নূরহোসেন দিবস: গণতন্ত্রের নবযাত্রার দিন ১০ নভেম্বর

নূরহোসেন দিবস: গণতন্ত্রের নবযাত্রার দিন ১০ নভেম্বর

১০ নভেম্বর ১৯৮৭। দিনটিকে নূরহোসেন দিবস হিসেবে পালন করে বাংলাদেশ। কেউ কেউ বলেন স্বৈরাচার মুক্তি দিবস। এই দিন ঢাকার রাজপথে নূরহোসেন বুকের রক্ত দিয়ে গণতন্ত্রের পথ সুগম করে। নূরহোসেরন রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছিল তিন দলের রূপরেখা। যার ওপর ভিত্তি করে ৯০-এর তত্তাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে নতুন করে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরুও হয় নূরহোসেনের রক্তদানের মধ্যদিয়ে। যদিও ডা. মিলনসহ স্বেরাচার বিরোধী ওই আন্দোলনে অনেকের তাজা রক্ত রাজপথ রঞ্জিত করেছে। তারপরও আমার ১০ নভেম্বরকে নূরহোসেন দিবস বলি। বলা উচিত গণতন্ত্রেরণ নবযাত্রা দিবস।

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর আর ২০২০ সালের ১০ নভেম্বরের মধ্যে ফারাক অনেক। মাঝখানে ৩৩টি বছর অতিক্রম করেছি আমরা। স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে নতুন গণতন্ত্রের পথে কিভাবে হেঁটে এই পর্যন্ত এসেছে সেই ইতিহাস অনেকেরই জানা। ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে কয়েকবার। তার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র কতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে সেটাও সাধারণ মানুষের বিচার্য বিষয়। যদিও সেই বিচারে কো দোষী কে দোষী না সেকথা সবসময় কঠিনভাবে বলা সম্ভব হয় না। বলতে পারে না দেশের জনগণ। কিংবা বলা যায়ও না। তারপরও নানা চরাই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ গণতন্ত্র চর্চার পথে আছে। সেই পথ ধরেই আমরা উন্নত দেশের সারিতে স্থান করে নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে যাচ্ছি। আগামী বছর আমরা মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তি পালন করবো। সব মিলে দেশের মানুষ কোনভাবেই স্বৈরাচারী সরকারকে মেনে নিতে চায় না। সেটা যে কেবল সেনাশাসিত তা নয়। সেনাশাসিত সরকার ছাড়াও গণতন্ত্রের নামে চাপিয়ে দেওয়া কোন বিষয়ও মন দিয়ে মানতে পারে না বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ অবশ্য অবশ্য গণতন্ত্রের পথে থাকবে। থাকবে মানুষের বাকস্বাধীনতা এবং জবাবদিহিতা। রক্তস্নাত বাংলাদেশকে কেন জানি জবাবদিহিতার জায়গায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। নানান অজুহাতে জবাবদিহিতাকে এড়িয়ে চলা হয়। না জনগণ না সরকার কেউ জবাবদিহি হতে চায় না। এসব কথা বলার দিন আজ নয়। আমরা বিশ্বাস করি বাংলাদেশ অবশ্যই শান্তির ও সোনার বাংলায় পূর্ণ রূপান্তর হবে গণতন্ত্রের ভীতের ওপর দাঁড়িয়ে। ৭১ এর রক্তস্রোত আমাদের ৮৭-র নূরহোসেন এবং ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী গণবিক্ষোভ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। তাই আজ আমার ৮৭-এ ১০ নভেম্বরের কথা বলতে চাই। বলতে চাই নূরহোসেনর বুকে পিঠে লেখা কালজয়ী শ্লোগান ‘গণতন্ত্র মুক্তিপাক, স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক’।

কি ঘটেছিল সেদিন ঢাকার রাজ পথে? তার সঙ্গে সারা বাংলাদেশ কিভাবে যুক্ত ছিল? ছাত্রজনতা কেন সেদিন পণ্টনময়দানসহ গোটা ঢাকাকে অবরোধ করতে সক্ষম হয়েছি। তার কিছুটা চিত্র তুলে ধরতে চাই।

