ডাহুকের সবুজ ঠোঁট

দুপুর বেলায় বৃক্ষ ছায়াছন্ন পুকুরের পাড় ধরে ছেলেবেলায় পালা করে কৈ মাছ ধরার বড়শি নিয়ে হেঁটে বেড়াতাম। কৈ মাছ ছাড়াও টাকি ও চ্যাং মাছ এ বড়শি দিয়ে ধরা যেত। চ্যাং ও টাকি মাছ কীনারের জলের কাছে চলে আসতো। রোদের অলোয় ওদের স্পষ্ট দেখা যেত। পুকুর থেকে চালনি দিয়ে ছেকে কিছু চিংড়ি ধরে আমি কৈয়া বড়ি দিয়ে অনেক টাকি ও চ্যাং ধরেছি। কৈ মাছ ধরার জন্য আমরা কচুরির ডোবায় বা ধানক্ষেতে নেমে ঘাস ফড়িং ধরতাম। ফড়িং এর টোপ কৈ মাছ বেশি খায়।
পুকুরের পূর্বপাড়ে, গোসল করার ঘাট থেকে একটু দূরে ছিল এক সারি খেজুর গাছ। জায়গাটি তাই ঝোপালো ছিল। খেজুর গাছের অসংখ্য বাইল নুয়ে পড়েছে জলের কাছাকাছি। কোনটির আগা ডুবে গেছে। পুকুরের বড়, ছোট ও মাঝারি শোল মাছ ভেসে উঠতো এ খেজুরের বাইলের নিচে। কাছিমের মতো কিছুক্ষণ পরপর ওরা ওপরে এসে শ্বাস নিত।
কোন এক দুপুর বেলায় দেখা হয় একটি পাখির বাসার সঙ্গে। ওই খেজুর গাছের নুয়ে পড়া বাইলের (কয়েকটি বাইলের সংযোগস্থল) ওপর লতাপাতায় মোড়ানো গোলাকার একটি বাসা। পুকুরের জলের সামান্য ওপরে বাসাটি। খুব সুন্দর গোলাকার বাসা। বাসায় ৭টি আন্ডা (ডিম)। ডিমের রঙ সাদা, তার ভিতর লাল ফোট ফোট। বাসায় তখন পাখি নেই। আমগাছের আবডালে লুকিয়ে পড়ি, ক্ষণিকবাদেই একটি পাখি এলো। আমি জানি না তার নাম!
কালো ও সাদা বর্ণের পালক। সবুজ ঠোঁট, ওপরের ঠোঁটের গোড়ার অংশ গাঢ় লাল। ভারি সুন্দর চোখ। আমি পাখিটির সবুজ-লাল ঠোঁটের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। এত সুন্দর বর্ণ, যেটা কোনদিন ভোলার নয়। তাই ডাহুক পাখির কথা মনে পড়লে সেই রং মনে পড়ে। ডাহুক দেখলে তার ঠোঁটের দিকে প্রথম তাকাই। পরিনিত বয়সে বা ব্রিডিং পিরিয়ডে তাদের ঠোঁটের রঙ এমন হয়। বাসাটি দেখার পড় আমি দৌড়ে হাপাতে হাপাতে বাড়ির কাকে গিয়ে যেন বলছিলাম, সে আমার সঙ্গে এসে বললো এটা ডাউকের বাসা।
তিনি বাসাটি অন্য কাউকে দেখাতে নিষেধ করেছিল। কারণ তখন গ্রামের কয়েক জন দুষ্ট ছেলের দল পাখির বাসা দেখলে বাসা ভেঙে ডিম নিয়ে যায়। তবে সব পাখির নয়। পাখির বাসা খোঁজার নেশা আমার ছেলেবেলা থেকে। বাসার সৌন্দর্য, নানান বর্ণের ডিম এবং পাখির বাসা বানানো দেখা আমার খুবই ভালো লাগতো।
এরপর কয়েকদিন ধরে লুকিয়ে ডাহুকের বাসা দেখতাম। দুটি ডাহুক মিলে পালা করে ডিমে উমান (তা) দিত। একদিন দুপুরে গিয়ে দেখলাম, কুচকুচে কালো কালো ছানা, একদম মুরগির ছানার মতো দেখতে। দেখলাম একে একে বাসা থেকে টুপ করে লাফ দিয়ে জলে নামতেছে। ৬টি ছানা সবাই নামল, একটি ডিম শুধু ফোটেনি। তারপর ছানাদের নিয়ে দুটি ডাহুক পুকুরে পশ্চিম দিকে চলে গেল। তারপর আর দেখা হয়নি ওদের।
প্রতিবছর কয়েক জোড়া ডাহুক বাড়ির আশে পাশে ঝোপে বাসা করতো। আসমা লতার ঝোপে ও হিজল গাছে বেশি বাসা বানাতো। তবে সুপারী গাছের মাথায়ও বাসা বানাতো। ডাহুক ছানারা লোকজন দেখলে ডুব দিয়ে জলের ভিতর চলে যেত। ডাহুক সব সময় ডাকতো না। সন্ধ্যায় কয়েক জোড়া ডাহুক কো. কো...কোড়রাও কোড়াও.. সুরে কয়েকবার ডাকতো। ডাহুকের সেই সন্ধ্যার ডাক এবং সবুজ ঠোঁটের সৌন্দর্য কোনদিন ভোলার নয়।
লেখক: সৌরভ মাহমুদ, জার্মান প্রবাসী, উদ্ভিদ ও পাখি বিশেষজ্ঞ।