সত্য প্রেম পবিত্রতার অবতার মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত
অশ্বিনী কুমার দত্ত আধুনিক বরিশালের নির্মাতা। তার নেতৃত্বে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বরিশালে নবজাগরণ শুরু হয়। তিনি বরিশালে শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠিত ব্রজমোহন স্কুল ও ব্রজমোহন কলেজকে কেন্দ্র করে গ্রামে গ্রামে নতুন নতুন বিদ্যালয় সৃষ্টি হয়। ব্রজমোহন কলেজ ও স্কুল থেকে শিক্ষা লাভ করে তারা শিক্ষা বিস্তারে নেতৃত্ব দেয়। অচিরেই বরিশালের শিক্ষার হার অবিভক্ত বাংলায় সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বরিশালের সে রেকর্ড এখনো অক্ষুণ্ণ রয়েছে। ১৯৩১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে শিক্ষার হার বাংলাদেশে সর্বোচ্চ। অশ্বিনী কুমার দত্ত বরিশালকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে এসেছেন। বরিশালের সমাজকে কুসংস্কার ও অপরাধমুক্ত করেছেন। তিনি সর্বত্যাগী ঋষি। বরিশালের উন্নয়নের জন্য তিনি দাম্পত্য জীবন-যৌবন উৎসর্গ করেছেন। তার বাসভবন বরিশালের বাতিঘর ছিল। তৃণমূলের জনগণ তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। তিনি বরিশালের হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। তিনি কালজয়ী- তিনি সত্য প্রেম পবিত্রতার মূর্ত প্রতীক। তার আদর্শ- সত্য প্রেম পবিত্রতা অক্ষয়- চিরঞ্জীব। এ আদর্শ যুগে যুগে বরিশাল বিভাগবাসীকে অনুপ্রাণীত করবে।
বরিশালের রেনেসাঁ এই মহান নেতার জন্ম পটুয়াখালীর লাউকাঠিতে। তার পৈতৃক নিবাস গৌরনদীর বাটাজোড় দত্ত পরিবারে। দত্ত পরিবার সেন আমলে কুলীনত্ব লাভ করে বাটাজোড়ে তারা ফার্সি ভাষায় শিক্ষা লাভ করে নবাবের দরবারে চাকরি করতো। তাদের পদবী ছিল মজুমদার। অশ্বিনী কুমার দত্তের পিতা ব্রজমোহন দত্ত, মাতার নাম প্রসন্নময়ী দেবী। ব্রজমোহন দত্ত পটুয়াখালীর মুন্সেফ ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তার প্রস্তাবে ব্রিটিশ সরকার পটুয়াখালী মহকুমা সৃষ্টি করেছে। ব্রজমোহন দত্তের জন্ম ১৮২৬ এবং মৃত্যু ১৮৮৬ সালের ৩১ জানুয়ারি। অশ্বিনী কুমার দত্ত বরিশালের প্রথম এমএ এলএলবি। কলকাতায় ছাত্রজীবনে রামতনু লাহিড়ী, রাজনারায়ণ বসু, কেশব চন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দের সংস্পর্শে আসেন। অশ্বিনী কুমার ডেপুটি ম্যাজিস্টেট হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পিতা ইংরেজের গোলামী পছন্দ করতেন না, তাকে বরিশালের জাগরণের জন্য জন্মভূমিতে যেতে বলেন। রাজনারায়ণ বসু তাকে বলেছিলেন- ‘অশ্বিনীকুমার, যদি কাজ করিতে চাও বরিশালে থাকিও। আর যদি খুব নাম করিতে চাও কলকাতায় থাকিও।’
অশ্বিনী কুমার দত্ত ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে বরিশাল বারে যোগ দেন। অশ্বিনী কুমার সমাজ সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারের কাজ একই সাথে শুরু করেন। বরিশাল চুরি, ডাকাতি, খুন, জমি নিয়ে দাঙ্গার জন্য খ্যাত। সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। নারী শিক্ষা শূন্যের কোঠায়, শিক্ষার হার শতকরা ৫ ভাগের বেশি নয়। সমগ্র বাকেরগঞ্জ জেলায় একমাত্র হাইস্কুল বরিশাল জিলা স্কুল। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায়- ফরিদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, বরিশাল, খুলনা, যশোরে কোনো কলেজ ছিল না। দত্ত পরিবারের জমিদারীর আয় ছিল। পিতার নির্দেশে অশ্বিনী কুমার ১৮৮৪ সালের ২৭ জুন ব্রজমোহন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যালয়ের কার্যক্রম প্রথমে শহরের জেলখানার সামনে হরি ঘোষের ভাড়া বাসায় শুরু হয়। কয়েক মাস পরে অশ্বিনী ভবনে নিয়ে আসেন। পরে বর্তমান স্থানে চলে যায়। ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক ছিলেন সত্য, প্রেম, পবিত্রতার মন্ত্রে দীক্ষিত।
