অতীত শুনেছি দেখছি বর্তমান

অতীত শুনেছি দেখছি বর্তমান

যতই ঝরুক শিশির বিন্দু, তবু কোনদিন ফুটবে না যে ফুল, ফুটবেই না সে বিলকুল। জন্ম থেকে আজ অবধি এক অভিন্ন কেবলই কলি সদৃশ। সে তো আমাদেরই চিরন্তন চির সবুজ মুকুল। আমাদের মুকুল দা। মুকুল দাস। নিজ প্রশংসায় আগাপাশতলা দারুণ গদগদ, সমালোচনায় কখনো রুদ্র কিংবা চন্ডমূর্তি নয়। তখন শুধুই অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ- অন্ধকার তাকে ঘিরে রয় সারাক্ষণ। প্রকাশ্যে তার কোন শত্রু তিনি নিজে ছাড়া অন্য কেউ আছে আমার অন্তত জানা নাই। গান পাগল এই মুকুল দা ‘দূরের আর্তনাদে নদী ক্রন্দন কোন ঘাটে’ এই গান যখন মুকুল দার কন্ঠে গীত হয়, তখন আমি অবাক হয়ে শুনি, আর ভাবি ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণি?’ গান করেন এখনো? না করতেন। ভালোবাসেন নৃত্য। তবে আসক্তিটা ধ্রপদী নৃত্যে, অন্যকিছু নয়। তবলা, অর্থাৎ তাল? পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত এমন কোন তালের জন্ম হয়নি যেটা সে নিজের মতো করে তালিয়ে অর্থাৎ বাজিয়ে নিতে পারেন না। এক সময়কার মঞ্চ নাটকের দাপিয়ে অভিনয় করা অভিনেতা দাবি করেন নিজেকে প্রায়শই। প্রখর স্মৃতিশক্তির ধারক এই মানুষ মুকুল দা। একবার কিছু একটা শুনলে সেটা তিনি মনে রাখতে পারেন দিনের পর দিন। একসঙ্গে মঞ্চে অভিনয় করতে যেয়ে দেখেছি, নিজের কোন সংলাপ তার মনে থাকতো না কখনো, তবে অন্যরা কে কখন কতবার কোন সংলাপ কোথায় ভুল করেছে, সেটা সে খুব ভালোই মনে রাখতে পারতেন।

এ শহরের বিভিন্ন বয়সের (অন্তত চারজন) মানুষ। যারা সুযোগ পেলেই একে অপরের বিষোদগার করতে একদম মুখিয়ে থাকে। অথচ অদ্ভুতভাবে দেখেছি দিনের পর দিন তারা সবাই মুকুল দার অজস্র ছোট মাঝারি বড়ো প্রয়োজনগুলো আড়ালে আবডালে সমাধান করে থাকেন। এ জন্য মুকুল দাকে কখনো আগবাড়িয়ে কিছু বলতে হয় না। তারাই একধরণের বাধ্যবাধকতা থেকে কাজগুলো গুছিয়ে ফেলেন। প্রশ্ন হতেই পারে এই শহরের এত মানুষের মধ্যে মাত্র চারজন কেন? হয়তো আছে আরো বেশি। যা আমার অন্তত জানা নাই। আর একটি নাম অবশ্য লেখা যেতো, সে নিখিল সেন। সে পথ আমাদের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। আর সম্ভব নয় তাকে সচল করা। তা হলে বাকি চতুষ্টয় কারা?

এদের একজন জ্ঞানী এবং গুণী মানুষ, লেখক প্রাবন্ধিক ঔপন্যাসিক, কবি, গবেষক,  ইতিহাসবিদ জনাব সাইফুল আহসান বুলবুল। অদ্ভুত সম্পর্ক তাদের। পরস্পর মুখদর্শনে তারা যে ভাষার প্রয়োগ করেন, তা নিজ কানে না শুনলে অন্য কারোর পক্ষে বিশ্বাস করানো সম্ভব নয়। ‘খোচা’ আর ‘মোচা’ শব্দ সঞ্চালনের ক্ষেত্রে তাদের যে সাবলীলত্ব, সে অবিশ্বাস্য। আবার মুহূর্তেই একে অপরের শরীরের খোঁজ-খবর আর বিশ্ব আলোচনায় তারা এক আত্মা এক প্রাণ।

