পঞ্চাশে পরিপূর্ণ বাংলাদেশ

১৯৭১। একটি আঙুল, একটি আহ্বান। মুক্তিসংগ্রামের অভিযান শুরু। পক্ষে ৭ কোটি বাঙালি। বিপক্ষে পাকিস্তানী বাহিনী ও বাংলার জমিনের কিছু কলঙ্ক তিলক। ২৭১ দিনের জীবনপন যুদ্ধ। বাঙালির অমিত সাহস এবং দৃঢ়তায় পরাজিত হয় পাকিস্তানী বাহিনী। আমরা অর্জন করি আমাদের লাল-সবুজের মানচিত্র ও পতাকা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন আমাদের স্বাধীনতা। অসাম্প্রদায়িক চিন্তার ফসল ২৬ মার্চের অর্জন মহান স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হয়েছে।
সুবর্ণ জয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমাদের লাল-সবুজের অহংকারের ৫০ বছর। আজকের এই পূণ্যভূমির পঞ্চাশে স্বাগত জানাই, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা, ৩০ লাখ শহীদ ২ লাখেরও বেশি মা-বোনের আত্মত্যাগের প্রতি।
দিনেও অন্ধকার নেমেছিল বাংলাদেশে। পুরো বাংলাদেশটাকে অন্ধ গহ্বরে নিয়ে গেছিল। তাই কখন দিন আর কখন রাত তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল না। ২৪ ঘন্টা কেবল অন্ধকারে আলোর সন্ধান করে চলেছিল বাঙালি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া সেই অন্ধকার দূর করতে ৯ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে রক্ত, আর রক্ত দিয়ে মাতৃভূমির ঋণ শোধ করতে প্রাণপণ চেষ্টা। শরীরের রক্তে মায়ের আঁচল রঞ্জিত ছিল ৯মাস। কেবল শহীদ নয়, সম্ভ্রম ও আত্মত্যাগ করতে হয়েছে অসংখ্য মা-বোনদের।
এই বাংলাদেশ কারো দানে পাওয়া নয়। রক্ত দিয়ে লেখা নাম বাংলাদেশ। সন্তান হারানো মায়ের নাম বাংলাদেশ। ৩০ লাখ শহীদের অপর নাম বাংলাদেশ। ২ লাখের বেশি বা-বোনের আত্মত্যাগের নাম বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশের আজকের সূর্যের ঝিলিক বাংলাদেশকে আরো উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। কারণ আজ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশের পঞ্চশ পূর্ণ হয়েছ। তাই আজকের রোশনাই ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। এই সূর্যের আলো আমাদের শত বছরের দ্বারে নিয়ে যাবে। যাবে শহ¯্রাব্দতে।
এত অর্জনের মধ্যেও আমাদের মনের আকাশে কালো মেঘের ছয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা এখনও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির উত্থান দেখছি। দেখছি ধর্মের নামে বিভেদ সৃষ্টি করে মানুষ হত্যার নগ্নতা। ধর্মীয় মৌলবাদী চক্র ধর্মকে ব্যবসা হিসেবে নিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষদের বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। এর সঙ্গে নতুন একটি আইনের যাতাকলে পিষ্ঠ হচ্ছে দেশের মুক্তমনা লেখক, সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আশ্রয়ে বাড়ছে নির্যাতন। সবমিলে যখন আমরা সুবর্ণজয়ন্তি পালন করছি সেই সময়ে এই কালো মেঘগুলো দূরে ঠেলে দেওয়া একান্ত জরুরী। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বপ্নের সোনার বাংলার সত্যিকার রূপ খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে যাতে সংকীর্ণ চিন্তা থেকে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তীর এই সুন্দর সময় আবারো লাল-সবুজের জমিনে কলঙ্কের ছাপ এঁকে দেবার জন্য সেদিনের পরাজিত শক্তিরা নখড় বিস্তার করছে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশে পূণরায় যেন ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীর উত্থান না ঘটে সেদিকে নজর দিতে হবে। তাহলে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী সার্থক হবে। তা না হলে আবারো আমরা পেছনে সেই গুহার গহ্বরে তলিয়ে যাবো। সেটা কোনভাবেই কাম্য নয়।
৭১-এর শিশু বাংলাদেশ। আজকের পরিপূর্ণ বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ গড়ে তুলতে দেনি যারা রক্ত, সম্ভ্রম ও জীবন উৎসর্গ করেছে তাদের প্রতি নিরন্তর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সেই সঙ্গে এখনো যেসব মুক্তিযোদ্ধা-বীরাঙ্গনারা বেঁচে আছেন তাঁদের জন্য ৫০ বছরের বাংলাদেশের স্বাগত সম্ভাষণ। আর যারা আমাদের স্বপ্নের বাংলদেশকে সুবর্ণ জয়ন্তী পর্যন্ত নিয়ে আসতে রিলসভাবে কাজ করেছেন তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে কেন জানি না আবার জাতীয় সঙ্গীতের সেই লাইনটি বারবার মস্তিষ্কে আন্দোলিত হচ্ছে, ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি...’। মায়ের মুখ যেন মলিন না হয়, তাহলে আমরা নয়ন কেবল জলে ভাসতেই থাকবো। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে যেন সেই চিত্র দেখতে না হয়।