আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর

আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর। ভোলাসহ উপকূলবাসীর বিভীষিকাময় এক দুঃস্বপ্নের দিন। ১৯৭০ সালের এই দিনে বিস্তীর্ণ এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে ধ্বংসলীলায় পরিণত হয়। মুর্হর্তের মধ্যেই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলচ্ছ্বাস ক্ষত-বিক্ষত করে দেয় ভোলার বিভিন্ন এলাকার জনপদ। ওই ঝড়ে ভোলায় হারিয়ে যায় দের লক্ষাধিক প্রাণ। নিখোঁজ হয় সহস্রাধিক মানুষ।
এক এক করে ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও কান্না থামেনি স্বজন হারা মানুষের। রয়ে গেছে সেই ক্ষত। এই দিনটি স্মরণে ভোলায় দোয়াসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু এতো বছর পরও ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় ভোলায় প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। তাই দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষ আজও প্রাকৃতিক দুযোর্গ আর জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকিতে রয়েছে।
৭০’এর ১২ নভেম্বর ঝড়ের প্রত্যক্ষদর্শী মতলব মুন্সি জানান, সেই দিন ছিল গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাস। সন্ধ্যার পর মুহূর্তের মধ্যেই ভয়ঙ্কর রুপধারণ করতে থাকে ঝড় । গভীর রাতে শুরু হয় ঝড়ের তাণ্ডব। হারিকেনরূপি জলচ্ছ্বাসের সময় ঝড়টি ভোলাসহ উপকূলীয় ১৮টি জেলায় আঘাত হানে। তৎকালীন তথ্যপ্রযুক্তি অনেকটা দুর্বল থাকায় উপকূলে অনেক মানুষই ঝড়ের পূর্বভাস পায়নি। এ সময় তিনদিকে নদী ও একদিকে সাগরব্যাষ্টিত দ্বীপজেলা ভোলায় জলচ্ছ্বাস হয়েছিল ৮/১০ ফুট উচ্চতায়। রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, খাল-বিল, নদী-নালয় ভাসছিল লাশ আর লাশ। এমনকি গাছের সাথে ঝুলে ছিল শত শত মানুষের মৃতদেহ। বহু মানুষ তাদের প্রিয়জনের লাশ খুঁজেও পায়নি। তখন বাঁচতে কেউ গাছের ডালে, কেউ উঁচু ছাদে আশ্রয় নিয়ে কোনমতে প্রাণে রক্ষা পেলেও ১০দিন পর্যন্ত তাদের প্রায় অভুক্ত কাটাতে হয়েছে।
ভোলা সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ৭৫ বছরের বৃদ্ধ কালু মাঝি। সেদিনের জলোচ্ছ্বাসে তার পরিবারের ৭ জনসহ বাড়ির ৩০ জনের মৃত্যু হয়। সেদিনের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, সেদিনের জলোচ্ছ্বাসে হঠাৎ করেই তাদের বাড়ি-ঘর ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তার মা, বাবা, ভাই, বোন একেক জন একেক দিকে ভেসে যায়। এক পর্যায়ে তিনি ও তার এক ভাই একটি গাছ ধরে বেঁচে যান। রাতভর ঢেউয়ের তোড়ে বৃষ্টিতে ভিজে কোন মতে প্রাণে বাঁচেন। সকালে পানি কমে গেলে তিনি দেখতে পান, রাস্তার দুই পাশে মানুষের মৃতদেহের মিছিল। বাড়ি গিয়ে জানতে পারেন তার পরিবারের ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। বড় চাচার বাড়িতে মৃ্ত্যু হয়েছে ৭ জনের। ছোট চাচার বাড়িতে মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের। আরেক খালার বাড়িতে ৪ জন, দুই ফুফুর বাড়িতে ৫ জনের মৃত্যু হয়। তাদের অনেকের মৃতদেহও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেদিন বাধ্য হয়েই ৯০ থেকে ১০০ মানুষের মৃতদেহ বড় গর্ত করে জাতিধর্ম নির্বিশেষে একসাথে মাটিচাপা দেয়া হয়।
প্রলয়ঙ্করী সেই বিভৎস ঝড়ের তাণ্ডবের খবর ঘটনার ৪ দিন পর তখন পূর্ব দেশ পত্রিকায় প্রকাশ হলে দেশবাসীসহ বিশ্ববাসী জানতে পারে। তৎকালিন পূর্ব দেশ পত্রিকার ভোলার সাংবাদিক ও বর্তমান ভোলা প্রেসক্লাবের সভাপতি এম. হাবিবুর রহমান জানান, তিনি ১২ নভেম্বর ঝড়ের পরে সকালে ভোলার শিবপুর এলাকায় গিয়ে দেখেন, অসংখ্য লাশ রাস্তাঘাটে পড়ে রয়েছে। মেঘনা নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছে লাশ আর লাশ। গাছে গাছে ঝুলে আছে লাশ। তখন তিনি ছবি তুলেন। এর পর পুলিশ ওয়ারলেসের সহযোগিতায় ঢাকায় পত্রিকা অফিসে নিউজ প্রেরণ করেন। আর ছবি মাছধরা ট্রলারে করে ঢাকায় পাঠান। তার পূর্বদেশ পত্রিকায় ছাপা হয় ‘কাদো বাঙ্গালী কাদো, ভোলার গাছে গাছে ঝুলছে লাশ।’
এদিকে নদী ও সাগরবেষ্টিত উপকূলীয় দ্বীপজেলা ভোলার মানুষকে প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে বসবাস করতে হয়। ভোলার চর জহিরুদ্দিন, চর মোজাম্মেল, কলাতলীরচর, চরনিজাম, ঢালচর, কুকরি-মুকরি, চর পাতিলাসহ জেলার অর্ধশতাধিক চরাঞ্চলে প্রয়োজনের তুলনায় আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা কম হওয়ায় এসব এলাকায় কয়েক লাখ মানুষ চরম ঝুঁকিতে বাস করছে।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন চর পাতিলা, কুকরি মুকরি ডাল চরের বাসিন্দা আনিছুল, কবির পাটোয়ারি ও জসীম হাওলাদার জানান, তাদের এলাকা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন হওয়ার পাশাপশি দুর্গম। কোন বড় ধরনের দুযোর্গে তাদের মূল ভূখণ্ডে নিরাপদে যাওয়াটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। অন্যদিকে বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলে প্রয়োজনের চেয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের সল্পতা রয়েছে। এতে করে বড় ধরনের কোন দুর্যোগ হলে বহু মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। তাই উপকূলসংলগ্ন ও নদী তীরবর্তী এলাকায় আরও আশ্রয়কেন্দ্র প্রয়োজন বলে তারা দাবি করেন।
ভোলা ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি), উপ-পরিচালক মো. আব্দুর রশিদ জানান, ভোলা জেলায় বর্তমানে ৭৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে । ভোলায় যে পরিমাণ আশ্রয়কেন্দ্র আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাই এখানে আরও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ প্রয়োজন বলে জানান তিনি।