প্রতিক্রিয়া

প্রতিক্রিয়া

আজ ভোর হলো ‘এ তো রাগ নয়, এ যে অভিমান’ পড়তে পড়তে। ‘এ তো রাগ নয়, এ যে অভিমান’ গতকালের ভোরের আলো দৈনিকের একটি লেখার শিরোনাম।  লেখক আজমল হোসের লাবু। অভিনেতা, বাচিকশিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক আজমল হোসেন লাবু। লাবুর লেখা এর আগে আর পড়া হয়নি। একদিন কোনো মঞ্চে শুনেছিলাম ওর নিজের কবিতার স্বকণ্ঠ আবৃত্তি। না, তেমন মনে রাখার মতো কিছু না। কিন্তু ‘এ তো রাগ নয়, এ যে অভিমান’ মনে রাখার মতো লেখা, মনে দাগ কাটার মতো লেখা। পড়ছিলাম, আর মনে হচ্ছিল, কে রোধে কাকে সত্যভাষণ উচ্চারণে? সত্য উচ্চারিত হোক সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। মনে রাখা জরুরি ‘সত্য, সত্যের মতো সত্য’। তাইতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উচ্চারণ ‘সত্য যে কঠিন, তাই কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’। সত্যকে ভালোবাসার এই-তো সময়। লোভ লালসা মোহ আকাঙ্খা কিংবা বিভ্রান্তি যাদের সত্য থেকে দূরে সরিয়ে নেয়, বোধকরি তাদের উদ্দেশ্যেই আজমল হোসেন লাবুর এই সোচ্চার উচ্চারণ। লাবুকে অন্তরের শ্রদ্ধার্ঘ। এই শ্রদ্ধা ব্যক্তি লাবুকে নয় ‘এ তো রাগ নয়, এ যে অভিমান’-এর লেখক আজমল হোসেন লাবুকে।

লেখাটা পড়ে প্রথম অনুভূতি, লেখার শিরোনাম ‘এ তো রাগ নয়, এ যে অভিমান’ ঠিক লেখার বিষয়বস্তু, ভাষাপ্রয়োগ আর শেষে জঙ্গলবাসী নিরিহ প্রাণির প্রতীকী মিছিলের সঙ্গে যেনো বেমানান। ‘ভালো হতো, আরো ভালো হলে’। হতে পারত ঘৃণা বা ধিক্কার জাতীয় কোনো শব্দ যুক্ত কোনো শিরোনাম। কারণ ‘রাগ’ আর ‘অভিমান’তো ভালোবাসার মানুষদের জান্য, কাছের মানুষদের জন্যে, আদর্শিক নৈকট্যের মানুষদের জন্যে। যাদের সম্বন্ধে এই লেখা তাঁরা কতটুকু আপন বা কাছের বা আদর্শের কাছাকাছি, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। সেবিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বোধকরি আর খুব বেশি সময় লাগবে না। যাক সে কথা। 

ওই লেখার কেবল একটি বিষয় নিয়ে দু’চারটি কথা বলার এই প্রয়াস। ‘এ তো রাগ নয়, এ যে অভিমান’ লেখায় একটি সংক্ষিপ্ত শব্দচয়ন আছে এভাবে ‘ব.সা.স.স.প.’। হয়ত বলা হবে ‘অক্কেলমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ঠ’। কম অক্কেলমানদের বলি, এর পুরো বাক্যবিন্যাস ‘বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদ’, সংক্ষেপে ‘সমন্বয় পরিষদ’ নামেই এর পরিচিত। 

এটি হঠাৎ গড়ে ওঠা কোনো সংগঠন নয়। এর পেছনে আছে এক কঠিন সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতা। আছে অন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পর ক্ষমতাসীন প্রথম সামরীকজান্তা জেনারেল জিয়াউর রহমান হাজার বছরের বাঙালি জাতিসত্ত্বার ঐতিহ্য মুছে দিয়ে প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার সংস্কৃতিকে স্তব্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নানা ফন্দি-ফিরিক্কি করে সকল সংস্কৃতিচর্চাকে শিল্পকলা একাডেমির নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করেন। বিলুপ্ত করে দেন জেলা পর্যায়ের শিল্পকলা একাডেমির গণতান্ত্রিক ধারাসমূহ। গোটা জাতি নিক্ষিপ্ত হয় ‘বাঙালি’ না ‘বাংলাদেশী’র গোলক ধাধায়। মজা লোটে ধর্মব্যবসায়ী উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। এক জেনারেলের পর ক্ষমতায় বসেন আর এক  জেনারেল। জেনারেল হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ। তিনি হাত দিলেন শিক্ষক সংগঠনের ওপর। গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন’। এর সভাপতি হলেন তিনি (রাষ্ট্রপতি) নিজে এবং মহাসচিব হলেন দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা মান্নান। মাওলানা মান্নানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে একটি কুচক্রী মহল। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮-এ ৭ জুন বাংলাদেশ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানে সংযুক্ত হয় রাষ্ট্রধর্ম (১৯৮৮-এর ৭জুন)। যা সংবিধানের পঞ্চম (১৯৭৯-এর ৫ এপ্রিল), ষষ্ঠ ( ১৯৮১-ও ৮ জুলাই) ও সপ্তম ( ১৯৮৬-এর ১০ নভেম্বর) সংশোধনীর ধারাবাহিকতারই ফসল। এই চার সংশোধনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন বাংলাদেশের মূল চারনীতির (গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাদ) কবর রচনা করা হয়। সংবিধানে সংযুক্ত হয় ‘বাঙালি’ জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে ‘বাংলাদেশী’ জাতীয়তাবাদ। গৃহীত হয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না, এমন ‘ইনডিমনিটি আইন’। লাখো শহীদের রক্ত আর মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মূল চেতনাকে ঘুরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় মেতে ওঠে দুই সামরিক জান্তা। প্রকারান্তরে ১৯৪৭-এর দ্বিজাতি তত্ত্বের দিকেই মুখ ফেরানোর অপচেষ্টায় মেতে ওঠে উগ্র ধর্মীয় রাজনীতিকগোষ্ঠী।
 
