উদীচীর ৫৩ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে গুণীজন রাবেয়া খাতুনকে সম্মাননা

উদীচীর ৫৩ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে গুণীজন রাবেয়া খাতুনকে সম্মাননা

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ৫৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও গুণীজন সম্মাননা অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত গুণীজন শিক্ষাবিদ রাবেয়া খাতুন বলেছেন, দেশে সাম্প্রদায়িকতা ঠেকাতে হলে মানুষে লোভ কমাতে হবে। ধর্ম এবং লোভের আগুন আমাদের সব কিছু ধ্বংস করছে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক চিন্তার সংগঠন উদীচী তাদের সাংস্কৃতিক কর্মক- দিয়ে এই লোভের আগুন থামাতে পারবে।

শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় নগরীর শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও গুণীজন সম্মাননার আয়োজন করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পগোষ্ঠী বরিশাল জেলা সংসদ।প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে শিক্ষাবিদ ও সংগঠক মিসেস রাবেয়া খাতুনকে সংবর্ধিত করা হয়।

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বরিশাল জেলা সংসদের সভাপতি সাইফুর রহমান মিরণের সভাপতিত্বে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানের শুরুতে সংবধিত গুণী ব্যক্তি মিসেস রাবেয়া খাতুনের কর্মময় জীবনের অংশবিশেষ পাঠ করা হয়। এরপর উদীচীর পক্ষ থেকে তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান মঞ্চে থাকা অতিথি এবং বরিশালের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা। গুণী ব্যক্তিকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন সংগঠনের সভাপতি সাইফুর রহমান মিরণ, মানপত্র পাঠ করেন বরিশাল নাটকের সভাপতি কাজল ঘোষ, মানপত্র তুলে দেন সংগঠনের সভাপতি ও উপস্থিত অতিথিবৃন্দ।

এরপর বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে উদীচীর প্রতিষ্ঠা বার্ষিক এবং সংবধিত গুণীজনকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা হয়।

প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, সংগঠক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট মানবেন্দ্র বটব্যাল, শিশু সংগঠক জীবন কৃষ্ণ দে, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সংসদের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট বিশ^নাথ দাস মুনশী, বরিশাল নাটকের সভাপতি কাজল ঘোষ, উন্নয়ন সংগঠক আনোয়ার জাহিদ, বাংলাদশে মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পুষ্প রাণী চক্রবর্তী, বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি কবি নজমুল হোসেন আকাশ, সচেতন নাগরিক কমিটি বরিশালের সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান এর সভাপতিম-ীর সদস্য শুভংকর চক্রবর্তী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বরিশার জেলার সভাপতি অধ্যক্ষ আ.ক. মো. মিজানুর রহমান, গণফোরাম সভাপতি অ্যাড. হিরণ কুমার দাস মিঠু, ডিডাব্লিউএফ নার্সিং কলেজের চ্যোরম্যান অধ্যাপক মো. জহিরুল ইসলাম, জহির-মেহেরুন নাসির্ং কলেজের চেয়ারম্যান মেহেরুন্নেছা বেগম, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক মারিফ আহম্মেদ বাপ্পি, জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুখেন্দু সেখর সরকার, খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ চক্রবর্তী, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন বরিশাল জেলার সভাপতি রাহুল দাস, বাসদ বরিশাল জেলার প্রকাশনা সম্পাদক কাজল দাস, বরিশাল নাটকের সাধারণ সম্পাদক পার্থ সারথী, উদীচী জেলার সাধারণ সম্পাদক ¯েœহাংশ কুমার বিশ^াস। 
প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও সংবর্ধ অনুষ্ঠানে বক্তারা সাম্প্রদায়িক সহিসংতার বিচার এবং বাক স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার পথ অবাধ করার দাবি করেছেন। সাম্য, স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং একটি মানবিক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিপাগল লাখো মানুষ। অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয় ৩০ লক্ষ শহীদ, সম্ভ্রম হারিয়ে বীরাঙ্গনা নাম নিয়েছিলেন কয়েক লাখ মা-বোন। তাদের আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে তৈরি হয় মহান সংবিধানের চার মূলনীতিÑ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। কিন্তু আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, সেইসব মূলনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শসমূহ নানা ষড়যন্ত্রে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। দেশজুড়ে অব্যাহতভাবে  ঘটে চলেছে নারকীয় সাম্প্রদায়িক তা-ব। মুক্তমত প্রকাশের স্বাধীনতা আজ অবরুদ্ধ, সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ বাধাগ্রস্ত। বাংলার চিরায়ত সুর আজ রুদ্ধ। ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর আস্ফালনের কাছে সহজিয়া শিল্পীরা আজ কুণ্ঠিত। প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার পরিবর্তে সাম্প্র্রদায়িক দোষে দুষ্ট লেখাসমূহ পড়ে বেড়ে উঠছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। বিভিন্ন স্থানে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং এর আদর্শকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু, এ অবস্থা চলতে পারে না।
বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর বছরেও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে আমরা প্রত্যক্ষ করছি সাম্প্রদায়িক হামলা। সাম্প্রদায়িক দানবদের অবাধ বিচরণ আর হুঙ্কারে প্রাণভয়ে শঙ্কিত দেশের  মানুষ। ধর্মের নামে বারবার এমন নৈরাজ্যকর পরস্থিতি তৈরির অপকৌশলসমূহ প্রতিরোধে অবিলম্বে দেশজুড়ে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক তা-বের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করে তার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার সকল নাগরিকের রয়েছে। রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় যেকোন বিষয়ে যে কারোর অধিকার রয়েছে ভিন্নমত প্রকাশের, প্রতিবাদ জানানোর। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ধারাকে রুদ্ধ করার অপচেষ্টা চলছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা কালাকানুনের মাধ্যমে অগণতান্ত্রিকভাবে দমন করা হচ্ছে ভিন্নমত। এ অস্বাভাবিক ধারা বন্ধ হোক। অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নিপীড়নমূলক সকল আইন বাতিল এবং এই আইনে গ্রেপ্তারকৃত সকলকে মুক্তি দেয়া হোক।