 আছেন শহর নাট্য সাংস্কৃতিক কর্মযোগের স¦ঘোষিত মোড়ল। দৃপ্ত চেতনাধারী, মোয়া-মুুড়কির মতোই নাটকের ফেরিওয়ালা, নাটক নিয়ে ছুটেছেন দেশ-বিদেশে। নানাবিধ গুণে গুণান্বিত আপন মহিমায় ভাস্বর নাট্য ও সংস্কৃতিজন জনাব, সৈয়দ দুলাল। মুকুল দা আজও যে অগ্নি শলাকা ছাড়তে পারেননি তার সকল দায় সৈয়দ দুলালকে দেওয়া যায়। শহরের রাস্তায় হঠাৎ দামি নূতন পাঞ্জাবী গায় মুকুল দা, কাঁধে তার রঙিন ব্যাগ, না এর জন্যে কোন উৎসব পার্বনের প্রয়োজন নেই। আপনি শুধু জিজ্ঞেস করুন মুকুল দা কি খবর, কোথায় গিয়ে ছিলেন? অমনি দেখবেন হাতের জলন্ত অগ্নি শলাকায় দীর্ঘ এক টান দিয়ে ধোঁয়া মিশ্রিত মুখে ভূবন ভুলানো এক হাসি ছড়িয়ে বলবে ‘দুলাল ডেকেছিলো’!

এই নামের তৃতীয় সারিতে আছে বেশ কিছু নাম মুরাদ, মিরণ, বিশ্বনাথ, ক্লিক কাজল, কাজী সেলিনা কিংবা মুকুল দার মতে টুম্পা। বলা যায় এরা সবাই মুকুলদার ভালো মন্দ প্রয়োজনগুলির এক ধরনের সমাধান। এই সারিতে নিজের নামটা লিখবার সুযোগটা পেয়েও লেখা গেল না। ঢোল পেটানো হবে তাই। তবে স্বশব্দে ঢোল পেটানো যেতো কাজল দার নামে। যার হাত ধরে বহুবার মুকুল দা বসেছেন অনেক বড় বড় মঞ্চের চেয়ারে। হয়েছেন নন্দিত।

এবার সর্বশেষ যে নামটা লিখবো সেটা এই শহরের অজ¯্র গুণি বাপ্পীদের মধ্যের অন্যতম মারিফ বাপ্পি। মুকুল দা যার কাকা। বাপ্পির ভাষায় ‘মুকুল দা হলো আমার বাবার একমাত্র জীবীত বন্ধু।’ অতএব এহেন সন্তানের কাছে বাবারও আব্দারগুলো বড়ই অদ্ভুত। যা শুনলে যে কারোরই মনে হতে পারে এ নিশ্চয়ই কোন কাজের বিনিময় মূল্য পরিশোধিত হচ্ছে। কিন্তু মোটেই বিষয়টা তেমন নয়। তার এমন বিষয়গুলো এখন আমাদের সবার কাছে যথাযথ এবং অনুমোদিত। এইতো সেদিন বাপ্পির কোন ঘনিষ্ঠজনের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতে কবি আসাদ চৌধুরীকে রাজি করিয়েছিলেন মুকুল দা। বইয়ের নাম ছিলো ‘আত্ম সঙ্গম’। বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের পরে পত্রিকায় ছাপা হলো, আজ আসাদ ভাইয়ের বই আত্ম সঙ্গমের মোড়ক উন্মোচিত হলো। যদিও পত্রিকায় ভুল বসত ‘ত্ম’ জায়গায় ছাপা হলো ‘মার’! খবরটা মুকুল দার মাধ্যমে আসাদ ভাই শুনে শুধু বলেছিলো ‘ছি, ছি মুকুল এটা কি করে হলো? এর উত্তরে মুকুল দা আমাদের বলেছিলো এতো মোড়ক উন্মোচন নয়, এতো মোরগ বধ হলো।

আমি জানি, এমন পরিস্থিতিতে যে কেউ বলে বসতে পারে কি ব্যাপার আমার/আমাদের নামটা কই? এই যে সেদিন আমি, অমুকদিন সে, কলাটা মুলোটা ধরিয়ে দিলাম তার বেলা? আছে তেমন উত্তরও, আছে ঢের। বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক ড. নূরুল আনোয়ার থেকে প্রয়াত ওয়াহিদুল হক, দ্বিজেন শর্মা, নিখিল সেন। আছেন দীপংকর চক্রবর্তী যিনি তার মুখে মুখে সর্বদা ফেরেন মনু হয়ে। আছেন বদিউর রহমান যিনি সরাক্ষণ খোঁজ রাখেন মুকুল দার। 

