সৌন্দর্যের লীলাভূমি ‘শুভ সন্ধ্যা’ সৈকত

সৌন্দর্যের লীলাভূমি ‘শুভ সন্ধ্যা’ সৈকত

‘শুভ সন্ধ্যা’। না এটা সন্ধ্যা নয়। এর সঙ্গে সন্ধ্যার কোন আন্তমিল আছে কি না জানা নেই। এ এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। প্রেম পিয়াসীর অপেক্ষায় খোলা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ঝাউবন। তুমি আসবে তারই প্রতীক্ষায়। দক্ষিণের খোলা বাতাস ঝাউবন স্পর্শ করে যাচ্ছে পরম আবেশে। খোলা বাতাসের ছোঁয়ায় প্রেমিকার উড়ন্ত চুলের মতো দুলছে ঝাউগাছগুলো। জন্ম থেকেই সমুদ্রের খোলা বাতাস গায়ে মেখে ঝাউগাছগুলো এখন অনেক বড় হয়ে উঠেছে। সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ আর ঝাউগাছের মাঝখানে শূন্য বালুরাশি। এ যেন দৃষ্টিনন্দন এক সৈকত! সমুদ্রের মৃদু ঢেউ, বালুময় দীর্ঘ সৈকত আর ঝাউবনের সবুজ সমীরণের এ দৃশ্যটি যেন প্রকৃতি প্রেমের একটি উদাহরণ। যা প্রেমময় দৃশ্যপট তৈরি করেছে। যাকে আমরা শুভ সন্ধ্য সৈকত বলে জানি।

দক্ষিণে তাকালে অথৈ সাগরের ঢেউ আর ঢেউয়ের সাথে দোল খাওয়া মাছ ধরার ট্রলার ব্যাতীত আর কিছুই দেখা যাবে না। সমুদ্রের কোল ঘেঁষা প্রান্তিক জেলা বরগুনার তালতলী উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের নলবুনিয়ায় অবস্থিত এই সৈকত। বরগুনার প্রধান তিনটি নদী পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বরের মিলিত জলমোহনায় সৈকতটি দাঁড়িয়ে আছে যৌবনা রূপ নিয়ে। বেলাভূমিটি প্রায় চার কিলোমিটার লম্বা এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। তালতলী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে সোনাকাটা ইকোপার্কসংলগ্ন নলবুনিয়ার এই চরটি এখন অপার সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা। ‘শুভ সন্ধ্য’ সমুদ্র সৈকত নামে পরিচিতি পেয়েছে।

সীমাহীন সাগর তীরের মুক্ত বাতাস আর চোখ জুড়ানো প্রাকৃতিক শোভা যেন এই সৈকতটির দৃষ্টি আকর্ষণের টোপ। সাগর তীরের বালুকণা পর্যটকদের দুই পায়ের অলঙ্কার হয়ে সঙ্গে থাকে যতদূর পা চলে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট টেংরাগিড়ি এই বেলাভূমির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে আসলে দেখা যাবে, সাগর পাড়ে সবুজের সমারোহে বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ও পাখির কুহুতান। মৃদু ঢেউয়ের ভালোবাসার পরশ পা ছুঁয়ে, স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে লাগিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে একেকটি গোধূলি সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখার মুহূর্তটা কোনো পর্যটকের পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রকৃতি প্রেমের এমন লোভে পড়ে গেলে এই স্বর্গে যেতে মন চাইবে বারবার।

শুধু সমুদ্র ভ্রমণ কিংবা বালুময় সৈকত দর্শনার্থীর মন ভরাবে তা নয়। সমুদ্রের পাশাপাশি আরো অনেক কিছু দেখার সুযোগ মিলবে এখানে এলেই।

শুভ সন্ধ্যার পাশেই আশার চরের অবস্থান। অসংখ্য মৎস্যজীবীর বসবাস এই চরে। আবার শীতের মৌসুমে পর্যটকরাও সেখানে যান। দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, গভীর অরণ্য, বিশাল শুঁটকিপল্লী রয়েছে আশার চরে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে যাওয়া মানুষ শুঁটকি উৎপাদনের জন্য চরটিতে ঘর বাঁধে। বছরে সাত থেকে আট মাস থাকে শুঁটকি উৎপাদনের ব্যস্ততা। তালতলী আশার চরের কাছেই রয়েছে তালতলীর বিশাল রাখাইন পল্লী। বঙ্গোপসাগরের তীরে এ পল্লীতে কুপিবাতি জ্বালিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত চলে তাঁতে কাপড় বোনার কাজ। তাঁতশিল্প ছাড়াও রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ মন্দিরও অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ হতে পারে।

