মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বনের গাছ কেটে উজার করার অভিযোগ

পটুয়াখালীর কলাপাড়া রেঞ্জের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বনের গাছ কেটে উজার এবং অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রতিনিয়ত বন উজার করায় কলাপাড়া রেঞ্জের আওতাধীন সবুজ বেষ্টনী হুমকির মুখে পড়েছে। বনবিভাগের কিছু দুস্কৃতকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী সুযোগ পেলেই রাতের আঁধারে বনের গাছ কেটে উজাড় করছে।
অভিযোগ উঠেছে, এই রেঞ্জের আওতাধীন ভুমি অফিসের কতিপয় কর্মীর কারণেও বনাঞ্চল ধবংস হয়ে যাচ্ছে। বন বিভাগের বিস্তীর্ণ জায়গা বেদখলে চলে গেলেও বনভুমি উদ্ধারে বন বিভাগের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে জীবন ও সম্পদ রক্ষাকারী সবুজ বেষ্টনি চরম হুমকীর মুখে পড়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইটভাটা মালিক, করাত কল মালিক, ইমারত ভবন নির্মাণকারী কাজের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীরা বন উজাড়ে সক্রিয় থাকায় বন আইন উপেক্ষিত হচ্ছে। একটি সংঘবদ্ধ বনদস্যুচক্র গাছ পাচারের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে সমগ্র উপকূল জুড়ে। তারা কলাপাড়ার গঙ্গামতি, ফাতরা, নিশানবাড়িয়া, কাটাভাড়ানি, কুয়াকাটাসহ মহিপুর ও কলাপাড়া রেঞ্জের বনাঞ্চল থেকে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছ কেটে অবাধে বিক্রী করে দিচ্ছে ইটভাটা ও করাতকলে।
কলাপাড়া উপজেলা বন বিভাগ সুত্রে জানা গেছে, উপজেলা বন বিভাগ মোট জমি ১০ হাজার ১৭৭দশমিক ১১একর। এর মধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে তিন হাজার ৯৭৮ দশমিক ৩৩একর। যার মধ্যে কুয়াকাটা বিটে ১৯৩ একর। কুয়াকাটা ক্যাম্পের অধীনে ১৮১৮ দশমিক ৯৩একর। গঙ্গামতি ক্যাম্পে ১১২৮একর। খাজুরা ক্যাম্পে ৩৪৬দশমিক ৮৭একর। এবং ধুলাসার ক্যাম্পের অধীন ৪৬১ দশমিক ৫৩একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকার কথা। গত দু’বছর আগে তারা গঙ্গামতি এলাকায় নতুন ২০০একর বনায়ন করেছেন। এদিকে ফুলবুনিয়া, বালীয়াতলী ও লালুয়ায় বাগান কেন্দ্র করা হয়েছে। ১৩টি পোল্ডারের বেড়িবাঁধের বাইরের এই বনাঞ্চল গড়ে ওঠে ষাটের দশকের পরের দিকে।
এদিকে মহিপুর সংরক্ষিত বনাঞ্চল ছাড়াও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৪০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বাইরে প্রাকৃতিকভাবে এবং বনবিভাগের উদ্যোগে সৃজিত ছইলা কেওড়া, বাইন প্রজাতির বাগান উজাড়ের মহোৎসব চলছে। বনবিভাগ এখন বন রক্ষার বদলে ভক্ষকে পরিণত হয়েছে।
সিডর-আইলার মতো ভয়াল প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষ তাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করতে পেরেছে। কিন্তু বর্তমানে গত নয়-দশ বছরে বেড়িবাঁধের বাইরের বনাঞ্চল দখল করে বাড়ি-ঘর থেকে শুরু করে মাছের পুকুর, ঘের করা হয়েছে শত শত। এমনকি স-মিল পর্যন্ত করা হয়েছে। এসব যেন দেখার কেউ নেই। কলাপাড়ায় নদী ও সাগরঘেঁষা দীর্ঘ ৪০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বাইরের ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছ এভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। সবগুলো পোল্ডারের দৃশ্য একই। এ ছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড বেড়িবাঁধ পুনরাকৃতিকরণের কাজ করতে গিয়ে বেকু মেশিনে মাটি কাটার কারণেও শত শত গাছ উপড়ে ফেলা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পায়রা সমুদ্র বন্দর, তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, নৌ-ঘাঁটিসহ সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলায় ইটের চাহিদা বেড়েছে। সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে প্রায় অর্ধ-শতাধিক ইটভাটা ইটের সরবরাহ করেও চাহিদার যোগান দিতে পারছে না। কয়লার পরিবর্তে ইটভাটাগুলোতে দেদারছে পুড়ছে গাছ। ইমারত নির্মাণ কাজ, ছাদ ঢালাইয়ের সেন্টারিং, কলাম, ভিম তৈরীতে লোহার সরঞ্জামাদির পাশাপাশি ব্যবহার বেড়েছে কাঠের। এসব কাঠের চাহিদা মেটাতে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ কেটে সংঘবদ্ধ বনদস্যু চক্র জড়ো করছে চিহ্নিত কয়েকটি করাতকল। যা পরে বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে।