আগেই বলা হয়েছে ‘সত্য প্রতিষ্ঠার কথা’। তাই এদেশের সত্য সন্ধানী সচেতন সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নিশ্চুপ বসে থাকেন না, থাকতে পারেন না। কাজ করেন প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে- সাবধানে, সন্তর্পনে। ভাবেন রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি নিয়ে। ১৯৮৩-র  ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে আহবান করা হয় সারাদেশের প্রগতিশীল সাস্কৃতিক কর্মীদের একটি সভা। সভা অনুষ্ঠিত ঢাকার পুরানা পল্টনের একটি সভাকক্ষে। সেই সভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিলো দেশের প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত তাবত সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে যুথবদ্ধ করে দেশব্যপী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। ভাগ্যচক্রে সেই সভায় উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিলো বর্তমান প্রতিক্রিয়া লেখকের। সেই সূত্র ধরে বরিশালে যুথবদ্ধ বাঙালি জাতীয় চেতনার ভিত্তিতে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ২৬ মে ১৯৮৩ইং তারিখ বরিশাল অশ্বিনী কুমার হলে বরিশালের সমমনা সাংস্কৃতিক সংগঠন-প্রতিনিধিদের একটি সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সংগঠনের নাম ‘বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদ’ নির্বাচন করে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আহবায়ক নির্বাচিত হয় জ্যেষ্ঠ সাংস্কৃতিক-সংগঠক জনাব সেলিম আহমদ। যুগ্ম সম্পাদক হন বর্তমান প্রতিক্রিয়া লেখক, তার ওপরই দায়িত্ব দেওয়া হয় সংগঠনের সংবিধান রচনার। এভাবেই ‘বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদ’-এ যাত্রা শুরু। স্মরণ রাখা জরুরি, ঢাকা কিংবা বাংলাদেশের কোনো জেলায় তখনো কোনো সাংস্কৃতিক জোট কিংবা সাংস্কৃতির যুথবদ্ধতা গড়ে ওঠেনি। আবার বরিশালবসী অহংকার করে বলতে পারে,  ‘হোয়াট বরিশাল থিঙ্কস্ টু-ডে, বাংলাদেশ থিঙ্কস্ টু-মরো’।

১৯৮৩ থেকে ২০২০, দীর্ঘ সাইত্রিশ বছর। না, এই দীর্ঘ সময়ে ‘বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদ’ কখনো তার আদর্শ লক্ষ্য থেকে চুল পরিমাণ বিচ্যুত হয়নি। সমাজ প্রগতির পক্ষে সমসাময়িক সকল আন্দোলন সংগ্রামে ‘সমন্বয় পরিষদ’ পালন করেছে চালিকা শক্তির ভূমিকা। এই যে বরিশালের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। এই শহীদ মিনার নির্মাণে ‘সমন্বয় পরিষদ’-এর ভূমিকা এক জীবন্ত ইতিহাস। বরিশালের ঐতিহ্য রক্ষার সকল আন্দোলন সংগ্রামে ‘সমন্বয় পরিষদ’ সবার আগে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১২-সলের ৩ জুলাই অশ্বিনী কুমার দত্তের নামে বরিশাল কলেজের নামকরণ করার দাবীতে বরিশাল জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি স্মারকলিপি দেয় সমন্বয় পরিষদ। সেই চলমান অন্দোলন আজও বহমান। 

কিন্তু পত্রিকার ছবিতে কী দেখলেন আজমল হোসেন লাবু।  কী শুনালেন তার ‘এ তো রাগ নয়, এ যে অভিমান’ লেখায়। কিসের অভিমান? তিনি যা লিখেছেন তাতে ‘অভিমানে’র প্রেমের সুর বড়ো বেমানান। এতো ক্ষোভ, ধিক্কার আর ঘৃণার বিষয়। কিংবা আত্মসুদ্ধির এক সুযোগের আহবান। ‘সমন্বয় পরিষদ’কে বেছে নিতে হবে যথার্থ সত্যক। সত্যকে সত্য বলে জানতে হবে, মানতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে ২০১২ না ২০২০? কোনটা সত্য! ‘সমন্বয় পরিষদ’-এর একজন সাবেক কর্মী হিসেবে দৃৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করতে চাই ২০২০ নয়, ২০১২ সত্য। সে সত্য যত কঠিনই হোক তাকে ভালোবাসতে হবে। তাকে গ্রহণ করতেই হবে। তা না হলে ভবিষ্যৎই অস্তাকূড়ে নিক্ষেপ করবে ‘সমন্বয় পরিষদ’-এর ভ্রান্ত সিদ্ধান্তধারীদের। তার জন্য প্রস্তুুতির প্রয়োজন হবে না। শুধু মনে করিয়ে দেওয়া ‘অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না’।

সবশেষে আজমল হোসেন লাবুর ‘রাগাভিমানের’ সমাপ্তি গল্পের প্রতিক্রিয়া গল্প: ‘কোনো বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে ছাত্র পড়াচ্ছেন এক শিক্ষক। এক পর্যায়ে তিনি শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলোতো, গরু আর গাধার মধ্যে তফাৎ কী’? এক ছাত্র সিদা দাঁড়িয়ে মাথা উচু করে বললো, ‘স্যার, গরু খাওয়া যায়, গাধা খাওয়া যায় না’।


এ তো রাগ নয়, এ যে অভিমান