৭৫ পরবর্তী সামরিক সরকার প্রগতির পথ রুদ্ধ করেছিল

৭৫ পরবর্তী সামরিক সরকার প্রগতির পথ রুদ্ধ করেছিল

‘একটি প্রদীপ শিখা থেকে লক্ষ প্রদীপ জ্বলে, একটি মানুষ মানুষ হলে বিশ্বভূবন টলে’। সেই মানুষ আমাদের বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি বাঙালি জাতিকে পরাধিনতার শৃঙ্খল মুক্তির কারিগর। যার ডাকে সাড়া দিয়ে গোটা জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তিনি আমাদের মুক্তিদাতা। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই মহামানবকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ঘাতক গোষ্ঠীর গুলিতে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রকে কলুশিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারের হত্যার পর মেজর জিয়া সামরিক ফরমানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর হত্যার খুনিদের বিচার রহিত করেন। যা ইতিহাসের চরম ঘৃণাজনক অধ্যয় বলে স্বীকৃত।  ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যার শিকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজবুর রহমানের প্রতি আমরা বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। 

৭৫-এর ইতিহাসের নির্মম হত্যাকা- ঘটিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা হয়েছিল। এই পথ ধরেই আসে সামরিক শক্তি। এই সামরিক শক্তি ক্ষমতা স্থায়ীকরণের লক্ষে আমাদের সংবিধান সংশোধনের নামে কাটাছেঁড়া শুরু করে। সংবিধানে নানাবিধ পরিবর্তন আনে। ৭৫-এর খুনিদের বাঁচাতে নতুন আইন প্রবর্তন করে। সামরিক সরকারের কারণেই বাংলাদেশ প্রগতির পথ থেকে ছিটকে পড়ে।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট দেওয়া রায়ে উল্লেখ করেছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের শাসনকে বেআইনি ও অবৈধ। মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের পুনর্বাসিত করতে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়েছেন। সুযোগ করে দিয়েছেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করারও। ১৯৭৫ সালে মেজর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচার যাতে না হয় সেজন্য খন্দকার মোশতাকের সহায়তায় জিয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের পথ বন্ধ করেছিলেন।

চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ওপর প্রথম আঘাত আসে। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেওয়া হয় ইনডিমনিটি অধ্যাদেশ দিয়ে। তৃতীয় আঘাত আসে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদের জারি করা সামরিক শাসন, এর পর থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক আইনের অধীনে জারি করা সব আদেশ, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ফরমান, আদেশ ও নির্দেশ অবৈধ বলে উল্লেখ করেছে উচ্চ আদালত। এরই প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত মেজর জিয়াউর রহমানের করা পঞ্চম সংশোধনী এবং সামরিক শাসক এরশাদের জারি করা সপ্তম সংশোধনী বেআইনী এবং অবৈধ ঘোষণা করে বাতিল করার আদেশ জারি করে। মূলত অবৈধ ক্ষমতা দখল এবং সামরিক ফরমাণের কারণে আমাদের সংবিধানের মূল নীতির পরিবর্তন হয়েছে। যার ফলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর ৭৫ পরবর্তী সামরিক সরকারের কারণে আমাদের সামনের চলার পথ অনেকটা স্তিমিত হয়ে যায়।

জিয়া নেতৃত্বাধীন বিএনপি, সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ এর ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ’ এর সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়, তার মানে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও অবৈধ ভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের যে কোন প্রকার শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সেই বিলে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ এর ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সকল সামরিক কর্মকর্তা ও পরবর্তি সকল সরকারের কর্মকান্ডের বৈধতারও প্রস্তাব করা হয়।

১৯৯১ সালের ২রা জুলাই জাতীয় সংসদে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তখনকার বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত একটি বিল আনয়নের আহবান জানান। তাতে তিনি উল্লেখ করেন ‘আমি সংসদ নেত্রীকে (বেগম খালেদা জিয়া) আহবান জানাচ্ছি, আপনি একটি বিল নিয়ে আসুন, যে বিলে চতুর্থ সংশোধনী থেকে শুরু করে এরশাদের দশম সংশোধনী পর্যন্ত সব সংশোধনী বাতিলের ব্যবস্থা থাকবে। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি যে, আমরা অবশ্যই তাকে স্বাগত জানাবো এবং সে বিল পাস করার ব্যাপারে সব রকম সাহায্য-সহযোগিতা করবো।’ কিন্তু বাস্তবে এরকম কোন বিলা আনা হয়নি। সামরিক সরকার এবং অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যদি সামরিক ও অবৈধ সরকার ক্ষমতা দখল না করতো তাহলে বাংলাদেশ অনেক আগেই উন্নত দেশের সারিতে পৌঁছে যেত।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে আর  যেন কোন অবৈধ ও সামরিক সরকার ক্ষমতা দখল করতে না পারে সেজন্য অবশ্যই রাজনৈতিক সরকারগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে সর্বাত্মক ভূমিকা থাকতে হবে। সেটা সম্ভব হলে অবশ্যই বাংলাদেশ সোনার বাংলায় রূপ নেবে।