আমি এরকম আরো জনা পাঁচেকের নাম বলে দিতে পারবো যারা প্রায়শই মুকুল দাসের নানা আবদারের মিসকলে ভাজাভাজা হতে থাকেন। তার পরেও কেউ কখনো একেবারেই বিমুখ নয় তার প্রতি। এখনো যে কারোর ডাকে শরীরের সকল রকম বৈরীতাকে উপেক্ষা করে এই মুকুল দা সর্বত্রই সরব। বিনিময়ে শুধু চাই মঞ্চে আসন আর মাইকে কথা বলবার সুযোগ। আমাদের সবার মতোই মুকুল দাও এখনো নামের আর প্রশংসার কাঙ্গাল। অদ্ভুতভাবে এখনো অবলীলায় অনবরত নানান ছল ছুেতায় পারেন নিজের প্রশংসা করতে। 

তার এই নিদারুণ সরলী পথ চলা দেখে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ড. নূরুল আনোয়ার একবার মুকুল দাকে বলেছিলেন, নিতান্তই ব্যক্তিগত আলোচনায়। ‘মুকুল তুমি না আসলে একটা চাইল্ডিস পার্সোনালিটি।’ এমন একটি কথাও আমাদের মাঝে অত্যন্ত সফলভাবে বাজারজাত করেছিলেন মুকুল দা নিজেই।

আজকের এই মুকুল দাস অত্যন্ত সহজ সরল স¦াভাবিক এবং একই সঙ্গে সহজলভ্য। একদিন ছিলো যখন তার ধারে কাছে যাবার যোগ্যতা আমাদের মতো অনেকেরই ছিলো না। এই শহরের অত্যন্ত উজ্জল সংগীত নক্ষত্র ছিলেন আমাদের এই মুকুল দাস। ভূপেন, কিশোর, মান্নাসহ অজ¯্র কালজয়ী শিল্পীদের গানের পাশাপাশি প্যারোডিরও সফল শিল্পী মুকুল দাস। অত্যন্ত দক্ষ গণসংগীত শিল্পীও তিনি। জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেও এখনো চেষ্টা করেন গানের সুরে কন্ঠ মেলাতে। একেবারেই ছাড়তে নারাজ সিগারেট। এখনো নন্দিত নামের আসরের সকল নিন্দাকে পিছনে ফেলে উদ্বেলিত হয় তার মন। ভূবন ভোলানো হাসি খেলে যায় মুখমন্ডলে। তার সকল স্বেচ্ছাচারিতার লাগাম টেনে রাখেন তাপু, তাই তিনি সারাক্ষণ ভীতসন্ত্রস্ত এবং একই সঙ্গে শ্রদ্ধাবনত নিজ স্ত্রীর প্রতি।

সর্বজ্ঞানী তিনি নন, তার পরেও কেউ যখন অতি প্রশংসা করতে যেয়ে বলে বসেন উনি সবজান্তা, তখন দেখেছি মুকুল দা অদ্ভুত নির্ভার বসে মিটিমিটি হাসেন। সুবক্তা সে। অবলীলায় নিখিল স্মরণাঞ্জলিতে দাঁড়িয়ে বলে দিতে পারেন ‘নাই খিল যার তিনি নিখিল।’ পদ্মভূষণ আর পদ্ম শোষণের আভিধানিক ব্যাখ্যায় তার মতো সহজাত পারাঙ্গম আর কে আছে? সকালে ঘুম থেকে উঠে নিত্য কর্ম তার সবাইকে মিসকল মারা। না, শুধুই এই শহর নয় দেশব্যাপী। তারপর ধীরে ধীরে ফিরতে থাকে সেই কল। এভাবেই দিনভর কথা বলে বলে সবার কুশল জেনে জেনে দিন অতিবাহিত করেন মুকুল দা। কখনো বিড়ম্বনাও ঘটে। এভাবেই একদিন শাহনেওয়াজ ভাইয়ের ফোন ‘এই লাবু এ্যারে কয়কি? মুকুল দারে তোরা কিছু কইতে পারো না? সকালে মিসকল দিয়া ঘুমডা ভাঙ্গাইলো, এহোন এতো ফোন দেই পাই না। ফোন বিজি।’ এভাবে আমাদের অনেকেরই কেটেছে অনেক দিন। তার পরেও দিন শেষে একবার ফোন দিয়ে তার সঙ্গে কথা না বললে মনে হয়, কি যেন অপূর্ণ থেকে গেলো আজ। এমনই এক মানুষ মুকুল দাস।

