টিকা কার্যক্রম ও করোনা মোকাবিলায় সুশাসনের ঘাটতি: টিআইবি

টিকা কার্যক্রম ও করোনা মোকাবিলায় গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমে সুশাসনের ঘাটতি করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণকে দীর্ঘায়িত করছে বলে মনে করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশাল বাংলাদেশ টিআইবি। সুশাসনের ঘাটতি নিরসনে ১৯ দফা সুপারিশও দিয়েছে টিআইবি।
মঙ্গলবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘করোনা ভাইরাস সংকট মোকাবিলা: কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সংবাদ সম্মেলনে করোনা সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি, নতুন নতুন ধরনের অনুপ্রবেশ, সংক্রমণ রোধের সক্ষমতা ও টিকা কার্যক্রম বন্ধ হওয়া ইত্যাদি বিবেচনায় বাংলাদেশে করেনানা অতিমারি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এমতাবস্থায় অবিলম্বে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সক্ষমতাসম্পন্ন কোম্পানিগুলোকে নিজ উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে টিকা উৎপাদনের সুযোগ প্রদান করার পাশাপাশি ক্রয়বিধি অনুসরণ করে সরকারি-বেসরকারি খাতের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরাসরি আমদানির অনুমতি দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছে সংস্থাটি।
সঙ্গে কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে সুশাসনের প্রতিটি নির্দেশকে কৌশলগত ঘাটতি থাকায় এবং ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর প্রভাব ও রাজনৈতিক বিবেচনায় টিকা ক্রয়ের ক্ষেত্রে একক উৎসের ওপর নির্ভর করায়, চলমান টিকা কার্যক্রমে আকস্মিক স্থবিরতা নেমে এসেছে উল্লেখ করেছে টিআইবি। সংকট মোকাবিলা ও সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণের লক্ষে ১৯ দফা সুপারিশ প্রদান করে টিআইবি।
টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মনজুর-ই-আলম এর সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টাÑনির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরাম। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের রিসার্চ ফেলো মো. জুলকারনাইন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে টিআইবি ইতোপূর্বে দুটি গবেষণা পরিচালনা করে। তারই ধারাবাহিকতায় টিকা ব্যবস্থাপনাসহ কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম সুশাসনের আলোকে পর্যবেক্ষণ করার উদ্দেশ্যে ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সময়কালের তথ্য সংগ্রহ করে টিআইবি তৃতীয় দফার এই গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালনা করেছে। এই গবেষণায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সারাদেশের ৪৩টি জেলার ৫৯টি টিকা কেন্দ্র দৈবচয়নের ভিত্তিতে বাছাই করে এসব কেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৩৮৭ জন টিকা গ্রহণকারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, এবং জেলা/উপজেলা পর্যায়ে ১২ ধরণের টিকা গ্রহণে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ৩১৭টি প্রতিষ্ঠান/দপ্তর থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ইতিবাচক নানা পদক্ষেপের মধ্যে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত সময়ে র্যাপিড অ্যান্টিজেন ও জিন-এক্সপার্টসহ আরটি-পিসিআর নমুনা পরীক্ষার সুবিধা সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ঢাকায় এক হাজার শয্যার ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে সংক্রমণ বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশব্যাপী লকডাউন বাস্তবায়ন করা হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত চলমান। পাশর্^বর্তী দেশের সাথে সীমান্ত বন্ধ করা হয়েছে। কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে গতি সঞ্চার করার উদ্দেশ্যে এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার দুটি নতুন প্রণোদনা কর্মসূচি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ৩৬ লাখ দরিদ্র পরিবারে দ্বিতীয়বার ২ হাজার ৫০০ টাকা নগদ অর্থ সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশ^ব্যাপি কোভিড-১৯ টিকার ব্যবহার শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে টিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিপরীতে, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পরিকল্পিত উদ্যোগের ঘাটতির কারণে করোনার সংক্রমণ পুনরায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এন্ট্রি পয়েন্টগুলোতে (বিমান ও স্থলবন্দর) সংক্রমিত ব্যক্তি চিহ্নিতকরণ এবং কোয়ারেন্টাইন করার উদ্যোগের ঘাটতির কারণে কোভিড-১৯ এর নতুন ধরনের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নে সমন্বিত ‘আচরণ পরিবর্তনের’ (ইবযধারড়ৎ ঈযধহমব) উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনার কঠোর বাস্তবায়নেও ঘাটতি লক্ষ করা যায়। ফলে সংক্রমণের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ও মৃত্যুর মধ্যে ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ আক্রান্ত ও ২৪ দশমিক ২ শতাংশ মৃত্যু ২০২১ সালের মার্চ ও এপ্রিল এই দুই মাসে লক্ষ করা গেছে।