মায়ের মত দুঃখ পোষা পাখি হোস

মায়ের মত দুঃখ পোষা পাখি হোস

বারোটা বেজে দশ। এই ভরদুপুরে ঘুম থেকে ওঠার সাহেবি হালচালের হেতু পাশের ঘর থেকে মায়ের বকুনির আওয়াজ কানে আসছে খানিকটা। মন দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তাই টুপ করে ব্যালকনিতে এসে বসে পড়েছি। বেশ কয়েকদিন আগেই আমার বারান্দায় ঘর বেঁধেছে বুলবুলি। বোধ করি, ভুল করেই। এখন নির্ঘাত হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে কী ভুলটাই না করেছে। ওদের এক বিন্দুও বিশ্বাস নেই আমার ওপর। বারান্দায় এসেছি টের পেলেই দু-হাত দূরের নারকেল গাছের ডগায় গিয়ে বসে থাকে আর আমাকে অবলোকন করতে থাকে, পাছে আমি তাদের ঘরদোরের ক্ষতি করে বসি। বেচারাদের আশ্বস্ত করবার জন্য ইদানিং ব্যালকনিতে আসাই বন্ধ করে দিয়েছি। তবুও এদের ভয় কাটানো দায়। আজ হুট করেই আবিষ্কার করি দুটো ডিমের একটা থেকে ছানাও ফুটেছে। কদিন ধরে ভাবছিলাম- ‘সুসংবাদ’ শব্দটিকে এখনও কেন অভিধান থেকে তুলে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ ঘরের সাথের বারান্দায়ই কী স্বাচ্ছন্দ্যে ‘সুসংবাদ’ ঘরবসত করছে সেটা টেরই পেলুম নে! পাবার কথাও নয়। মাত্র খবর এলো সদ্য ভূমিষ্ঠ হয়েছে যে শিশু তার নাকেও বসাতে হয়েছে অক্সিজেন নল। ভোররাতে নিউজফিড স্ক্রল করতে করতে যে প্রথিতযশা ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির বক্তব্য চোখে পড়েছিল, তিনি বলছিলেন, ‘কবি-সাহিত্যিকদের লেখনী পড়ে হিন্দুত্ব শেখার কোন মানে নেই।’ অথচ আজ সকাল থেকেই বারংবার ছাড়পত্রের সেই চরণক’টি মাথায় ঘুরছে-

   ‘চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ,
            প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল।
  এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-
      নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’

হিন্দুত্ব শিখছি কিনা জানা নেই। তবে অবাক হচ্ছি, সাত দশকেরও অধিক সময় পূর্বে সুকান্ত যে অঙ্গীকার করেছেন তা কতখানি আমাদের হয়েছে! আজ নবজাতকের অভ্যর্থনা হল অক্সিজেন নল দিয়ে। গতকালের সেই ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিটির উপর অভিমান হচ্ছে ভীষণ। কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় হিন্দুত্ব আছে কি নেই সে সমাচার না করে তিনি দু চারটে গাছ লাগানোর হাদিস শোনালে বোধ করি এই নবজাতকদের একটা সুস্থ সকাল উপহার দেওয়া যেত।

গাছের ডালে বসে থাকা মা বুলবুলিটি এবার আমার ওপর বিরক্ত তা ঢের বুঝতে পারছি। মিনিট পাঁচেক ধরে ডাকাডাকি করে কানে পোকা ধরিয়ে ফেলেছে। তবুও উঠতে মন চাইছে না। পাশের ঘরে ছোটবোন ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ রচনা মুখস্ত করছে বলে মনে হল। এমন ছেলেবেলা আমারও ছিল। চোখে পাহাড়সমান স্বপ্ন নিয়ে ‘ট্রি প্ল্যান্টেশন’, ‘ডিফরেস্টেশন’, ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ’ প্যারাগ্রাফগুলে খেতাম। স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে গাড়ি ঘোড়া চড়তে হবে, প্রাসাদোপম অট্টালিকার একচ্ছত্র অধিপতি হতে হবে। হাত দুটো ঝাড়া দিতেই পড়বে শয়ে শয়ে নোট- একশো, দুশো, হাজার, লক্ষ, কোটি। এসব স্বপ্ন দেখতাম বলেই তো ‘ট্রি প্ল্যান্টেশন’ এত সুন্দরভাবে গুলে খেতে পারতাম।

