আমাদের রবীন্দ্রনাথকে জানতেই হবে

আমাদের রবীন্দ্রনাথকে জানতেই হবে
‘জয় তব বিচিত্র আনন্দ হে কবি জয় তোমারও করুণা, জয় তব ভীষণ সব কলুষ নাশন রুদ্রতা।’ বিচিত্র আনন্দের ধারক-বাহক রবীন্দ্রনাথ। আনন্দ, বিনোদন, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির মহাসাগর রবীন্দ্রনাথ। গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাশ থেকে শুরু করে সাহিত্যের সব শাখায় বিচরণ করেছেন তিনি একজন চিত্র শিল্পী হিসেবেও সমান পারদর্শী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমাদের কৃষি, সমবায় ব্যবস্থার রূপকারও রবীন্দ্রনাথ। গতকাল ২২ শ্রাবণ আমাদের মহামানব বিশ^ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর দিন। বাংলাদেশ ভারতসহ আমাদের উপমহাদেশ ছাড়িয়ে গোটা দুনিয়ার মানুষ এই মহামানবের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। বিনম্রশ্রদ্ধা জানই আমরাও। রবীন্দ্রনাথ দিগন্ত ছাপিয়ে অনেক উর্ধ্বে উঠেছেন। তাঁর দৃষ্টি আকাশের সীমা ছাড়িয়ে মহাশূন্যের পানে ধাবিত হয়েছে। তাই রবীন্দ্রনাথ তঁর গানে লিখেছেন ‘আকাশজুড়ে শুনিনু ওই বাজে, ওই বাজে, তোমারি নাম সকল তারার মাঝে...।’ সকল তারার মাঝে উজ্জল নক্ষত্রের নাম রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ কেবল বাঙালির ‘আকাশভরা সূর্য তারা’ হয়ে ছিলেন-ই না। আজো রবীন্দ্রনাথ সূর্য-তার হয়ে আছেন আমদের সকল কাজের মাঝে। ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে পাণে, তাই হেরি তাই সকল খানে, আছে সে নয়ন তারায় আলোকধারায়, তাই না হারায়, ওগো তাই হেরি তাই যেথায় সেথায় তাকাই আমি।’ মৃত্যুর পর মানুষ হারিয়ে যায়। কিন্তু অনেক মানুষ মরার পর আরও কিংবদন্তী হয়। তেমনই একজন মানুষ রবীন্দ্রনাথ। মৃত্যুতেও হারিয়ে যাননি আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের ভান্ডারকে বহুমাত্রিক অবদানে সমৃদ্ধ করা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭৯তম প্রয়াণ দিবস ২২ শ্রাবণ। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির প্রতিটি আবেগ আর সূক্ষ্ম অনুভূতিকে স্পর্শ করে আছেন। রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতিকে সামনে নিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। তাঁর লেখা গান, কাব্য, সাহিত্য আজো আমাদের পথ দেখায়। আমরা যখনই সমস্যা এবং সংকটে পরি তখনই রবীন্দ্রনাথ আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান। সংকট থেকে উত্তরণের নতুন পথের ঠিকানা খুঁজে দেন। বাঙালি জাতির দৃঢ়তা এবং জয় করার নেশা রবীন্দ্রনাথ। সেই কারণে পাকিস্তানীরা রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু বাঙালি ওই নিষেধাজ্ঞা মানেনি। তখন বেশি বেশি রবীন্দ্রনাথকে চর্চ করা হতো। আজ বাধাহীন বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথকে সেভাবে চর্চা করা হচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথকে না জানলে না বুঝলে আমদের সন্তানরা সামনে চলবে কি করে। আজ সৃজনশীল শিল্প-সাহিত্যের চর্চা হচ্ছে না বললেই চলে। তাই নতুন সংকটে পড়ছে দেশ ও জাতি। সেই সংকট থেকে উত্তোরণ ঘটনাতে হলে আমদের সন্তানদের রবীন্দ্র চিন্তা ও দর্শনের দিকে আকৃষ্ট করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির আত্মপরিচয়। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, প্রাবন্ধিক, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ মানুষের ওপর দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল ছিলেন। তার মতে, মানুষই পারে অসুরের উন্মত্ততাকে ধ্বংস করে পৃথিবীতে সুরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। তাই ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সেই উপাধি বর্জন করেন রবীন্দ্রনাথ। সমাজের কল্যাণেও নানান উদ্যোগ গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পুজোর কথা বলেছিলেন। যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভানুসিংহের পদাবলীতে লিখেছিলেন- ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান... মৃত্যু অমৃত করে দান।’ আবার লিখেছিলেন- ‘প্রেম বলে যে যুগে যুগে, তোমার লাগি আছি জেগে, মরণ বলে আমি তোমার জীবনতরী বাই।’ আবার জীবনের শেষ দিকে এসে কবি লিখেছেন- মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ তাাঁর স্বপ্ন পুরণ করতে আমদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। এমন মহামানব আর জন্ম নেবে কি না আমরা জানি না। তবে এই মহামানবকে চর্চা করলে আমাদের জীবনের অনেক সংকট, দুঃখ, কষ্ট দূর হবে। আমদের প্রজন্মকে রবীন্দ্র চিন্তা চেতনায় গড়ে তুলতে পারলে এই প্রজন্ম নেতিবাচক কাজের সঙ্গে যুক্ত হবে না। মাদকসহ জঙ্গীবাদের সঙ্গে যুক্ত হবে না। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে রবীন্দ্র চর্চার প্রশার ঘটানো দরকরা। আমরা চাই, আমদের প্রজন্ম রবীন্দ্রনথকে ধারণ করুক, রবীন্দ্রনাথকে লালন করুক। কবির শেষ আশা স্বার্থক হবে যদি আমাদের প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথের কর্মময় জীবনকে ধারণ করে।