১৮৮৯ সালের ১৪ জুন তিনি পিতার নামে ব্রজমোহন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি প্রথমে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং ১৮৯৮ সালে প্রথম শ্রেণি কলেজে উন্নীত হয়। ব্রজমোহন কলেজ প্রথমে অশ্বিনী ভবনে শুরু হয়। পরে বিএম স্কুলে কলেজ ১৯১৬ সাল পর্যন্ত চলে। ১৯১৭ সালে ব্রজমোহন কলেজ বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হয়। কলেজের শিক্ষকগণ ছিলেন পত্নি ও আদর্শবান। কলেজের শিক্ষার মান উন্নত থাকায় ব্রজমোহন কলেজকে বলা হতো ‘বাংলার অক্সফোর্ড’। কলেজের ছাত্র দেবপ্রসাদ ঘোষ ১৯১০ সালে আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী ছিলেন।
অশ্বিনী কুমার দত্ত বরিশাল জনসভার নেতা ছিলেন। তিনি ও আগরপুরের সৈজুদ্দিন উকিল ১৮৮৬ সালে ভারতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। তিনি ১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কংগ্রেসের মাধ্যমে ভারতে আইনসভার প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। তিনি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেন। ১৮৮৭ সালে তিনি বরিশাল লোকাল বোর্ড চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৮৯৩-৯৬ সালে তিনি বরিশাল পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি বরিশাল শহরে সড়ক নির্মাণে ভূমিকা রাখেন। ১৯০১ সালে অশ্বিনী কুমার একে ফজলুল হককে বরিশাল পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত করেন। ফজলুল হক জেলা বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১২ সালে ঢাকা বিভাগের আইনসভার সদস্যপদ শূন্য হলে একে ফজলুল হক অশ্বিনী কুমার দত্তের নির্দেশে প্রার্থী হন। এ সময় বাকেরগঞ্জ জেলা ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফজলুল হকের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন রায়বাহাদুর মহেন্দ্র মিত্র। অশ্বিনী কুমার হিন্দু প্রার্থীকে সমর্থন না দিয়ে নিজ জেলার তার স্নেহধন্য ফজলুল হককে সমর্থন ও তার পক্ষে প্রচারণা চালান।
ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জনের সুপারিশে ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগ হয়। পূর্ব বাংলা আসাম নিয়ে নতুন প্রদেশ সৃষ্টি হয়। বঙ্গ বিভাগের বিরুদ্ধে অশ্বিনী কুমার দত্ত বরিশালের ৫ মহকুমার গ্রামেগঞ্জে আন্দোলন শুরু করেন। একই সঙ্গে স্বদেশী আন্দোলন- বিদেশী দ্রব্য বর্জন অভিযান চলে। ১৯০৬ সালের ১৪ এপ্রিল বরিশালে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস সভাপতি সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ সম্মেলনে যোগ দেন। স্বদেশী আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য পূর্ব বাংলায় আসাম সরকার পুলিশী নির্যাতন চালায়।
১৯০৮ সালে ব্রিটিশ সরকার মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তসহ বাংলার ৯ নেতাকে গ্রেপ্তার করে। ১৯১০ সালে অশ্বিনী কুমারকে মুক্তি দেয়া হয়। জেলে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। তার গঠিত স্বদেশবান্ধব সমিতি ১৫০টি শাখা স্বদেশী আন্দোলন অব্যাহত রাখে। একই সঙ্গে অশ্বিনী কুমারের সহযোগিতায় বরিশাল বা যুগান্তর পার্টিবিরোধী তৎপরতা চালিয়ে যায়। বাংলা-আসামে বরিশালে অশ্বিনী কুমারের নেতৃত্বে শক্তিশালী ছিল।