১৯৮৭ সালের এই দিনে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার বিরোধী আন্দোলনের অংশ ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি। সারা দেশ থেকে ঢাকামূখী মানুষের যাত্রা। এই দিন ঢাকায় অবরোধে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। সেই গুলিতে মারা যায় গণতন্ত্রকামী যুবক নূরহোসেন। নূরহোসেনের আত্মদান বিফল হয়নি। নূরহোসেন, ডাক্তার মিলনের রক্ত¯œাত বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সেই পদত্যাগের মধ্যদিয়ে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছিল।

১০ নভেম্বর ঢাকা অবরোধের দিন বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ এবং পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে ঢাকার রাজপথ কাঁপিয়ে তুলেছিল নূরহোসেন। ৭৫-এর পর ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর নূরহোসেনের বাংলাদেশে গণতন্ত্র মুক্তি পায়। সেই গণতন্ত্র নিয়ে এখন অনেকে নানা প্রশ্ন তুললেও নূরহোসেনের রক্ত আমাদের নতুন করে গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শিখিয়েছে। ১০ নভেম্বর আজ নূরহোসেন দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এই দিবসে আমার দেখা কিছু স্মৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমার বলতে বরিশালের ছাত্রজনতা এবং ঢাকার অবরোধের স্মরণযোগ্য অংশ। অনেক তথ্য হয়তো স্মৃতিতে নেই। আমার এর সঙ্গে কারো কারো নাম ব্যবহার করা হয়েছে। অনেকে এই আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে থাকার পরও তাদের অনেকের নাম বাদ পড়েছে। এটা আমার অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি। তারপরও চাইব পরবর্তী সময় ১০ নভেম্বর নূরহোসেন দিবস নিয়ে যারা লিখবেন তারা আমার ভুলগুলো সুধরে সমৃদ্ধ লেখা লিখবেন।

স্বৈরাচার পতনে সারা দেশের মতো বরিশালেরও অনন্য অবদান রয়েছে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বরিশালে জোট গঠন করে আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। গণতন্ত্রকামী সব দল ওই জোটের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। উত্তাল সেই আন্দোলনের এক পর্যায়ে কেন্দ্রীয়ভাবে ডাক দেওয়া হয় ঢাকা অবরোধের। ১৫ এবং ৭ দল মিলে ২২ দলের কর্মসূচি স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন ঘটাতে ‘ঢাকা অবরোধ’। ১০ নভেম্বর ঢাকা অবরোধ করার জন্য ৮ ও ৯ নভেম্বর সারা দেশ থেকে ঢাকা অভিমূখে যাত্রা করে ছাত্রজনাত, রাজনৈতিক নেতাসহ সাধারণ মানুষ। অন্যান্য আন্দোলনের মতো ১০ নভেম্বর ঢাকা অবরোধে বরিশালের ভূমিকা নি:সন্দেহে উজ্জ্বল।

৯ নভেম্বর বরিশাল থেকে ঢাকা অবরোধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়। কিন্তু ঢাকা যাবে কিভাবে? আগেভাগে সেনা-পুলিশ মিলে ঢাকা যাওয়ার সব পথ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এই বাধা দমাতে পারেনি বরিশালকে। সেনাবাহিনী এবং পুলিশেরর বাধা সত্বেও সেদিন ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের তখনকার রাজহংস লঞ্চটি ঠিক করা হয় অবরোধকারীদের ঢাকা নিয়ে যাওয়ার জন্য। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে লঞ্চ দিতে রাজী হন রাজহংস কর্তৃপক্ষ। নিঃসন্দেহে তারাও এই আন্দোলনে অংশিজন হয়েছিলেন।