অবসর জীবনে সীমাহীন সময় থাকে অনেকের হাতেই। তাদের অনেকেই ধীরে ধীরে এক ধরণের একাকীত্বের আবরণে আচ্ছাদিত হতে থাকেন। সে আবরণ ভাঙতে পারেন খুব সীমীত কিছু মানুষ। যারা গতানুগতিকতার বাইরে এসে নিজেদের তুলে ধরতে পারেন। মুকুল দা তাদেরই একজন। যদিও এই কর্মে শ্রেষ্ঠত্ব আছে আর এক জনের নাম, তিনি হলেন অধ্যাপক বদিউর রহমান। এখনো অনবরত সবার কুশল জানতে ফোন করেন। তার ফোন এলেই মনে হয়, কেন এক মিনিট আগে আমি তাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না, আপনি কেমন আছেন? এ দারুন লজ্জার জানি, বুঝি, তবু ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে যেন কঠিন নির্লজ্জই হয়ে চলেছি প্রতিদিন। এ বিষয়টি ভাঙা দরকার আমার এবং আমাদের শ্রদ্ধেয় অগ্রজদের, আর সকল অনুজদেরও। তা না হলে ক্রমশ আমরা সবাই ভালো থাকবার নামে পানসে করে তুলবো পারিপার্শ্বিক সবকিছু।

এই যে কলম হাতে কিছু লিখতে বসার বোকামি বা দুঃসাহস, এর পিছনে আছে তিন ‘ম’। মুকুল, মুরাদ, মিরণ, উৎসে শ্যামল। এদের গুণাগুণের বিষদ বিবরণ একেবারেই প্রাসঙ্গিক নয়। যদিও আমায় এই সাহস করতে বাধ্য করেছিল ব্রজমোহন বিদ্যালয় আর সত্য, প্রেম, পবিত্রতার প্রতি আনুগত্য। শ্রী জয়ন্ত কুমার দাশগুপ্ত স্যারের প্রতি অপার শ্রদ্ধা। যার কাঠামোগত আদলের মূলে ছিল সাবের আহমেদ, পি. কে. সেন আর নরেন স্যারদের মতো মানুষ শিক্ষক। যাদের মধ্যে পি. কে. সেন স্যারকে নিয়ে লেখা হয়েছিল স্মারকগ্রন্থ ‘চরণ রেখা তব।’ আর এই সমগ্র বিষয়টির সম্পাদনার দায়িত্ব সম্পাদিত হয়েছিল মুকুল দাসের হাতে।

যদিও এই মুকুল দা এখন মিসকল মুকুল নামেই সব থেকে বেশি পরিচিত। তবে যে দিন তার ফোনটি মিসকল নয়, সরাসরি ফুলকল দেয়, সে দিনই আমাদের হাত কেঁপে ওঠে। ধরতে ভয় লাগে। কারণ এ এখন সর্বজনবিদিত, তার ফুলকল মানেই মৃত্যুর সংবাদ। যে মানুষ অত্যন্ত সাবলীল মিসকলে, সে কখনোই কারো মৃত্যুর খবরে মিসকল প্রদান করেন না। এই ব্যতিক্রম মানুষটিও মুকুল দাস।

দারুণ স্মৃতি প্রখর মানুষ মুকুল দাস। কি করে সে এতোকিছু মনে রাখেন সত্যিই বুঝে ওঠা ভার। আমরা দেখেছি তার এমন স্মৃতি নির্ভর অজ¯্র লেখা। পড়েছি, যেনেছি এই শহর ও তার আদি অনেক জ্ঞানী গুণীদের সম্বন্ধে। দিনের পর দিন এই লেখাগুলি লিখেছেন মুকুল দা। পনের আগস্ট বাংলাদেশের সবথেকে বিপর্যস্ত সেই রাতে, যে রাতে খুণীরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিলো। সেই নৃশংস খুনীদের হাত থেকে দৈবক্রমে সেই বেঁচে গিয়েছিলেন মুকুল দা। বরিশাল ক্রিডেন্স ব্যান্ড দলের সঙ্গে সেই রাতে মুকুল দাও ছিলেন শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত সাহেবের বাসায়। যেখানে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল দলের গীটারিস্ট শিল্পী আবদুর নইম খান রিন্টুকে। মুকুল দার সব কিছু মনে থাকে, মনে আছে। তিনি সব কিছু লেখেন, বলেন তবু কখনো সেই রাত্রির কথা লেখেন না, বলেন না। জিজ্ঞেস করলেই বলেন আমার ভয় করে।