বরিশাল বিপ্লবী পার্টি ও স্বদেশ আন্দোলন ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে কাঁপিয়ে ফেলে। এ কারণে ভারত সচিব মর্লে বলেছিল- ‘বাংলা ও সীমান্ত সমস্যা তার ঘুম কেড়ে নিয়েছে।’ বরিশাল বিপ্লবী বা যুগান্তর পার্টির নেতা ছিলেন বিএম স্কুলের শিক্ষক সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং অনুশীলন পার্টির নেতা দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ- দেবেন দা।
১৯১১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বঙ্গভঙ্গ রদ করে দেয়। সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লি দরবারে ১৯১১ সালের ১১ ডিসেম্বর বাংলা রদ ঘোষণা দেন। ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লি স্থানান্তরিত হয়। পূর্ব বাংলার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্রিটিশ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে। অশ্বিনী কুমার দত্ত একই সঙ্গে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ছিলেন। তিনি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ভারতগীতি রচনা করেন।
১৯১৫ সালে পুনরায় ফজলুল হক ঢাকা বিভাগ থেকে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। কি মহৎ লোক অশ্বিনী কুমার, সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি ফজলুল হককে জয়ী করান।
১৯২০ সালে খেলাফত এবং ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ১৯২১ সালের মার্চ মাসে বরিশালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মূল সভার সভাপতি ছিলেন বিখ্যাত জননেতা বিপিন চন্দ্র পাল।
১৯২১ সালের জুন মাসে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তার বাসন্তী দেবী নৌকাযোগে চাঁদপুর থেকে ৪ দিনে বরিশাল পৌঁছেন এবং অশ্বিনী কুমার দত্তের সঙ্গে স্টীমার শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন।
চারণকবি মুকুন্দ দাশ দেশের গান গেয়ে স্বদেশী অসহযোগ আন্দোলনকে জনপ্রিয় করেন। অশ্বিনী কুমার দত্ত ১৯২০ সালে খেলাফত আন্দোলনকে সমর্থন দেন। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
মহাত্মা গান্ধী ও মওলানা মুহাম্মদ আলী বরিশাল আগমন করেন-
১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মহাত্মা গান্ধী ও মুহাম্মদ আলী স্টীমারে বরিশাল আগমন করেন। মহাত্মা গান্ধী বরিশালের অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের ব্যাপক গণজাগরণ দেখে বলেছেন- ‘সারা ভারত যখন গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন ছিল, তখন বরিশাল সদা জাগ্রত।’ অশ্বিনী কুমার অসুস্থ। তাই ১৯২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গান্ধী ও মুহাম্মদ আলী অশ্বিনী ভবনে তার সঙ্গে দেখা করে উপমহাদেশের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করেন। জনসভায় গান্ধীর হিন্দি ও মুহাম্মদ আলীর উর্দু ভাষণ কংগ্রেস নেতা হাশেম আলী খান (মন্ত্রী) বঙ্গানুবাদ করে শোনান।
বরিশালে প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির অধিবেশন- ১৯২৩ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত সভায় বরিশাল কংগ্রেস চেঞ্জার ও নো-চেঞ্জারে বিভক্ত হলো, এ সভায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ উপস্থিত ছিলেন।