এদিকে অবরোধ প্রতিহত করতে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয় সেনাবাহিনী ও পুলিশ। দেশের সব বাস টার্মিনালে সঙ্গে বরিশাল বাস টার্মিনালও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ৯ নভেম্বর বরিশাল ঘাট থেকে কোন লঞ্চ ছাড়তে দেওয়া হয়নি। অবস্থা বেগতিক দেখে রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশে রাজহংস লঞ্চটি কীর্তনখোলার অন্য তীরে চরকাউয়ায় নোঙর করা হয়। 

দুপুরের পর খালি লঞ্চটি নগরের প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে বেলতলা এলাকায় নেওয়া হয়। তখন সেখানে কোন পন্টুন ছিল না। ছাত্রনেতাসহ সকলকে বেলতলা থেকে লঞ্চে উঠতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে কে কোথা থেকে, কিভাবে যাবে তা জানা ছিল না। তখন তো যোগাযোগ ব্যবস্থার এত জাগরণ ঘটেনি। ছিল না মুঠোফোন। টেলিফোন থাকলে তার ব্যবহার করতে পারতেন কিছু সংখ্যক মানুষ। তারপরও সবার কাছে খবর পৌঁছে যায়। আমি তখন বরিশাল কলেজের (বর্তমানে সরকারি) ছাত্র। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের একজন্য সদস্য। সদর রোডের আসাদ ম্যানসনের তৃতীয় তলায় চারণ চলচ্চিত্র সংসদ, তখনকার চারুকলা বিদ্যালয়ে থাকতাম। আমার কাছে কে সংবাদ দিয়েছিল মনে নেই। বিকেলে রুমে ফিরে রাতের জন্য রান্না করা খাবার ফেলে পাতিল উপুর করে রেখে পায়ে হেঁটে বেলতলার দিকে যাত্রা শুরু করি।

সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বেলতলা গিয়ে দেখতে পাই রাজহংস লঞ্চটি নোঙর করা। অনেক যাত্রী তাতে উঠে পড়ছে। এক হাঁটু কাদাপানি ঠেলে আমিও তাদের একজন হয়ে উঠে পড়লাম লঞ্চে। লঞ্চে উঠে দেখতে পাই আমি একা নই, আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ, ন্যাপ, ওয়ার্কার্স পার্টি, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রমৈত্রীসহ অন্যান্য সংগঠনের প্রায় এক হাজার নেতা-কর্মী। দেখা হয় ছাত্র ইউনিয়নের সাঈম হামিম, হুমায়ুন কবির লালু (বর্তমানে মৃত)সহ অনেকের সঙ্গে। লঞ্চে যারা আগে উঠেছে তারা প্রত্যেকেই প্রস্তুতি নিয়েই উঠেছে। বিষয়টি কেবল আমারই জানা ছিল না।

জ্যোৎস্না রাত। লঞ্চ ছেড়ে দিল ঢাকার উদ্দেশ্যে। তখনও জানি না ঢাকায় কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিবিসি থেকে সংবাদ প্রকাশ করা হয় ঢাকা অবরোধের জন্য বরিশাল থেকে ফেরি নিয়ে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করেছে একদল অবরোধকারী। এ সংবাদের পর ভিতরে একধরণের উদ্দীপনা কাজ করছিল। মনের ভিতর ভয় বলতে কিছুই ছিল না। মনে হচ্ছিল যুদ্ধে যাচ্ছি তারুন্যদ্বীপ্ত একদল যোদ্ধা।

লঞ্চে থাকা রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আলহাজ¦ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, তখনকার ছাত্র নেতা শহীদ খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, একেএম জাহাঙ্গীর, হিরণ কুমার দাস মিঠু, শংকর আচার্য, আবুল কালাম আজাদ, আবুল বাসারসহ অনেকে। এর বাইরে যারা ছিলেন তাদের অনেককেই আমি সেভাবে চিনতে পারিনি।

