ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই বিদেশ যেতে সমুদ্রযাত্রা

ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই বিদেশ যেতে সমুদ্রযাত্রা

গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কমান্ডার মঈন বলেন, চক্রের মূলহোতা ইসমাইল গত ২০০১-২০০৫ পর্যন্ত মালয়েশিয়া থাকার সময় মিয়ানমারের আরাকানের নাগরিক (রোহিঙ্গা) রশিদুল ও জামালের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। প‌রে ইসমাইল দেশে ফিরে এসে রোহিঙ্গা রশিদুল ও জামালকে নিয়ে ১০-১২ জনের একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। এরপর গত ১০ বছর ধরে মানবপাচারের এই চক্রটি চালা‌চ্ছে। নারায়ণগঞ্জে বসে দেশে-বিদেশে থাকা সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চক্রটি চালিয়ে আসছিল। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।

ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই বিদেশ পাঠানোর ফাঁদ:

কমান্ডার মঈন বলেন, চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকার তরুণ ও যুবকদেরকে কোন প্রকার অর্থ ও পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাঠানোর প্রস্তাব দিত। মালয়েশিয়া পৌঁছে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করার চুক্তিতে পাঠানো হয়।

নারায়ণগঞ্জ থেকে টেকনাফ, মিয়ানমার হয়ে নৌপথে মালয়েশিয়া রুট:

বেকার তরুণদের মানবপাচার চক্রের সদস্যরা কথিত উন্নত জীবন-যাপনের স্বপ্ন দেখায়। ভাগ্য পরিবর্তন ও উন্নত জীবন-যাপনের আশায় সেসব তরুণ ও যুবক মালয়েশিয়া যেতে চক্রের ফাঁদে পা দেয়। তাদেরকে জসিম ও এলাহীসহ চক্রের অন্য সদস্যরা সংগ্রহ শেষে ইসমাইলের কাছে নিয়ে আসে। এরপর তাদেরকে নারায়ণগঞ্জ থেকে বাসে করে কক্সবাজার জেলার টেকনাফের মানবপাচার চক্রের আরেক সদস্য আলমের কাছে নেয়া হতো। টেকনাফের আলম ভুক্তভোগীদের কয়েক দিন রেখে সুবিধাজনক সময়ে তাদের ট্রলারে মিয়ানমারে জামালের কাছে পাঠাত। এরপর মিয়ানমারে গোপন ক্যাম্পে নিয়ে জিম্মি করে নির্যাতনের মুখে মুক্তিপণ দাবি করত জামাল। নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে তা ইসমাইলের মাধ্যমে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করতো।

মুক্তিপণ না দিলে ভুক্তভোগীদের নির্মমভাবে নির্যাতন করা হতো। সেসব ভুক্তভোগীর পরিবার মুক্তিপণের আদায় শেষে তাদেরকে মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে মালয়েশিয়ায় চক্রের সদস্য রশিদুলের কাছে পাঠায়।

গ্রেপ্তার ইসমাইল নিজের ও অন্যান্য সদস্যদের অংশের টাকা রেখে অবশিষ্ট টাকা মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রশিদুলের কাছ থেকে মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংকের মাধ্যমে প্রেরণ করতো। পরবর্তীতে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রশিদুল ও মিয়ানমারে অবস্থানরত জামাল মুক্তিপণের টাকা ভাগ করে নিতো বলে জানা যায়।

কমান্ডার মঈন আরও বলেন, রাশিদুল প্রায় ২৫ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে। প্রায় ২০ বছর সে মানবপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত।

জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে কমান্ডার মঈন বলেন, চক্রটি চলতি বছরের গত ১৯ মার্চ মোট ২২ জনকে ট্রলারে করে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় পাচার করার সময় মিয়ানমার উপকূলে পৌঁছলে মিয়ানমার কোস্টাগার্ড ১৯ জনকে আটক করে। বাকি ৩ জনকে এই চক্রের সদস্য মিয়ানমারের জামাল কৌশলে ছাড়িয়ে তার ক্যাম্পে নিয়ে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন করে। এদের মধ্যে ছিল জহিরুলও। তার পরিবারের কাছে ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে চক্রের সদস্যরা। প‌রে জহিরুলের পরিবার গত ১০ মে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দেয়, বাকি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা মালয়েশিয়া যাওয়ার পর দিবে।

প‌রে জহিরুলকে গত মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে সিঙ্গাপুরের পাশ দিয়ে মালয়েশিয়া পাঠানো হয়। নির্যাতনের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে মালয়েশিয়া পুলিশের মাধ্যমে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। গত ২৪ মে সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। মৃত্যু সনদপত্রে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে তার শরীরে নির্যাতনের কথা উল্লেখ আছে।

গ্রেপ্তার জসিম ও এলাহী সম্পর্কে র‍্যাব মুখপাত্র বলেন, তারা চক্রটির অন্যতম সহযোগী। নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করে বিভিন্ন এলাকা থেকে বিদেশগামীদের সংগ্রহ করে ইসমাইলের নিকট নিয়ে আসতো তারা। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা আছে।

মানবপাচারকারী চক্রে নির্যাতনে নিহত ভুক্তভোগী জহিরুলের বড় ভাই আবুল কালাম আজাদ র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে বলেন, ২০০৬ সাল থেকে আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। মা সাইন প্রিন্টিং প্রেসে আমার সঙ্গেই কাজ করতো জহিরুল। হঠাৎ মার্চে দোকানের পাশ থেকে জহিরুলকে মেরে উঠিয়ে নিয়ে যায় মানবপাচারকারীরা। এক মাস নিখোঁজ ছিল জহিরুল। এরপর যোগাযোগ হয়। নির্যাতন করে টাকা চায়। আমরা টাকাও দিই। কিন্তু ভাইকে আর ফিরে পাইনি। এপ্রিল মাসে মামলার পর জহিরুলের উপর নির্যাতন আরও বেড়ে যায়। কোনোদিন আর ফিরে পাবো না বলে হুমকি দিয়েছিলো জামাল।

আজাদ বলেন, এ কেমন উন্নত জীবন! ভিসা পাসপোর্ট ছাড়া বিদেশ যাওয়া যায় না। আমার ভাইটা বিবাহিত। ওর দেড় বছরের ছেলে ও সাত বছর বয়সী ছোট্ট মেয়ে আছে। মানবপাচারকারীদের খপ্পড়ে পড়ে পুরো পরিবার আজ পথে বসার দশা। উন্নত জীবনের বদলে ভাইটাকে আমার মরতে হলো। এজীবন চাই না, জড়িত চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ ও শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানান তিনি।