১৯২২ সালের আগস্ট মাসে অশ্বিনী কুমার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি স্টিমারে চিকিৎসার জন্য কলকাতা যাত্রা করেন। এ সময় তার এক ভক্ত জিজ্ঞেস করেন- বাবু আপনি পুনর্জন্মে কোথায় জন্মগ্রহণ করবেন- উত্তরে তিনি বলেন, বাংলাদেশে- বরিশালে- আমার মা হবেন প্রসন্নময়ী দেবী। তবে বাপ কে হবেন খুঁজে পাচ্ছি না। হ্যাঁ, আবদুল ডাকাত আমার বাপ হবে- আবদুল ডাকাতকে তিনি বরিশাল জেলে দেখতে যান। ফাঁসির আদেশ হয়েছে, কোনো ভয় বা চিন্তা নেই। আবদুল ডাকাত অশ্বিনী কুমারকে বলেন, বাবু মরতে তো একদিন হবেই। চিন্তা করে কি লাভ। তার সাহস দেখে অশ্বিনী বাবু বিস্মিত। অশ্বিনী বাবু স্টিমার ঘাটে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে শেষ বিদায় নেয়।
১৯২৩ সালের ৭ নভেম্বর কলকাতায় দেহত্যাগ করেন। তার মরদেহ বরিশালে আনা সম্ভব হয়নি। আত্মীয়দের ইচ্ছা সত্ত্বেও তাকে কলকাতা কেওরাতলা শ্মশানে সমাহিত করা হয়। তার সমাধিতে স্মৃতিপ্রস্তর ভিত্তি অনুষ্ঠানে মহাত্মা গান্ধী প্রধান অতিথি এবং মিসেস সরোজিনী নাইডু সভাপতি ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি নিঃসন্তান ছিলেন।
অশ্বিনী কুমার দত্তের দুই ভাই কামিনী, যামিনী। যামিনী কুমার দত্ত ছাত্রজীবনে মৃত্যুবরণ করেন। কামিনী কুমার দত্ত ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষক ছিলেন। তিনি তরুণ বয়সে পুত্র সুকুমারা সুশীল কুমার সরলকুমার দত্ত, দু’কন্যা রেখে মৃত্যুবরণ করেন। সুশীল কুমার কলকাতার ব্যারিস্টার ছিলেন। সরল কুমার দত্ত আইনসভার সদস্য ও জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি ছিলেন। তিনি বিএম স্কুল ও ব্রজমোহন কলেজের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করতেন। পাকিস্তানে নিরাপত্তার অভাবে সরল কুমার দত্ত কলকাতায় চলে যান। যাওয়ার পূর্বে তিনি অশ্বিনী ভবনের ভার ব্রজমোহন কলেজকে দিয়ে যান। অশ্বিনী ভবনে শিক্ষক ও ছাত্ররা বসবাস করতেন।
অশ্বিনী কুমার দত্তের ভাইয়ের ছেলেরা আত্মীয়-স্বজন কেউ বরিশাল কলেজের নিকট অশ্বিনী ভবন বিক্রি করেননি। অশ্বিনী কুমার দত্তের ভাইয়ের ছেলেরা সব সময় বরিশালের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর অশ্বিনী কুমার দত্তের বরিশাল শহরের বাসভবন ও বাটাজোড়ের বিশাল দত্ত বাড়ি শত্রুসম্পত্তি ঘোষণা করে। গ্রামের বাড়ি বেদখল। ১৯৭০ সালে অশ্বিনী ভবন জেলা প্রশাসক হুকুম দখল করে নাইট কলেজকে নামমাত্র ৪০ হাজার টাকা মূল্যে হস্তান্তর করে। শত্রুসম্পত্তি বা ভেস্টেট সম্পত্তি বিক্রি করা বেআইনি। সরকারের দায়িত্ব হিন্দুদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি তত্ত্বাবধান করা, বিক্রি করা নয়। ১৯৭০ সালে অশ্বিনী ভবন জেলা প্রশাসন বেআইনিভাবে হুকুমদখল করে। ফলে অশ্বিনীকুমারের দ্বিতীয় মৃত্যু হলো। হয়তো তিনি পুনর্জন্মে বরিশালে আসবেন না।
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অশ্বিনী কুমার প্রতিষ্ঠিত ব্রজমোহন কলেজের অবদান
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লব, অসহযোগ আন্দোলন, ভারত ছাড় আন্দোলন, উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্রজমোহন কলেজের ছাত্র-শিক্ষকগণ সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছে।