রাতে আমাদের ব্রিফ দেয়া হল। কি কি করতে হবে আর কি কি করতে হবে না। সারা রাত  জ্যোৎ¯œার আলোতে না ঘুমিয়ে কাটালাম সবাই। ভোর রাতে রাজহংস গিয়ে বুড়িগঙ্গায় ঢাকা নৌবন্দরের কাছাকাছি পৌঁছায়। নৌবন্দরে পৌঁছার আগেই আমাদের লঞ্চটি সেনাবাহিনীর টহল স্পিটবোট ঘিরে ফেলে। ভাবলাম আমরা সবাই বোধ হয় আটক হয়ে গেলাম। কিন্তু না আটক নয়, তবে কোনভাবেই ঢাকা নদীবন্দরে (ঘাটে) ভেড়ানোর অনুমতি পাওয়া গেল না। বাধ্য হয়ে মাঝখানে নোঙর করে রাখা হয় লঞ্চ।

এসময় সব দলের নেতারা সিদ্ধান্ত নেন ঢাকায় নয়, যেতে হবে কেরানীগঞ্জ। একজন দুইজন করে ঢাকা সদর ঘাটের বিপরীত তীর কেরানীগঞ্জে যেতে হবে। কেরানীগঞ্জ থেকে একইভাবে নদী পাড় হয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে হবে ঢাকা নৌবন্দরে। তবে দল বেঁধে পাড় হওয়া যাবে না। এমনকি রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময়ও একত্রে হাঁটা যাবে না। পরামর্শ অনুযায়ী আমরা একজন দুইজন করে লঞ্চ থেকে নৌকাযোগে কেরানীগঞ্জ যাই। সেখান থেকে আবার একই কৌশলে পাড় হয়ে ঢাকা সদরঘাট টার্মিনালে পৌঁছাই। তখনকার বুড়িগঙ্গায় ময়ূরপঙ্খী (বিশেষ নৌকা) আমাদের এভাবেই পাড় করে দেয়।

সদরঘাট নৌবন্দর ছাড়িয়ে রাস্তায় নেমে দেখতে পাই সমস্ত রাস্তা ফাঁকা। কিস্তু ফুটপাথ দিয়ে গুলিস্থানের দিকে হাঁটছে মানুষ। মনে হচ্ছিল প্রাতভ্রমণে বেড়িয়েছে মানুষ। মানুষের এই নিরব মিছিল যে অবরোধ করার জন্যই যাচ্ছে তা বোঝার কোন উপায় ছিল না। মনে হচ্ছিল সবাই যার যার আপন মনে হাঁটছে। আমরাও হাঁটছি। হাঁটতে হাটতে যখন গুলিস্থান ছাড়িয়ে পল্টনের দিকে যাচ্ছি, তখন ফুটপাথ ধরে হাটার মানুষের মিছিল অনেকগুন বেড়ে গেছে। 

কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল উৎসুক জনতা কি হচ্ছে, কি হবে তা দেখার জন্যই ফুটপাথ ধরে হাঁটছে। এরই মধ্যে এই পথচারিদের পুলিশ মাঝে মাঝে ধাওয়া দিচ্ছে। হঠাৎ এক ধাওয়ায় আমরা দৌড়াতে শুরু করি পেছনের দিক। একটি বড় গেট টপকিয়ে এক বাড়ির মধ্যে আশ্রয় নেই। এসময় বন্ধু হামিমের পায়ে সজোরে পুলিশের লাঠির আঘাত লাগে। কোনমতে ওকে নিয়ে ওই বাড়িতে আশ্রয় নেই। এবার আর বাড়ির ফটক টপকাতে পারছিলাম না। বাড়ির মালিক পরে ফটক খুলে আমাদের বের হতে সুযোগ করে দেন।