তবে নির্ভয়ে যখন তিনি লেখেন সেই লেখার একটা বিশেষ গুণ থাকে সেটা হলো, কোন না কোনভাবে নিজের এবং তাপু অর্থাৎ স্ত্রীকে সম্পৃক্ত করা। এ ব্যাপারে তার মতো এতোটা সাবলীল আর কাউকে দেখেছি মনে পরে না। বিষয়টি নিঃসন্দেহে অদ্ভুত। আসলে এতটাই অদ্ভুত অসাধারণ মানুষ মুকুল দাস। যার সঙ্গে এমন কথাগুলোও প্রকাশ্যে সহজেই আলোচনা করা যায়। একটা সময় স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন, কিছুদিন সাংবাদিকতার   সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। নাটক না দেখে তার মতো নাট্য সমালোচনা লেখবার যোগ্যতা সে খুব কম লোকের দেখেছি। উদাহরণ: বরিশাল নাটকের নাটক ‘সখিনার’ মেহেন্দিগঞ্জে     মঞ্চায়ন শেষে মুকুল দা লিখলেন ‘অত্যন্ত সফল হয়েছে নজমুল হোসেন আকাশের নাটক ‘সখিনা।’ চরিত্র বিশ্লেষণ করতে যেয়ে তিনি লিখলেন ‘টেনু চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন, তাকে দেখে মনে হয়েছে এ যেন টান বাজারের টেনু।’ অথচ আমরা জানি তিনি নাটক দেখতে আমাদের সঙ্গে মেহেন্দিগঞ্জেই যাননি! বরিশালের প্রদর্শনী দেখেই মেহেন্দিগঞ্জেরটা চালিয়ে দিয়েছেন। দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল তার সেই লেখা। অনেকেই অনুসন্ধানী হয়েছিল তার টানবাজার জ্ঞানের প্রতি।

নিখিল দা মুকুল দার কেমিষ্ট্রি শুরুতে কিছুটা হালকা উপস্থাপিত হয়েছে। দাদা থাকলে আরো অনেক রসালো কিছু অবশ্যই লেখা যেতো। হলো না তা। তবে মানব দার সঙ্গে মুকুল দার কেমিষ্ট্রির কিছু স্যাম্পেলতো দেওয়া যেতেই পারে। সেদিন আমরা সবাই অপেক্ষায় বনা’র মিটিংটা শুরু হতে একটু দেরি হচ্ছিলো। এলেন মানব দা, এসেই মুকুল দাকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘কে মুকুল দা নাকি? ভালো আছেন দাদা? নমষ্কার।’ দেখলাম মুকুল দা খুব গম্ভীর। আমরা জানতে চাইলাম কি ব্যাপার দাদা, কি হয়েছে? মানব দা হাসতে হাসতে পকেট থেকে একটি মোবাইল মেসেজ আমাদের সামনে ধরে বললো দেখো। ওর মিসকল ধরিনাই দেইখ্যা কি লেখছে দেখো। আমরা মেসেজ পড়ে স্তম্ভিত, যার পরনাই বিস্মিত। সেখানে লেখা ‘আরে কাইস্টা বাওন, আপনা গলিমে সব কুত্তাভি শের হোতা হ্যায়।’ আমরা কি ভাবতে পারি মানব দাকে এমন ভাষায় কিছু লিখবার বা বলবার কথা? এ সম্ভব কেবল কোনদিন না ফোঁটা এই মুকুলের পক্ষেই।

