বাজেটে পরিবার পরিকল্পনা খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে

কোভিড -১৯ স্বাস্থ্য ঝুঁকি হলেও পুরো বিশ্ব এর প্রভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানবিক বিপর্যয় মহামারীর সঙ্কটে পড়েছে। আর এই মহামারীর কারণে স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা কেন্দ্রিক সর্বাত্মক সমস্যায় বাংলাদেশের বাস্তবতায় পরিবার পরিকল্পনা খাতে বাজেট বরাদ্দ, সামর্থ্য বৃদ্ধি এবং বরাদ্দকৃত বাজেটের সঠিক বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিতে হবে।
ওজিএসবির সাবেক সভাপতি রওশন আরা বেগমের মতে, করোনাকলে বেড়েছে ঘরে সন্তান জন্ম দেয়ার হার, সেই সঙ্গে বেড়েছে গর্ভপাতের সংখ্যা। মাসিককালীন স্বাস্থ্য পরিচর্যার ক্ষেত্রেও সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, যার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রয়েছে। এসবের প্রভাব নারী স্বাস্থ্যের উপর পড়েছে তবে ঠিক কতটা পড়েছে তা জানার জন্য যথাযথ গবেষণা করতে হলে প্রয়োজন পর্যাপ্ত বাজেট।
২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়লেও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে জড়িত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, প্রতিবছরের মত বরাদ্দ বাড়লেও পরিকল্পনা অনুযায়ী যথোপযুক্ত ব্যয় হচ্ছে না। অধিদপ্তরের গড় ব্যয়ের হার বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয় ৩১টি অপারেশন প্লানের মাধ্যমে জানুয়ারি ২০১৭ থেকে জুন ২০২৩ মেয়াদে চতুর্থ সেক্টর কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। তার মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ৭টি ওপির প্রাক্কলিত ব্যয় প্রায় ৪৯২৩.৪৮ কোটি টাকা যা সেক্টর কর্মসূচির প্রাক্কলিত ব্যয়ের ১১ দশমিক ৩২ ভাগ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে দেশে জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দ হওয়া উচিত ১৫ ভাগ। কিন্তু বিগত ১০ বছরে আমাদের দেশে বরাদ্দ হয়েছে ৪ থেকে ৬ ভাগ। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপনের সময় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে যে জরুরী সেবা এবং অপ্রত্যাশিত আর্থিক প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, তা মেটাতে এবং অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা পুনরুদ্ধারের কৌশল বিবেচনায় নিয়ে মূলত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুত করা হয়’। করোনা ভাইরাসের কারণে স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা সামনে আসার পর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিলো এ খাতে বরাদ্দ বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায়নি।
স্বাস্থ্য সেবায় এই সময়ের সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ নিরাপদ প্রসব, পরিবার পরিকল্পনা সেবার অপ্রতুলতা, জীবন রক্ষার্থে নিরাপদ গর্ভপাত নিশ্চিতকরণ, প্রযুক্তির ব্যবহার, বাল্যবিবাহ রোধ ও মাতৃস্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করা এবং বর্তমান সময়কে বিবেচনায় রেখে বিকল্প পদ্ধতি প্রয়োগের যথাযথ দক্ষতা অর্জন।
ইউনিসেফের তথ্যমতে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি বিশ্বে প্রায় ৩ লাখ ৭১ হাজার ৫০৪ জন শিশু জন্ম নিয়েছে। যার মধ্যে বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছে ৯ হাজার ২৩৬ জন। আশঙ্কা করা হয় করোনাকালে জন্ম নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ব্যহত হওয়ায় পুরো বছরে প্রায় ২ লাখ ৩৬ হাজার অতিরিক্ত শিশু জন্ম নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ সময় নারীদের মাসিককালীন স্বাস্থ্য পরিচর্যাও নাজুক হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে অর্ধেকই বড়ি বা পিল। আর বাকি অর্ধেকের মধ্যে রয়েছে ইনজেকশন, কনডম, নারী ও পুরুষের বন্ধাত্বকরণ, ইম্প্লান্ট ইত্যাদি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী গত বছরের এপ্রিল-মে মাসে পিল ও কনডমের ব্যবহার প্রায় ৩০ শতাংশ কমে গেছে। স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের পরিমানও ব্যপকহারে কমেছে। এর মূল কারণ করোনা মহামারীতে করোনা ব্যাতিত অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুলতা।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনউইমেনের ‘কোভিড-১৯ বাংলাদেশ: রপিড জেন্ডার আ্যনালিসিস’ শিরোনামে জেন্ডার ইন হিউম্যানিটারিয়ান আ্যকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ নামের জোটের উদ্যোগে গত বছর জুন মাসে প্রকাশিত গবেষণা বলছে, ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ নারী তাদের স্বাস্থ্য পরিচর্যার সামগ্রীর অপ্রতুলতার কথা বলছেন।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে পরিবার পরিকল্পনা খাতে ব্যয় বাড়ালেই হবে না, তা কতটা কার্যকর এবিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে গর্ভবতী মায়েদের সেবায় দেশের ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এএনসি অর্থাৎ প্রসবপূর্ব সেবা এবং পিএনসি প্রসোবত্তর সেবা কর্ণার কার্যক্রম উন্নত করতে মিডওয়াইফসহ দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তুলতে হবে। ঘরে বসে মাতৃ এবং প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চত করতে অ্যাপসভিত্তিক সেবা কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। যার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করতে হবে।
এক সমিক্ষায় জানা গেছে, ঢাকা গাজীপুরের কাপাসিয়ায় গত তিন বছরে মাতৃমৃত্যু হার শূন্যের কোটায় নেমে এসছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজস্ব উদ্যোগে এটি সম্ভব হয়েছে। যা পৃথিবীর ২৭ টি দেশে মডেল হিসেবে প্রদর্শিত হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এমন অনেক নিজস্ব উদ্ভাবন রয়েছে। এগুলোকে এলাকাভিত্তিক প্রয়োজন অনুযায়ী প্রয়োগ করতে হবে এবং আরও নতুন নতুন উদ্ভাবনের সুযোগ তৈরি করতে হবে। বাজেটের সহজলভ্যতা এমন উদ্যোগ গ্রহণ উৎসাহিত করে।
বিশ্ব মহামারীর সময়ে করোনা ভাইরাসের সঙ্গে বৈশ্বিক ও দেশীয় পরিস্থিতিতে মাতৃস্বাস্থ্য ও কিশোরী স্বাস্থ্য বিশেষ করে গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসোবত্তর সময়ের ঝুঁকি নিরসনে কাজ করতে হবে। অপ্রত্যাশিত মহামারীতে পরিবার পরিকল্পনায় অপ্রতুল তথ্যসেবা এবং অপর্যাপ্ত সেবার কারণে গর্ভধারণ ও মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। চাহিদামাফিক গর্ভনিরোধক সরবরাহে ঘাটতি মেটাতে জরুরী ভিত্তিতে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে প্রত্যেক স্থানে প্রয়োজন ও সামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে কার্যক্রম গ্রহণ করা।
উদাহারণস্বরূপ বলা যেতে পারে বাগেরহাট, পিরোজপুর এবং বরিশালে পরিবার পরিকল্পনা সেবার মান উন্নয়নে লোকাল এ্যাম্বুলেন্স ক্রয়, পরিবার পরিকল্পনার সেবার উপকরণ, ইউনিয়ন পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রের সংযোগ সড়ক সংস্কারের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ চার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ করেছে। বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা নিশ্চত করা সম্ভব হয়েছে।
এসকল প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনায় বরাদ্দকৃত বাজেট কার্যকরীভাবে ব্যয় করার জন্য এবং ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে সর্বশেষ উপকারভোগীদের তথ্য, পরিবার পরিকল্পনা উপকরণ, প্রয়োজনে নগদ অর্থ সহজলভ্য করতে সরকারী কর্মসূচিতে বেসরকারি সংস্থার অংশগ্রহণ, প্রচার ও পরিসেবা সম্প্রসারণ করে সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবার মান উন্নয়ন করতে হবে।
পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম আরো গতিশীল করতে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে জোড় দিয়ে বরাদ্দকৃত বাজেট সুষ্ঠু ও যথোপযুক্ত ব্যয়ের লক্ষ্যে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত অংশগ্রহণমূলক মনিটরিং ব্যবস্থায় সার্বক্ষণিক নজরদারী চালু করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বরাদ্দকৃত বাজেটের উন্নয়নমুলক সুষম বণ্টন এবং ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ। এছাড়াও পরিবার পরিকল্পনা খাতকে মূল ধারার বাজেটে মূল্যায়ন করতে হবে। কোভিডের কারণে বরাদ্দ যাতে আরো কমে না যায় সেদিকে খেয়াল রেখে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।