মহিপুর ইউনিয়নের নজিবপুর, সুধিরপুর, নিজামপুর, নীলগঞ্জ ও চাকামইয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা বনদস্যু চক্রের সদস্য। উপজেলা চাকামইয়া ইউনিয়নের আনিপাড়া এলাকা থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে বড় বড় সাইজের প্রায় অর্ধশত ছইলা, কেওড়া, বাইন ও গোমা প্রজাতির গাছ কেটে বিক্রির জন্য স্বমিলে নিয়ে যায় একটি চক্র। তারা আড়পাঙ্গাসিয়া নদীর অপর পাড় আঙ্গারপাড়া, চাউলা পাড়া গ্রাম সংলগ্ন জঙ্গল থেকে বন কর্মীদের উপস্থিতিতেই গাছ কেটে মাহেন্দ্র গাড়ীতে তুলে রাতের আঁধারে পৌঁছে দিচ্ছে ইটভাটায়। একইভাবে ফাতরা বনাঞ্চল থেকে প্রকাশ্যে গাছ কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে করাত কল ও ইটভাটায়।
বালীয়াতলী খেয়াঘাট সংলগ্ন গোলপাতা বনটি কেটে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে দোকানপাট। পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার পুর্ব দিকে বন উজার করে জমি বানিয়ে চলছে চাষাবাদ। ভূমি অফিসের কতিপয় কর্মীর কারণেও বনাঞ্চল ধবংস হয়ে যাচ্ছে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। মধুখালীর ম্যানগ্রেভ বনাঞ্চলকে চাষযোগ্য কৃষিজমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত দেয়ায় সেখানে আরো ১০ বছর আগে থেকে প্রাচীন শত শত ছইলা, কেওড়া, বাইন গাছ কেটে উজার করা হয়েছে। বানানো হয়েছে বসতবাড়ী। বর্তমানে দৃষ্টিনন্দন মধুখালী বনাঞ্চলটি ধবংসের মুখে। বনের বিভিন্ন স্থানে চাষের জমি তৈরি করে নামে বেনামে কাগজ বানিয়ে চলছে জমি বেচাকেনা। এই বনের বিভিন্ন স্থানে দেখা যায় নামে বেনামে বায়না মুল্যে জমি বেচাকেনার সাইনর্বোড। কিভাবে তারা এসব জমির মালিক হলেন তা ভেবে স্থানীয় অনেকেই হতবাক।
কুয়াকাটা সৈকতের গঙ্গামতি এলাকার সংরক্ষিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধের বাহিরে সৈকত লাগোয়া বনাঞ্চলের দিকে তাকালে দেখা যায়, বন উজাড়ের করুন পরিনতি। গত নয়-দশ বছরে বনের এক তৃতীয়াংশ সাগর বিলিন হয়েছ। বাকিটা বনদস্যুদের কুঠাড়ে ধংস হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
জানায় যায়, ১৯৬৭ সালে বাবলা ও কড়ই গাছ রোপন করে গঙ্গামতি বনাঞ্চল সৃষ্টি করা হয়। আশির দশকে প্রাকৃতিকভাবে এ বনাঞ্চলে ছইলা, কেওড়া ও বাইনগাছ জন্ম নেয়। প্রায় আট কিলোমিটার এ বনাঞ্চলের এক তৃতীয়াংশ সাগরের ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে। বাকিটা উজাড় করছে বনদস্যুরা। রাতের আঁধারে গাছ কেটে কেরোসিন বা পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে সদ্যকাটা গাছের আলামত নষ্ট করে দিচ্ছে তারা। এ বনাঞ্চল থেকে গাছ কেটে ট্রলারে করে সহজেই পাচার করা হচ্ছে। প্রকাশ্যে বনাঞ্চল উজার করায় উদ্বিগ্ন বনাঞ্চল সংলগ্ন বেড়িবাঁধের ভিতরের পাঁচ শতাধিক পরিবার।
এ ব্যাপারে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রিকালচার অনুষদের ডিন ড. মাইনুল হাসান বলেন, বাংলাদেশে জন্মে এমন প্রতিটি উদ্ভিদ প্রজাতিই জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। বাংলাদেশের বর্ধিত জনসংখ্যার প্রয়োজন মেটাতে প্রতিনিয়ত ও দেশের জীববৈচিত্র্যের ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে অনেক উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে এবং বিলুপ্তির পথে। নির্বিচারে বনভুমি ধবংস, মাত্রাতিরিক্ত প্রাকৃতিক সম্পাদ আহরণ, উদ্ভিদের আবাসস্থলের পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক কারণে (ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, তাপমাত্রা বৃদ্ধি) বাংলাদেশের অনেক উদ্ভিদ প্রজাতির অস্তিত্ব বর্তমানে হুমকির মুখে পড়েছে।
কলাপাড়া বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা আ. সালামের সঙ্গে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে তার কোন বক্তব্য দেননি। তিনি কিছুই জানেন না বলে অভিমত প্রকাশ করেন।
পটুয়াখালী উপকূলীয় বন কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ইট পোড়ানো আইন অনুয়ায়ী ইট ভাটায় গাছ পোড়ানো হলে সেটি ডিসি সাহেব ও ইউএনওকে জানাতে হবে। এছাড়া করাতকলগুলোতে আমাদের বনাঞ্চলের গাছ চেরাই করা হলে আমাদের লিখিতভাবে জানাতে হবে।