মুকুল দা মাঝে মাঝে বেশ কিছু গল্প, কথার ছলে বলে ফেলেন। সে মজার কথাগুলো লিখবার নয়। কখনো নিজের ভিতরে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়ে মুরাদ, মিরণ কিংবা খুব কাছের দু-একজনকে বলে হালকা হতে হয়। তবে মুরাদ মিরণের কান থেকে সেসব গল্প পাঁচ কান হয়েছে কিনা সে কথা আমি বলতে পারবো না। তবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি হাতে গোনা দু-একজন ছাড়া আমিও কাউকে বলিনি। এরকমই তার মুখে মুখে বলা এক অসাধারণ গল্প ‘কেন হবে না, হবে হবে।’ এটি আমার মনে হলে প্রায়শই একা একা যখন তখন যেখানে সেখানে বসেই হেসে উঠি। তবু কাউকে বলতে পারি না। কারন কেউ যদি প্রশ্ন করে কোথায় কার কাছে পেয়েছো? আমি কি বলতে পারবো মুকুল দার কথা, সেকি সম্ভব, বলা কি যায়, তার মতো একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির কথা? তাই এসব কথা মনের মধ্যে চেপে রাখি আর সময় করে একা একা হাসি! আমি জানি, সবারই মনে মস্তিষ্কে এমন অনেক কথা আছে, থাকে। যে কথাগুলো অব্যক্ত, অনুচ্চারিতই থাকে মনের গহীনে। যা নিতান্তই একার।  

হয়তো এমন কথাগুলো মনের গহীনে থাকে বলেই মানুষ হাসে, কাঁদে এবং বেঁচে থাকে। যা কেবলই অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ অন্ধকার নয়। আছে অপার আলোর তীব্র উজ্জ্বল ঝলকানিও। যা আমাদেরকে আলোকিত করে। অতএব তাকে নিয়ে কিছুতো বলবোই। আজ যে মুকুল দা সত্তরের কোঠায়, কাল সে আশি কিংবা নব্বই নয়। আমরা শতবর্ষ অতিক্রান্ত না ফোঁটা মুকুলকেই অনবরত দেখতে চাই। দেখতে চাই আজকের মতই আনন্দময়, স্বতস্ফূর্ত, হাস্যোজ্জল, প্রাণবন্ত এবং পরিপূর্ণ মুকুল দাসকে। 

এ লেখাটিও শেষ করে আমি তার কাছেই নিয়ে যাবো। সঙ্গে থাকবে বরাবরের ন্যায় মুকুল দার প্রত্যাশা পুরণের উপকরণ ‘অগ্নিশলাকা’। যার অগ্নিদহনে পুড়ে পুড়ে অশুদ্ধ বানানগুলো শুদ্ধ হয়ে ফিরে আসবে। লেখাটা আমার হাতে দিয়ে হয়তো বলবে ‘ভালোই লিখেছো। তবে মনে হচ্ছে একটু খামতি থেকেই গেলো। আমার কপাল ফাঁটার বিষয়টা উল্লেখ করবার যথেষ্ট সুযোগ ছিলো। লিখতে পারতে যে, আমি আমারই ফাঁটা কপালের রক্ত মেঝেতে দেখে ভেবেছিলাম, আজতো বৃহস্পতিবার, তোমার বৌদি পায়ে আলতা লাগান। হয়তো তারই খানিকটা মেঝেতে পরে আছে, আমি দেখেও বুঝতে পারিনি ওটা আমারই ফাঁটা কপালের রক্ত!’ আমরা এবার ভাবতেই পারি রক্তের রঙ না হয় মিলে যায় বৌদির পায়ের আলতার রঙের সঙ্গে। কিন্তু তার কপাল ফাঁটার ব্যথাটা বৌদির দেওয়া কোন ব্যথার সঙ্গে একাকার হয়ে যায়? আমি জানি এরও চমৎকার উত্তর জানেন মুকুল দা। আমি চেষ্টা করলে তাও হয়তো বলতে পারি। কিন্তু না, আজ আর বলবো না। নন্দিত আদলে তাহলে নিশ্চিত নিন্দিত হব আখেরে। তাই কিছু ইশারা দিয়ে রাখলাম। শুনেছি ‘সমঝদার কে লিয়ে ইশারাই কাফি’।    

তবে জানি না, এই লেখা নুতন কোন পথিক প্রবরকে আমাদের সামনে তুলে ধরবে কি না? যদি হয় যারপরনাই আনন্দিত হবো আমরা।


লেখক: আজমল হোসেন লাবু, আবৃত্তি শিল্পী ও বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য।