বারান্দার যে পাশটাতে এখন বসে আছি সেখান থেকে সোজা তাকালেই একখানা মেহগনি গাছে চোখ আটকে যায়। বাকি সবকটাই নারকেল গাছ নয়তো আমগাছ। মেহগনিটার সাথে আমার দারুণ বন্ধুত্ব। এই মেহগনির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কত চোখের জল ফেলেছি তার হিসেব নেই। নিচের বাগানের মত জায়গাটাতে বাচ্চারা বৃষ্টিতে ভিজছে, গাছের সঙ্গে বাঁধা দোলনায় দোল খাচ্ছে, গাছে উঠেই সামনের পুকুরটায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে। উপর তলায় বাসা না হলে এসব আনন্দের দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হতাম এই ভেবে নিজেকে কিছুটা সৌভাগ্যবান মনে হল।

আমাদের বাসা থেকে দশ কদম দূরের একতলা ঘরটা জমিলা চাচীদের। গতরাতে যে চাচী চাচার হাতে মার খেয়ে সংসার ছেড়ে যাবে বলে চিৎকার করে সারা পাড়ার ঘুম ভাঙিয়েছিলেন, তিনি দিব্যি আজ চাচার সঙ্গে ভ্যাক্সিন নিতে চললেন। আমার কলেজজীবনের প্রিয় এক শিক্ষক একবার বলেছিলেন, ‘জীবনে যত কেন’র উত্তর খুঁজবে, তত জীবনকে জটিল মনে হবে।’ জমিলা চাচীকে আমি কখনও জিজ্ঞেস করিনি একাকী হলে সে ভাবে কিনা-এই কেন টুকু বলবার শক্তিও কেন তার নেই। কিন্তু নিজেকে প্রশ্ন করি, স্যার এত সহজভাবে কি করে এরকম কঠিন সত্যটা বলেছিলেন সেদিন!

গতকালকের খবরের কাগজটা এখনও পড়ার টেবিলেই রাখা। শিরোনাম ‘কোমর সমান পানিতে ভোগান্তি জনজীবনে’

এই নিয়ে একটা ট্রল ভিডিও গতকাল ইনবক্সে পেয়েছি। হেসেছিও ভীষণ। কিন্তু তখন নবজাতকের কাছে সুকান্তর করা দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা মাথায় আসেনি। ভবিষ্যতে আরও আসবে না। হিপনোটাইজ করে করে ভুলিয়ে দেয়া হবে ‘রবীন্দ্র’, ‘নজরুল’, ‘শরৎ’ কিংবা ‘সুকান্ত’। তোতাপাখির মত আওড়ে যাব শেখানো কিছু বুলি। ধুর, মাথার মধ্যে সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

চোখের সামনের মেহগনিটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে কেমন। কই, বৃষ্টি তো সেই কখন থেমে গেছে। চশমাটা খুলে এবার পাশে রাখাটাই সমীচীন।

একদিন এই মেহগনি গাছটা থাকবে না। ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ’ গুলে খাওয়া মানুষ এখানে বানাবে প্রাসাদোপম অট্টালিকা। এই সবুজ বাগানের জায়গায় রঙ বেরঙের দালানকোঠা একে অপরকে ছাড়িয়ে উঠবে আরও আরও আরও উঁচুতে।

বুলবুলিটার ভয় কেটে গিয়েছে বোধ করি। আমার উপস্থিতিতেই তারা মনের সুখে খেলা করছে এখন। হায়রে বুলবুলি! ফের মানুষকেই বিশ্বাস করে বসলি? এ ভুলের মাশুল থেকে স্বয়ং ঈশ্বরও ছাড় দেবেন না তোদের। খানিকক্ষণ আফসোস করার আগেই মা বারান্দায় এসে হাজির। ঘুম ভেঙে এখনও নাস্তা খেতে না যাওয়ায় বাধ্য হয়ে বারান্দাতেই খাবার নিয়ে চলে এসেছেন। নাস্তা আর গালমন্দ দুটোই একসঙ্গে খাইয়ে দিয়ে গেলেন। আমি অভাগী বুলবুলিটার দিকে তাকিয়ে বললেম, ‘আমার মত অতীত পোষা হোস নে যেন। হলে মায়ের মত দুঃখ পোষা পাখি হোস। অক্সিজেন নলের সঙ্গে সখ্যতা গড়া সদ্যোজাত শিশুটির মায়ের মত দুঃখী হোস।’