আশারচরের শুঁটকি পল্লী, টেংরাগিড়ি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, সোনাকাটা ইকোপার্কের হরিণসহ বন্যপ্রাণী ইত্যাদি দেখার পাশাপাশি দেখা মেলে মৎসজীবীদের কর্মব্যস্ততা আর সৈকতের বুকে স্থানীয় শিশুদের উচ্ছ্বাস। এখানে নদী সমুদ্রের তাজা মাছ পাওয়া যায় ফকিরহাট বাজারের ছোট ছোট খাবারের হোটেলগুলোতে, যা পর্যটকদের পেট ভরাবে। এখানে খুব অল্প টাকায় খাওয়া যাবে মাছ ভাত বা গ্রামীণ স্থানীয় সব খাবার। এই সৈকতটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে নবীন বিবেচনায় খাবার ও মাছের দাম তুলনামূলক সস্তা।

প্রান্তিক জনপদের সৈকতটি যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি। তবে জেলা শহর থেকে দূরে হওয়ায়, পরিবহন সংকট, প্রশাসনের নজরের বাইরে থাকা ও প্রচার প্রচারণার অভাবে সৈকতটি পর্যটন সম্ভাবনার বাইরেই ছিল। পার্শ্ববর্তী স্থানীয় জনগণ ও মৎসজীবী ছাড়া এখানে পর্যটকদের যাতায়াত খুব কম ছিল। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে সৈকতটি এখন বরগুনার অনেকের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে। দৃষ্টি কেড়েছে জেলা প্রশাসন, সুশীল সমাজ, প্রকৃতিপ্রেমী ও জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের।

সূত্র বলছে, আলোচ্য সৈকতটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে রূপ দিতে নিরন্তর চেষ্টা শুরু করেছিলেন তৎকালীন তালতলীর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বদরুদ্দোজা শুভ ও জনকয়েক স্থানীয় পর্যটকপ্রেমী গণমাধ্যমকর্মী। তারই ধারাবাহিকতায় (২০১৭ সালে ১ ডিসেম্বর) পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে জায়গাটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার বদরুদ্দোজা শুভ। তার নামের সঙ্গে মিল রেখেই এই পর্যটন কেন্দ্রটির নামকরণ করা হয় ‘শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত পর্যটন কেন্দ্র’। বর্তমানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সহযোগিতায় পর্যটকদের জন্য সৈকতটি সুসজ্জিত করা হয়েছে।

পর্যটন সম্ভাবনাময় এই সৈকতটির নাম দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে গত (২৩ নভেম্বর ২০১৮) শুভ সন্ধ্যায় জোছনা উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বরগুনার জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ। গত ১২ নভেম্বর এখানেই উদযাপন করা হলো উপকূল দিবস। বরগুনা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং বরগুনার সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণের মধ্যে এই সৈকতেই অনুষ্ঠিত হলো জোছনা উৎসব।

বর্তমান বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, বরগুনার মানুষ উৎসবপ্রিয়। ‘শুভ সন্ধ্যা’ দ্বীপের জোছনা উৎসবকে দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে প্রচার করা গেলে প্রতিবছর এ উৎসবকে ঘিরে পর্যটকদের ভিড় বাড়বে। দ্বীপকে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা গেলে পর্যটন শিল্প বিকাশের সঙ্গে এখানকার অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। এভাবেই এগিয়ে যাবে বরগুনা।

শুভ সন্ধ্যা সৈকতটিকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করার অরেক স্বপ্নদ্রষ্টা আরিফুর রহমান। এক কথায় তিনি এই শুভ সন্ধ্যার জনক ও বটে। জাতীয় একটি গণমাধ্যমের এই ফটো সাংবাদিক ইতিমধ্যেই সৈকতটিকে নিয়ে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে শুভ সন্ধ্যাকে রাঙিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন। এমনকি নিজের ক্রয় করা তাবু ও পরিকল্পনা দিয়ে তিনি আগত পর্যটকদের সাহায্য করছেন। শুভ সন্ধ্যায় আসার জন্য পর্যটকদের জন্য তিনি একটি নৌযান সার্ভিস চালু করেছেন। প্রকৃতি প্রেমী ফটো সাংবাদিক আরিফ রাহমান নৌযানটির নাম দিয়েছেন  জল তরনী। এ যেন তার সমুদ্রের সঙ্গেও সখ্যতার একটান।

শুভ সন্ধ্যার এই স্বপ্নদ্রষ্টা সাংবাদিক আরিফ রহমান জানান, সমুদ্রের ঢেউ যেখানে আছড়ে পড়ে তার ঢিল ছোড়া দুরত্বে ঝাউসারির প্রাকৃতিক অপরূপ প্রেমময় ইকোলজি দর্শনার্থীদের মনে প্রশান্তি এনে দিতে সক্ষম। গ্রামীণ ভাবধারায় অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি এই সৈকতটির এখনো পর্যটন স্থান হিসেবে খুব বেশি পরিচিতি