স্বাধীনতার অন্যতম মৌল চেতনা ছিল সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে একটি অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদমুক্ত সমাজ গঠন করা। এ কাজে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার আবহমান বাংলার চিরায়ত লোকসংস্কৃতি। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, বাউল, মুর্শিদী, মারফতিসহ মাটির সুরের লোক গান। এ ছাড়াও যাত্রাপালাসহ অন্যান্য মাধ্যমে বাংলার পথে প্রান্তরে অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছেন লালন, হাছন, শাহ আব্দুল করিমের মতো লোক সাধকরা। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চার পথ অবরুদ্ধ। জেলা উপজেলা পর্যায় তো বটেই, খোদ রাজধানীতেও শিল্পচর্চার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। তাই আমাদের দাবি, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যকর শিল্পকলা একাডেমি গড়ে তুলতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা আদর্শ নয়, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধসম্পন্ন সাংস্কৃতিক বলয় ও কেন্দ্র্র গড়ে তুলতে হবে।
নতুন প্রজন্মকে আবহমান বাংলার সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে, সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অটুট রাখতে দেশের প্রতিটি স্কুলে শিল্পকলা বিষয়ক একাধিক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। একইসাথে পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ রহিত করতে হবে। বিভেদ, বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃৃষ্টিকারী সব লেখা ও উপাদান পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিতে হবে। গণতন্ত্র, মানবমর্যাদা ও সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষা পাঠক্রম পুনর্বিন্যাস করতে হবে। নিয়মিত চর্চায় পাঠ্যপুস্তকে সংবিধানের মৌলিক চেতনার অংশ যুক্ত করতে হবে।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নিয়মিত জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়না। পালন করা হয়না মহান মুক্তিসংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত কোনো জাতীয় দিবস। তাই আমাদের দাবি, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে কিনা তা ধারাবাহিক নজরদারির মাধ্যমে নিশ্চিত করা।

জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পুরো বিশ্ব। উন্নত দেশগুলোর একের পর এক পরিবেশ ধ্বংসকারী পদক্ষেপ আর লাগামহীন শিল্পায়নের ফলে মানব জাতির অস্তিত্বই আজ হুমকির মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। তবুও দেশে উন্নয়নের নামে একের পর এক প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসকারী প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। বন উজাড় করে গড়ে তোলা হচ্ছে শিল্প-কারখানা। নানা অজুহাতে প্রান্তিক ও সংখ্যায় মুষ্টিমেয় জনগোষ্ঠীর মানুষদের বসতভিটা থেকে বলপ্রয়োগে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। নিজ দেশেই আজ উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে এসব মানুষ। এসব কর্মকা- মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী।

আলোচনা ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পর আবৃত্তি পরিবেশন করে বরিশাল নাটক পরিচালিত আবৃত্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শিক্ষার্থীরা। সব শেষে  উদীচীর পরিবেশনায় মঞ্চস্থ হয় গীতি আলেখ্য ইতিহাস কথা কও।