সড়কের ফুটপাথ ধরে আবার হাঁটা শুরু করি। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে খেয়ে পণ্টন মোড়ে ফুটপাথেই দাঁড়িয়ে পড়ি আমরা পাঁচজনসহ অনেক মানুষ। কি করবো ভেবে উঠতে পারছিলাম না। মনের মধ্যে নানা শঙ্কা থাকলেও কারো মধ্যে ভয় ছিল না। সবার মধ্যে একটা উদ্দেশ্য যুদ্ধ জয় করে ফিরতে হবে। স্বৈরাচারী সরকারকে যেকোনমূল্যে হটাতে হবে। কিন্তু ফুটপাথ দিয়ে হাঁটা এত মানুষের কারো হাতে কোন অস্ত্র নেই, লাঠি নেই। তাহলে কি দিয়ে আমরা ঢাকাসহ স্বৈরাচারী সরকারকে অবরোধ করবো? এমন চিন্তাও মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
কয়েক মুহূর্ত পর আমাদের চিন্তার অবসা ঘটে। দেখতে দেখতে হঠাৎ একটি মিছিল পল্টন মোড়ে এসে থামে। প্রত্যেকের হাতে লাল পতাকা বাঁধা বাঁশের লাঠি। এই মিছিলের অগ্রভাগে খালি গয়ে ঝাকরা চুলের দীর্ঘ দেহী এক যুবককে দেখতে পাই। পড়নে নীল জিনস প্যান্ট, গায়ের লাল শার্টটি কোমরে বাঁধা। বুকে পিঠে সাদা রং এ লেখা রয়েছে একটি কালজয়ী শ্লোগান ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। এতক্ষণ যাদের উৎসুক জনতা মনে হয়েছিল ওই মিছিলটি আসার সঙ্গে সঙ্গে সবাই সেই মিছিলে একাকার হয়ে যায়। আমরাও মিশে যাই মিছিলের মধ্যে। কোন সময় যে প্রত্যেকের হাতে বাঁশের লাঠি এবং লাল পতাকা চলে আসছে বলতে পারব না। কে বা কারা দিয়েছে এতো বাঁশ ও পতাকা সেটা আমদের জানার কথা না। তবে এটা যে তখনার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের জোটের কাজ সেটা বুঝতে কষ্ট হয়নি।

এক মুহূর্তে পুরো পল্টন এলাকা মিছিলকারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। চলতে থাকে এরশাদ বিরোধী বিভিন্ন শ্লে¬াগান। তখন আমার সহযোদ্ধারদের বলেছিলাম, ‘আজ যদি এখানে মারাত্মক কোন ঘটনা ঘটে তাহলে ওই লোকটার জন্যই ঘটবে’। হলোও তাই। তখনও আমরা জানতাম না ওই যুবকের নাম নূরহোসেন। পরের দিন পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি ওই যুবকের নাম নূরহোসেন। বন্দুকের গুলি বুক বিদীর্ণ করা দীর্ঘদেহী যুবকটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আমাদের কয়েক গজ সামনে। এর আগ পর্যন্ত আমরা তাঁর তেজ দেখেছি। আবার নিথর দেহটি টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেতেও দেখেছি। যদিও ততক্ষণে পুরো মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, পুলিশের গুলি আর কাঁদানে গ্যাসের তোড়ে।

সেদিন বিএনপি সমর্থিত নেতা-কর্মীরা পণ্টন পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারেননি। তখন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে অবরোধে যোগ দিতে আসা নেতা-কর্মীদের শাপলা চত্বরে আটকে দেয় পুলিশ। তারা সেখানে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করতে থাকেন।