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস পরীক্ষায় আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার এখনো ৩০টি জেলার মধ্যে সীমিত এবং অধিকাংশ পরীক্ষাগার বেসরকারি। বিদ্যমান আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় কিছু নতুন স্ট্রেইন শনাক্তে সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। নমুনা পরীক্ষার কিটের দাম তিনগুণ হ্রাস পেলেও বেসরকারি পরীক্ষাগারের জন্য নির্ধারিত ফি হ্রাস করা হয়নি। এখনো পরীক্ষার প্রতিবেদন পেতে কোথাও কোথাও ৪ থেকে ৫ দিন অপেক্ষা করতে হয়। পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্প্রসারণ উদ্যোগে এখনো ঘাটতি বিদ্যমান। সংক্রমণের একবছর তিনমাস অতিবাহিত হলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী আইসিইউ, ভেন্টিলেটর ইত্যাদি চিকিৎসা সুবিধার সম্প্রসারণ করা হয়নি। বাজেট এবং যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও সকল জেলায় ১০টি করে আইসিইউ শয্যা প্রস্তুতের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। অনেক যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করে ফেলে রাখা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ সংকটের কারণে বেসরকারি হাসপাতালে ব্যয়বহুল চিকিৎসা গ্রহণে বাধ্য হয়েছে সাধারণ জনগণ। ফলে একজন কোভিড-১৯ রোগীর গড় খরচ হচ্ছে ৫ লক্ষাধিক টাকা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৩ দশমিক ৮ কোটি মানুষকে (জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ) টিকার আওতায় নিয়ে আসা ও সে অনুযায়ী টিকা সংগ্রহের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনায় ঘাটতি রয়েছে। টিকার বাফার স্টক সংরক্ষণে দূরদর্শিতার ঘাটতির কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ১৩ লাখের বেশি টিকাগ্রহীতার দ্বিতীয় ডোজ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আবার অনলাইনভিত্তিক নিবন্ধন হওয়ার ফলে ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ টিকাগ্রহীতাকে অন্যের সহায়তায় নিবন্ধন নিতে হয়েছে। এছাড়া নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ টিকাগ্রহীতা বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন যাদের তাদের প্রায় ৭৮ শতাংশকে নিবন্ধন করতে ৫ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হয়েছে। অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা সত্ত্বেও কিছু পেশা/জনগোষ্ঠীর মানুষের বয়স ৪০ বছর না হওয়ার কারণে তারা নিবন্ধন করতে পারেনি। আবার পেশা/জনগোষ্ঠী যাচাইয়ের সুযোগ না থাকায় অগ্রাধিকার তালিকার বাইরে থেকে অনেকে টিকা গ্রহণ করেছে বলে জানা যায়।
গবেষণায় দেখা যায়, যথাযথভাবে এলাকাভিত্তিক টিকার চাহিদা যাচাই না করার ফলে সরবরাহ না থাকায় কোনো এলাকায় আকস্মিক সংকট এবং কোনো এলাকায় টিকা উদ্বৃত্ত থাকা ও ফেরত দেওয়ার ঘটনা লক্ষ করা যায়। যথাযথভাবে চাহিদা যাচাইয়ের মাধ্যমে বিদেশগামী কর্মীদের যথাসময়ে টিকার আওতায় আনা হয়নি এবং টিকা সনদ না থাকায় প্রত্যেকের গড়ে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে স্বল্প আয়ের ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির হার খুবই কম। টিকায় অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে নারীদের হারও কম। প্রচারে ঘাটতি, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধনের ব্যবস্থা না করায় অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মরত সকল কর্মীকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। টিকাদান কেন্দ্রেও নানা অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে। নির্ধারিত কেন্দ্রে টিকা নিতে গিয়ে জরিপে অন্তর্ভুক্ত ২৭ দশমিক ২ শতাংশ টিকাগ্রহীতা নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। ৫০ দশমিক ২ শতাংশ টিকাগ্রহীতাকে উপকারিতা ও পাশর্^প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত করা হয় নি এবং ৫৬ দশমিক ২ শতাংশ টিকাগ্রহীতাকে টিকা দেওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে পাশর্^প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করা হয়নি। টিকা কেন্দ্রে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা হয়নি। ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ টিকা কেন্দ্রে অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থাই নেই। টিকাগ্রহীতার ৬৫ দশমিক ৮ শতাংশ কোনো অভিযোগ করতে পারেনি এবং ২২ দশমিক ১ শতাংশ কীভাবে অভিযোগ জানাতে হয় তা জানে না বলে জানিয়েছেন।