১৯৪২ সালে গান্ধীর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষক-ছাত্র অংশগ্রহণ করেন। অধ্যাপিকা শান্তিসুধাসহ অনেকে গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বরিশালের মুসলিম লীগ পাকিস্তান সমর্থন করে। বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি কাজী বাহাউদ্দিন আহমেদ এবং সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ পাকিস্তান আন্দোলন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ব্রজমোহন কলেজের প্রাক্তন ছাত্র লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা এবং ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক অন্যতম আসামী ছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রজমোহন কলেজ ঐতিহাসিক অবদান রেখেছে
১৯৭০ সালের ৬ দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ব্রজমোহন কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে বরিশাল বিভাগের গণপরিষদের ১৩ আসনের মধ্যে ১১টি, প্রাদেশিক পরিষদের ২৫টি আসনের ২০ আসনে ব্রজমোহন কলেজের প্রাক্তন ছাত্ররা জয়লাভ করেন। এমপিএদের মধ্যে ছিলেন- আমির হোসেন আমু, মহিউদ্দিন আহমেদ, ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক, শাহজাদা আবদুল মালেক খান, সওগাতুল আলম সগীর, একে ইসমাইল প্রমুখ। তারা মুজিব সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।
ব্রজমোহন কলেজের প্রাক্তন ছাত্র যারা সম্মুখযুদ্ধ করে বীরত্বের জন্য পদকে ভূষিত হয়েছেন তাদের মধ্যে- ১ জন বীরশ্রেষ্ঠ- বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর; বীরউত্তম ১ জন, বীর বিক্রম ৪ জন, বীর প্রতীক ১ জন।
ব্রজমোহন কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক শরীফ নুরুল হুদাসহ আগরতলা মামলার ২ নম্বর আসামী লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনসহ অনেক ছাত্র শহীদ হয়েছেন।
এমএনএ
১. অধ্যাপক আবদুল হাদী তালুকদার- রেজিস্টার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২. এডভোকেট আবদুর রব সেরনিয়াবাত
৩. তোফায়েল আহমেদ
৪. নুরুল ইসলাম মঞ্জুর
৫. এডভোকেট গোলাম আহাদ চৌধুরী
৬. এডভোকেট শামসুল হক
৭. আসমত আলী সিকদার
৮. এনায়েত হোসেন খান
৯. ডা. আজাহার উদ্দীন
১০. এডভোকেট এম এ বারেক
১১. সালাউদ্দিন কায়সার
নুরুল ইসলাম মঞ্জুর বরিশাল স্বাধীন বাংলা সচিবালয়ের চিফ
আবদুর রব সেরনিয়াবাত এমএনএ মুক্তিযুদ্ধকালে দক্ষিণ জোনাল কাউন্সিল চেয়ারম্যান ছিলেন।
বর্তমানে নাইট কলেজের অস্তিত্ব নেই। বরিশাল কলেজের নামে সরকারের কোনো বরাদ্দ নেই। অশ্বিনী ভবনের তত্ত্বাবধায়ক হবে সরকার। তার স্মৃতি রক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবি- অশ্বিনী কুমার দত্ত আধুনিক বরিশালের নির্মাতা। বরিশালে নবজাগরণের অগ্রদূত। বরিশালের শিক্ষাগুরু শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের রাজনৈতিক গুরু। তার স্মরণে অশ্বিনী ভবন সংরক্ষণ করতে হবে। অশ্বিনী কুমার দত্ত পরিচালিত আন্দোলনের ফলে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা পুনরায় এক হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলনের ফলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার সোনার বাংলা গান রচনা করেন। তার রচিত গান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অকৃত্রিম নেতাকে জাতীয় স্বীকৃতি প্রদান- বরিশাল বিভাগের হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য অশ্বিনী স্মৃতি ভবন পুনঃনির্মাণ।
লেখক: সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, সভাপতি বরিশাল বিভাগ সমিতি, বরিশাল বিভাগের ইতিহাস লেখক ও বিএম কলেজের প্রাক্তন ছাত্র