এদিকে পল্টনে বেশ কিছুক্ষণ এরশাদ বিরোধী মিছিল ও শ্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। যার শব্দ পৌঁছে যায় পুরো ঢাকা নগরে। বাড়তে থাকে মানুষের ঢল। এক পর্যায়ে পুরো পণ্টন এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। মিছিল চলতে থাকা অবস্থায় তখনকার আওয়ামী লীগ নেত্রী (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনা একটি খোলা মাইক্রোবাসে পন্টনের ওই সমাবেশে উপস্থিত হন। মাইক্রোবাসটি জনসমুদ্রে ঢাকা পড়ে যায়। ওই জনসমুদ্রে মাইক্রোবাসে দাঁেিড়য় হাত মাইকে সংক্ষিপ্ত একটি বক্তৃতা দেন। শ্লোগানের মধ্যে তার বিষয়বস্তু স্পষ্ট বোঝা যায়নি। বক্তৃতা দিয়ে তিনি চলে যান। শেখ হাসিনাকে বহনকারী গাড়িটি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বিশাল মিছিল যাত্রা শুরু করে। ওই মিছিলের অগ্রভাগে নূরহোসেন। মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে মিছিলের প্রথম সারি নূরহোসেনদের। ঠিক তার পেছনের সারিতে অন্যান্যদের সঙ্গে বরিশালের হুময়ুন কবির লালু, সাঈম হামিম, আমিসহ ৫ ছাত্র ইউনিয়নকর্মী হাতে হাত ধরে এগিয়ে চলেছি।
মিছিলটি পল্টন থেকে বাইতুল মোকাররম মসজিদের দিকে এগোতে থাকে। বাইতুল মোকাররমের সম্ভবত দক্ষিণ গেট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। এর মধ্যে ব্যাপক টিয়ার শেল ও গুলি শুরু হয়। গেট ছাড়িয়ে সামনে যেতেই নূরহোসেনকে লক্ষ করে সরাসরি গুলি চালানো হয়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নূরহোসেন। চোখের সামনে দীর্ঘদেহী একটি নক্ষত্র লুটিয়ে পড়তে দেখলাম মাটিতে। 

মুহূর্তের মধ্যে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমরা ৫জন বাইতুল মোকাররমের গেট টপকে ভিতরে শুয়ে পড়ি। কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় তাকাতে পারছিলাম না। তাৎক্ষণিক বাঁশের মাথায বাঁধা লাল কাপড়টি খুলে মসজিদের লেকের পানিতে ভিজিয়ে চোখ মুছে ফেলি। আশ্রয় নেই বাইতুল মোকাররম মসজিদে। এক পর্যায় মসজিদ চত্বরে পুরানো কাগজে আগুন জ¦ালিয়ে কাঁদনে গ্যাস থেকে রক্ষা পাই।

অনেক সময় মসজিদ কমপ্লেক্সের ভেতরে ছিলাম। সেখানে বসেই জানতে পারি আজ ঈদে মিলাদুন্নবী। মিলাদুন্নবীর কর্মসূচিও ছিল বায়তুল মোকাররম মজজিদ এলাকায়। সেসব কর্মসূচি বিক্ষোভে ঢাকা পড়ে যায়। তাদের অনেকেই অংশ নেন এরশাদ বিরোধী ওই আন্দোলনে। সব দোকানপাট বন্ধ থাকলেও মসজিদ কমপ্লেক্সের মধ্যে একটি দোকানী সিঙাড়া তৈরি করছিল। আমাদের আহার বলতে সেদিন ওই সিঙাড়াই ছিল।

আমাদের সঙ্গে যারা মসজিদের মধ্যে ছিল তারা সবাই আস্তে আস্তে সড়কে বেড়িয়ে পরি। এরপর শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে অবরোধকারীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। দিনব্যাপী ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় যে ভোবে পারছে অংশ নিয়েছে। ঢাকার হকার, টোকাই থেকে শুরু করে কেউই বাদ যায়নি। ইটের যোগন হয়েছে পল্টনসহ আসপাশের সড়কের ডিভাইডার। সড়কের ডিবাইডারের ইট অবরোধকারীরা ভেঙে পুলিশের উপর নিক্ষেপ করতে থাকে। সড়কের দুই পাশের কোন বাড়ি ও অফিসের গ্লাস আস্তো ছিল না।