গবেষণায় উঠে এসছে, টিকা সংগ্রহ এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা, সমন্বয়হীনতা ও ক্রয় চুক্তিতে স্বচ্ছতার ঘাটতি বিদ্যমান। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাপে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একটি উৎস ছাড়া বিকল্প উৎস অনুসন্ধানে উদ্যোগের ঘাটতি ছিল। জাতীয় কমিটি এবং বিএমআরসি একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের টিকা ট্রায়ালের অনুমোদন দিলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে যথাযথ সাড়া না দেওয়ায় ট্রায়াল প্রচেষ্টা বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া দেশীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত টিকা ট্রায়ালের অনুমোদনেও দীর্ঘসূত্রতা লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশ সরকার, বেক্সিমকো এবং সেরাম ইনস্টিটিউটের মধ্যেকার টিকা ক্রয় চুক্তি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার ঘাটতি ছিল প্রকট। টিকা ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয়বিধি অনুসরণ করা হয়নি। যৌক্তিক কারণ না দেখিয়ে টিকা আমদানিতে তৃতীয় পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ (২ দশমিক ১৯ ডলার), ভারত (২ দশমিক ৮ ডলার), আফ্রিকান ইউনিয়ন (৩ ডলার) ও নেপালের (৪ ডলার) চেয়ে বেশি মূল্যে কোভিশিল্ড টিকা ক্রয় (৫ ডলার) করা হয়েছে। সরকার সরাসরি সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে টিকা আনলে প্রতি ডোজে যে টাকা বাঁচতো তা দিয়ে ৬৮ লাখ বেশি টিকা ক্রয়ের চুক্তি করা যেত। ক্রয় বিধি ২০০৮, এর ৩৮ (৪) (গ) অনুসরণ না করে ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে টিকা সরবরাহের ক্ষেত্রে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সকল পক্ষকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত প্রতিনিধিদের মধ্যে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাও আছেন, যা আইনের লঙ্ঘন। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ [অনুচ্ছেদ ১২ (কে)] অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে এমন কেউ সংসদ সদস্য পদে থাকতে পারবেন না।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, বিভিন্ন হাসপাতালের কোভিড মোকাবিলায় বরাদ্দ ব্যয়ে দুর্নীতি অব্যাহত ছিল। যেমন পাঁচটি হাসপাতালে ক্রয়, শ্রমিক নিয়োগ ও কোয়ারেন্টাইন বাবদ ৬২ দশমিক ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ কোটি টাকার দুর্নীতি; ক্রয়বিধি লঙ্ঘন করে এক লাখ কিট ক্রয়; বিধি লঙ্ঘন করে অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে ক্রয়াদেশ প্রদানের ঘটনা দেখা গেছে। করোনাকালে কারিগরি জনবলের ঘাটতি মেটাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়োগে জনপ্রতি ১৫-২০ লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। উপযোগিতা যাচাই না করে হাসপাতাল নির্মাণ এবং তার যথাযথ ব্যবহার না করে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়ায় ৩১ কোটি টাকার অপচয় হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতের ক্রয়ে সংঘটিত দুর্নীতির কারণে বারবার পরিচালক পরিবর্তন, ধীরগতির তদন্ত কার্যক্রমের প্রভাবে ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি লক্ষ করা গেছে। কোভিড-১৯ মোকাবিলা কার্যক্রমে এক বছরে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে যেমন শৈথিল্য রয়েছে, তেমনি সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচারেও ধীরগতি লক্ষ করা গেছে। দুর্নীতিতে জড়িত কিছু ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আইনের আওতায় আনা হয়নি।
গবেষণায় দেখা যায়, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে এখনো চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। সরকার ঘোষিত মোট ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজে বরাদ্দকৃত ১ লাখ ২৮ হাজার ৩০৩ কোটি টাকার প্রায় ৩৫ শতাংশ বিতরণ করা হয়নি। বৃহৎ ও রপ্তানিমুখী শিল্প প্রণোদনার অধিকাংশ বিতরণ হলেও কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং নি¤œ আয়ের জনগোষ্ঠীর প্রণোদনা বিতরণে ধীরগতি লক্ষ করা গেছে। এছাড়া করোনাকালীন তথ্য প্রকাশের কারণে গণমাধ্যমকর্মীদের হয়রানি, নির্যাতন ও মামলার শিকার হওয়া অব্যাহত ছিলো। অতিমারী নিয়ে লেখালেখির কারণে ২০২০ সালে ৮৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন করা