলোর দিশা। একটি উদাহরণ। ১৯৭৪ সাল। বরিশাল পৌর সভার নির্বাচন। চেয়ারম্যান প্রার্থী আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, ভাইস চেয়ারম্যান এডভোকেট সোবহান মাসুদ। আর কমিশনার হিসেবে লড়বেন শহরের বাছাই করা ভালো মানুষরা। সভা ডাকলেন আবদুর রব সেরনিয়াত তাঁর বৈঠকখানায়। শুরু হলো ভালো মানুষ বাছা। নাম এলো সুধীর সেন, নিখিল সেন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন কামাল, আবদুল কাইউম, বদিউর রহমান অরো কয়েকজন। এর মধ্যে আবদুল কাইউম আর বদিউর রহমান একই বরিশাল ইউনিয়নের বাসিন্দা। এই ইউনিয়নে কমিশনার হবেন তিনজন, তাই সিদ্ধান্ত হলো দুজনকেই লড়তে হবে। আমরা দুজনই নির্বাচন না করার পক্ষে যুক্তি দিলাম, কিন্তু ধোপে টিকলো না। রাতে স্বয়ং নলিনী দাস জানালেন দুজনেরই লড়তে হবে, পার্টির সিদ্ধান্ত। তাই হলো। কাইউম ভাইর মার্কা ‘তালা’ আর আমার ‘কলস’। তাই স্লোগান হলো ‘তালা কলস দেখিয়া ভোট দেবেন ভাই হাসিয়া’। তখনকার জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কাশীনাথ দত্ত (এখন আওয়ামী লীগের নেতা বা কর্মী) ছিলেন আমাদের নির্বাচন পরিচালনা প্রধান। ভোটারের হাসি যে প্রার্থীর কান্না তা বোঝা গেল ভোট গণনার পর। নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান সোবাহান মাসুদসহ ভালো মানুষদের সবাই পরাজিত।
বলছিলাম কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্তের প্রতি আবদুল কাইউমের অবিচলতার কথা। এভাবেই তিনি পার্টির সিদ্ধান্তের প্রতি ছিলেন নিষ্ঠাবান। খুব মনে পড়ে পার্টির সম্পাদক নূরুল ইসলাম মুন্সি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন কাইউম ভাইর সদস্যপদ নবায়ন ও লেভি আদায়ের। বলা বাহুল্য আমরা ছিলাম গোপন সদস্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় শহরে থেকেই কাজ করেছেন যথাযথভাবে। বাংলাদেশ সোভিয়েত মৈত্রি সমিতি বরিশাল শাখার তিনি ছিলেন সহ-সভাপতি, মহিউদ্দি আহমদ (পিস্তল মহিউদ্দিন) ছিলেন সভাপতি। মৈত্রি সমিতিতে প্রায় সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেছে কাইউম ভাই। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ করতে আমার কোনো বেগ পেতে হয়নি এই দুজনের অগ্রগামী ভূমিকার জন্য। আবদুল কাইউম ১৯৯০-এর গোড়ার দিক থেকেই পার্টির সাথে সম্পর্ক ছেদ করেন। তবে পার্টির বন্ধু ছিলেন অমৃত্যু।
ব্যক্তি জীবনযাপনে আবদুল কাইউম ছিলেন সাধারণ, স্বাভাবিক ও সুশৃঙ্খলিত। আদালত ছাড়া তাঁর পোষাক ছিলো ধোপদুরস্ত সাদা পাজামা পাঞ্জাবী। তিনি তাঁর পেশাগত পোশাককে তুলনা করতেন ‘ঘটিগরম চানাচুরঅলার’ পোশাকের সঙ্গে। তার যে দিন ডায়াবেটিস ধরা পরে, সেদিন ফোন করে বললেন, ‘অমি একটা কারখানা খুলেছি আর ওকালতি করবো না’। আমিতো অবাক। একটু থেমে বললেন, ‘সত্যিই আমি একটা চিনির কারখানা খুলেছি’। সেই কারখানা সামাল দিতে রাতে কোথাও দাওয়াত থাকলে পকেটে করে তিনটা রুটি নিয়ে যেতেন। এমনি শৃঙ্খলায় চলতেন আবদুল কাইউম। তাঁর পোশাক পরিচ্ছদে কোনো দিন কোনো ব্যতিক্রম চেখে পড়েনি।
আবদুল কাইউমের রসবোধ ও রসিকতা ছিলো ঈর্ষণীয়। ঠিক জায়গাটিতে ঠিক ‘ডোজ’টি দিতে তিনি কখনো ভুল করতেন না। ওকালতির ফি-এর টাকা তিনি কখনো গুনে নিতেন না। যে যা দেয় হাতের মুঠোয় নিয়ে শুধু বলতেন, ‘কী দেও হেমিওপ্যাথি ডোজ, একটু এলোপ্যাথি ছাড়ো’- এই পর্যন্তই। তিনি নিজের নামের একটা মজার ব্যাখ্যা দিতেন। বলতেন ‘আবদুল কাইউম’ আর ‘ভগবান দাস’ একই অর্থ। আভিধানিক অর্থে তা-ই।
সবশেষে বলি, একজন আদর্শবান মানুষের বিদায় হলো। এ যেনো এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের বিদায়; যে জ্যোতিষ্কের পতন নেই কেবল বিদায়। বিদায়।