সবার ভেতর রক্ত টগবগ করছে। এরশাদকে যেভাবেই হোক গদি ছাড়তে বাধ্য করা হবে। তাই আক্রমণ করতে হবে সচিবালয়ে। সেই মত প্রস্তুত সবাই। কিন্তু সচিবালয়ে ঢুকবে কিভাবে। সব গেট তো বন্ধ। এরই মধ্যে হঠাৎ কয়েকজন একটি টেলিফোনের খুঁটি (খাম্বা) কাঁধে নিয়ে সচিবালয়ের গেটে সজোরে ধাক্কা মারতে থাকে। চলতে থাকে ভাঙচুর, অগ্নি সংযোগেরও ঘটনাও। তবে কিছু সংখ্যক দুষ্ট মানুষ না জেনে বুঝেও অগ্নিসংযোগ করেছে। যা অবরোধকারীদের কাম্য ছিল না। এভাবে চলে সারাদিন। তবে কত লোক আটক হয়েছে এবং নূরহোসেন ছাড়া অন্য আর কারা মারা গেছে কিছুই জানতে পারিনি। অন্ধকার নামার পর আমরা ৫জন বাংলা বাজার এলাকায় সম্ভবত সাঈম হামিমের খালার বাসায় যাই। সেখানেই রাতের খাবার সেরে রাত কাটাই। কিন্তু মনের মধ্যে অজানা আশঙ্কা। এরশাদ তো বহাল তবিয়তেই আছে।

১১ নভেম্বর খুব সকালে রাস্তায় বেরিয়ে পত্রিকায় চোখ বুলাই আমরা সেই পাঁচজন। পত্রিকা খুলেই চোখ আটকে যায় একটি ছবির প্রতি। ছবিটি বরিশালের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা সাইদুর রহমান সবুজের। পত্রিকায় লেখা হয়েছে সাইদুর রহমান সবুজ নিহত হয়েছেন। ওই ছবি দেখে পাঁচজনই বাংলা বাজার থেকে দৌড় শুরু করি। এক দৌড়ে পল্টনে কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে যাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি সবুজ মারা যাননি। ১০ নভেম্বরে পুলিশের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার সময় সাইদুর রহমান সবুজের আইডি কার্ড রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। ওই ছবি পেয়ে সেটি ছাপানো হয়েছিল মৃত বলে। আমরা সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচি। অবশ্য ততক্ষণে ঢাকা ও বরিশালে সাইদুর রহমান সবুজের জন্য গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
১০ নভেম্বর ঢাকা অবরোধ পুরো আন্দোলনে ছাত্ররা ছিল অগ্রভাগে। অনেক নেতাদেরই সেখানে দেখা যায়নি। পরদিন বরিশালের অনেক নেতার মুখে আমরা এরকম গল্পও শুনেছি, ‘আমরা ২৪ তলায় বসে দেখছিলাম অবরোধ ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া’। তখন পল্টনে ২৪তলা ভবনের নির্মাণ কাজ চলছি। তাদের নাম আজ আর বলে ছোট করতে চাই না। তাদের ২/১জন লোকান্তরিতও হয়েছেন। ছাত্র জনতার এই আন্দোলনে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখে দেশের সাংস্কৃতিক ও নাট্য কর্মীরাও। চিত্র শিল্পী কামরুল হাসানের মৃত্যুর ১০ মিনিট পূর্বের সেই কালজয়ী কাটুর্ন ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’। আন্দোলনকে আরও বেগবান করেছে। সারা দেশের গণসংগীত এবং নাটক স্বৈরাচার পতনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় স্বৈরাচারী এরশাদ। 

আজ আমরা গণতন্ত্রের পথে হাঁটছি। যদিও মাঝে মাঝে হোঁচটও খাচ্ছি। সত্যিকার গণতন্ত্র মুক্তি পাক এবং স্বৈরাচারী সকল কর্মকান্ড নিপাত যাক এটাই আমাদের একান্ত কামনা। ছাত্র সমাজকে গণতান্ত্রিক ধারায় আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। আন্দোলনের মাধ্যমেই দেশকে সমৃদ্ধির শিখরে নেওয়া সম্ভব। স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আমদের নূরহোসেনদের অবশ্যই স্মরণ করতে হবে। আজকের এই দিনে নূরহোসেন, ডা. মিলনসহ স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যারা আত্মত্যাগ করেছেন তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। ১০ নভেম্বর গণতন্ত্রের নবযাত্রার দিনে নূরহোসেন তোমায় সেলাম।