সাংবাদিক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তথ্য সংগ্রহের সময় নির্যাতনের শিকার ও আটক হন, তার বিরুদ্ধে অযৌক্তিকভাবে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩Ñ এ মামলা দায়ের করে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘করোনা সংক্রমনের শুরু থেকে বিগত দেড় বছর যাবৎ স্বাস্থ্যখাতে যে ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি ছিলো, তা এখনো অব্যাহত আছে। সরকারি ক্রয়বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে, জনবল নিয়োগে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, উপযোগিতা নিশ্চিত না করে হাসপাতাল সাময়িকভাবে প্রস্তুত এবং তা বন্ধ করার ফলে সরকারের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা অব্যাহত ছিলো, তথ্য নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা আরো ঘনিভূত হয়েছে। সরকার দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে যতখানি তৎপর তার চেয়ে দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ নিয়ন্ত্রণে শতগুণে বেশি তৎপর ছিলো। যা আত্মঘাতী বিষয়, এ থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে।’
চলমান টিকাদান কার্যক্রমের সমালোচনা করে ড. জামান বলেন, ‘পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা এবং বাস্তবায়নে সরকারের সমন্বিত ও সুনির্দিষ্ট পথরেখার অভাবে টিকাদান কার্যক্রমেও ব্যপক ঘাটতি বিদ্যমান। টিকা নিবন্ধন ও ব্যবস্থাপনা সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতিকূলে হওয়ায় এলাকা, শ্রেণি, লিঙ্গ ও পেশাভিত্তিক বৈষম্য তৈরি হয়েছে; ফলশ্রুতিতে ঝুঁকিপূর্ণ ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে অনেকেই টিকার আওতার বাইরে রয়ে গেছে। যা সার্বজনীন টিকাদান কর্মসূচির অঙ্গীকারকে ঝুঁকিপূর্ণ করেছে। তাই অবিলম্বে সমন্বিত টিকাদান পরিকল্পনার মাধ্যমে সম্ভাব্য সমস্ত উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ ও তা প্রদানের সুনির্দিষ্ট পথরেখা প্রস্তুত করতে হবে।’
সীমান্তবর্তী এলাকায় নতুন ধরণের করোনা সংক্রমন বৃদ্ধির সময় ইউপি নির্বাচন আয়োজন বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে উদ্যোগ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন সময় জনগণের উদ্বেগের বিষয়গুলো বিবেচনায় না নিয়ে জনস্বার্থবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেই যাচ্ছে। এখন নির্বাচনের সময় না। তাই আমরা আশা করবো কমিশন অবিলম্বে এ ধরনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সবার আগে মানুষের কল্যাণ বিবেচেনা করবেন এবং এই এখতিয়ার কমিশনের আছে।’
গবেষণা প্রতিবেদনে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় সুশাসনের ঘাটতি নিরসনে টিকা কার্যক্রম সম্পর্কিত ১১টি এবং অন্যান্য কার্যক্রম সম্পর্কিত ৮টিসহ মোট ১৯ দফা সুপারিশ প্রদান করে টিআইবি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: দেশের ৮০ শতাংশ জনসংখ্যাকে কীভাবে, কত সময়ের মধ্যে টিকার আওতায় আনা হবে তার সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা করা; উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সক্ষমতাসম্পন্ন কোম্পানিগুলোকে নিজ উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে টিকা উৎপাদনের সুযোগ প্রদান করা; সরকারি ক্রয়বিধি অনুসরণ করে সরকারি-বেসরকারি খাতের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরাসরি আমদানির অনুমতি প্রদান করা; রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ব্যতীত টিকা ক্রয় চুক্তি সম্পর্কিত সকল তথ্য সকলের জন্য উন্মুক্ত করা; টিকা কেন্দ্রে অভিযোগ নিরসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা এবং অভিযোগের ভিত্তিতে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অন্যান্য কার্যক্রম সম্পর্কিত সুপারিশের মধ্যে কোভিড-১৯ মোকাবিলা কার্যক্রমে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির ক্ষেত্রে দ্রুততার সাথে তদন্ত ও সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা; স্টোরে ফেলে রাখা আইসিইউ, ভেন্টিলেটরসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি অতি দ্রুততার সাথে ব্যবহারযোগ্য করা; সকল জেলায় আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার স্থাপন করা; কোভিড-১৯ চিকিৎসার খরচ সর্বসাধারণের আয়ত্তের মধ্যে রাখতে চিকিৎসা ফির সীমা নির্ধারণ করা; এবং স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর বিকল্প জীবন-জীবিকার সংস্থান করে সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় এলাকাভিত্তিক ‘লকডাউন’ দেওয়া এবং সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যাসহ নিষেধাজ্ঞার আওতা নির্ধারণ করা উল্লেখযোগ্য।