অহিংস ও নিরহংকার হোন

কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যেজন খুঁজি তারে আমি আপনা’। নজরুল তাঁর এই গানে মূলত নিজের নিজেকে জানতে চিনতে ও বুঝতে আহ্বন করেছিলেন। কিন্তু আমরা আপনার চেয়ে আপনাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ ও প্রচার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। করোনার মহামারীও আমাদের এই আমিত্বকে দমাতে পারেনি। সারা দুনিয়ায় মানুষের মৃত্যুর মিছিল দেখেও আমরা আমাদের ভুলে আমিকে উর্ধ্বে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। সর্বত্র আমার এবং আমির জয়গান। তুমি কিংবা তোমরা শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে আমির অহমবোধের ¯্রােতে। অহংকার আর হিংসা আমাদের ভেতরের মানবিক আমিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাই আমাদের বেশিরভাগ অর্জন আমাদের হতে পারছে না। হয়ে যাচ্ছে ব্যক্তির। মানুষের এই আমিত্বর অহংকার এবং হিংসা দূর না হলে নিজেকে চেনা-জানা তো হবেই না, বরং আমাদের ভালো অর্জনও ম্লান করে দেবে।
আজ ‘দশের লাঠি একের বোঝা’ প্রবাদও হার মানতে বাধ্য হচ্ছে আমি এবং আমার হিংসা-অহংকারের কাছে। এখন রাজনীতির মঞ্চ থেকে শুরু করে, প্রশাসন, সামাজিক সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রেই শোনা যায় আমির জয়গান। আমাকে ছাড়া আর যা কিছু তা অতি ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ। আমি না হলে কোন কাজই সম্ভব হয় না এবং হবে না। আর এই আমির আওয়াজে দশজনে মিলে যে কাজটি হয়েছে তা একজনের হয়ে যাচ্ছে। দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে এই আমির আওয়াজ যারা তোলেন তারা একবারও ভাবেন না যে অর্জন ও সার্থকতা, তা তার একার নয় এবং একার পক্ষে করাও সম্ভব নয়।
আমিত্বকে লালন করা ব্যক্তিরা বলেন, আমি যা করেছি তেমনটি আর কেউ করতে পারেনি। একধরণের অহংকার থেকেই এমন শব্দ ব্যবহার হচ্ছে। এমন ঘটনা ঘটছে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার বিতরণের ক্ষেত্রেও। কোন প্রশাসন ৫০০ জনকে সহযোগিতা দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর গেলেন। কেউ আবার সেখান থেকে ১০০০ জনকে দিয়ে আমিত্ব জাহির করেন। তাকে ছাড়িয়ে যে বা যিনি ১৫০০ কিংবা ২০০০জনকে সহযোগিতা দিচ্ছেন তিনি তো উদাহরণই সৃষ্টি করে ফেললেন। এই আত্মতুষ্টির বাণী শুনতে হচ্ছে প্রতি দিন, প্রতিক্ষণ। অথচ সহযোগিতা বেকলই সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে। সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তারা কেবল তৃণমূলে পৌছে দেওয়ার কাজ করছেন। তাহলে কেন এমনটা হয়? যে ৫০০ জনকে দিয়েছেন সেটাও সহযোগিতা আবার যিনি ১৫০০ কিংবা ২০০০জনকে দিয়েছেন সেটাও সহযোগিতা। তাহলে এমন উক্তি কি আমিত্বকে জাহির করার নামান্তর নয়? এমন অবস্থার পরিবর্তন না হলে করোনার মতো মহামারী আমদের মুক্তি দেবে না। তবে এটাও সত্য যে, এর ব্যতিক্রমও আছে। অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা আছেন নিজস্ব উদ্যোগে অসংখ্য মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সহযোগিতা করে চলেছেন নিভৃতে। কখনো কারো কাছে বলতেও যাচ্ছেন না। সেটা কেবলই ব্যতিক্রম।
আমরা জানতাম দান হচ্ছে এমন, ‘ডান হাত দিয়ে দিলে যেন বাম হাত জানতে না পারে’। এখন হচ্ছে উল্টো। ডান আর বামের মধ্যে হলে হবে না, গোটা সমাজকে জানিয়ে তারপর দিতে হবে। একই সঙ্গে ওই সমাজে আর কোন মানুষ এমন সহযোগিতা দিয়ে থাকলে তাকে ছোট করতে হবে। নিজেরটাই বড়, অন্যেটা একদমই তুচ্ছ। এই আমির হিংসা আর অহংকার আমাদের মানসিকতাকে নীচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আপনার কাজ কেবল আপনার তো নয়, আপনাকে আপনি বানাতে পেছনে যারা কাজ করছে তাদের কথা বলুন। অন্যকে স্বীকৃতি দিলে আপনি ছোট হবেন না। প্রকারন্তরে তাদের অনেকের চেয়ে বড় হবেন।
আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও চলছে এই আমিত্বের বাহাদুরী। যারা সাংস্কৃতিকে নেতৃত্ব দেন। তারা মঞ্চে, নাটকে কেবল নিজেকেই জাহির করেন। আজকের যিনি নেতা হয়েছেন, তাকে যে এই পর্যন্ত এনে দিয়েছেন তার কর্মীরা সেটা তিনি ভুলে যান। তারা কেবল বলে বেড়ান আমি এটা করেছি, ওটা করেছি। তিনি বা তার বাইরে সংস্কৃতি সমাজে কোন কাজই হয়নি। এসব শুনে যারা তাদেরও আগে সংস্কৃতি চর্চা শুরু করেছিলেন তারা হা হয়ে যান। আমির সংস্কৃতির চাপে তারা চ্যাপ্ট হয়ে যান। যতো কিছুই বলেন, আমরা বললে যদি আমি ছোট হয়ে যাই, তাই আমি ছাড়া কখনো আমরা বলতে পারবো না।
রবীন্দ্রনাথের একটি গানের লাইন দিয়ে শেষ করতে চাই, ‘অনেক কথা যাও যে বলে কোন কথা না বলি, তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি’।