এই করোনায় অনলাইনে উত্তরণের জৈষ্ঠ উৎসবকে যদি ছোঁয়া যেত

করোনার সুবাদে প্রায় সবাই মোটামুটি চুপচাপ। বলাচলে বেশ নিরিবিলি সময় যাচ্ছে। অর্থাৎ সময় এখন ছুটিতে। জীবন জীবিকার প্রয়োজনটুকু বাদ দিলে আর সবই প্রায় নির্জিব। বাস্তবার্থে উপায়হীন। বুদ্ধি যে কারো কম আছে তেমন নয়। তবে বিবেচনা বলছে। দাঁড়াও, ধীরে চলো। বুঝে শুনে পা বাড়াও। হয়তো ধৈর্যের সঙ্গে বুদ্ধি বিবেচনার সমন্বয়টুকু এখনও আছে বলেই করোনা সঙ্গে বোঝপরার বিষয়টা বেশ ভালোই চলছে মানুষের। তা না হলে এতদিন হয়তো সুমসান করে দিত পৃথিবী।
মানুষের ভুলের সুযোগে ইতিমধ্যে করোনা হত্যা করেছে প্রায় সাইত্রিশ লক্ষ মানুষ। সংক্রামিত করেছে কোটি কোটি। জায়গা করে নিয়েছে পৃথিবীর সকল জায়গায়। আন্টারটিকা, এভারেস্ট থেকে সাগর-মহাসাগর, কোথায় নয়? যেখানে মানব বিচরণ পর্যন্ত স্বাভাবিক নয়, সেখানে কেমন করে করোনার অস্তিত¦ পাওয়া গেল? ভাল জানি না, নানান কথা শুনে এখন মনে হচ্ছে এই ভাইরাসটিও সম্ভবত হাইব্রীড। জলে স্থলে অন্তরিক্ষে সর্বত্র যার বিচরণ। যদিও তার ধর্মগুণ একটু ভিন্ন। হাইব্রিড মানে তো নিজে সুন্দর। নিজে শক্তিশালী। নিজে সয়ংসম্পূর্ণ। যার ধ্বংস, বৃদ্ধির চাবিটা থাকে আন্যের নিয়ন্ত্রণে। করোনা কী তেমন? না তো, তাকে একটু ছাড় দিলেই সে কতগুণ হবে তার কোনই ঠিক ঠিকানা নেই। অতএব নিয়ন্ত্রণ চাই। কঠোর, কঠিন, নিষ্ঠুর। না পারলেই বিপদ। যার নাম মৃত্যু।
তা হলে যতক্ষণ সকল কিছু মেনে আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছি। ততক্ষণ কি ডান বাম, উপরে নিচে, সামনে পিছনের খবরগুলো নেবো না? এমন জীবন মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়েও প্রাণের আনন্দকে একটু কি অনুভব করা যায় না? করোনা প্রথম বছরের তুলোনায় এখন মানুষ আনেক বেশী আস্থাশীল। ডাক্তারদেরও পিপিইর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মনের সাহস। হয়তো বলবেন অর্থের প্রয়োজনে। সে সত্যতো সবার ক্ষেত্রেই সমান। এই করোনা সময়ে যত মানবিক কর্মযোগ, মূলত তার শেষটা কোথায়? আমরা চাই বা না চাই, প্রকাশ্যে বিশ্বাস করি বা না করি ওই পকেটেই তো? চারদিকে ধর্মাশ্রয়ীদের এত যে চিৎকার, হেদায়েতের বাণী, বেহেস্তের টিকিট অফার। তার শেষ কোথায়? ওই পকেটে। রাজনীতির এত যে বাগাড়ম্বরতা কিংবা তীব্র বিরোধীতা তার শেষ কোথায়? ওই পকেটে। এই যে হঠাৎ সাংবাদিক আটকা পড়ে গেল কি কারণ, ওই মন্ত্রণালয়ের সমস্যাটা হলো কোথায়? ওই পকেটে। তার পরে সাংবাদিক আন্দলোন হুঙ্কার। সেই হুঙ্কার রণে ভঙ্গ দিল কেন, কোথায়? ওই পকেটে। এখন সকল কিছুর শুরুটা আলোতে বাতাসে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে, আর শেষ? পকেটে।
না, থাক। এভাবে নিরস কথার ব্যক্তি কোন অর্থ বহন করে না। এখন চলছে প্রকৃতির আপ্যায়নের মাস, ফলজমৌসুম, অর্থাৎ মধুমাস। অদ্ভুত তামাটে অসহনীয় গরম আর করোনা ছাড়া, সকলই এখন মধুময়। গাছে গাছে এখন অগনিত অংকের না মেলা ফল, রসে টস্টস্। কোনটা রেখে কোনটার কথা বলবো। পানিতাল? আহা যে খায়নি বুড়ো আঙ্গুল ব্যবহার করে তিন চোখা তাল। তালের মজা তাকে কি বোঝানো সোজা? খেতে খেতে এক সময় মনে হবে বুড়ো আঙ্গুলটা বোধহয় অবস হয়ে গেছে। তখন মুখের কাছে নিয়ে, মুখে পুরে দিতে, মুখের টানের যে শব্দটা হতো। সেই উপলব্ধিটা, সে কি আর বলা যাবে এখন? বলা কি যাবে মা যখন জানতে চেয়েছে জামা প্যন্টে কি লাগিয়েছিস এ সব? বলেছি কি কখনো ‘মা ওগুলো তালের সাশ। মা কি জানতো না, সব জানতো। আজ কোথায় সেই মা, আর কোথায় সেই সন্তান?
কোথায় সেই বন্ধুরা, অনায়াসে যারা বেতশ ঝাড়ে ঢুকে বেতফল এনে দিত হাতে? বেতের কাটার টানে কেটে যাওয়া সেই হাত, শরীর। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত জমা। সেই ব্যাথার বিষ হারিয়ে যেত যখন বলতাম এতো সাহস তোর পক্ষেই সম্ভব, আমরা পারতাম না। সেই বীরত্ব গাঁথা ভুলিয়ে দিতো, কাটায় ছেঁড়া রক্তমাখা শরীরের সকল ব্যাথা। এখনো মাঝে মাঝে প্রশ্ন জন্মায় মনে। কেন এই মধু মাসে করমজা আর বেতফলটার জন্ম হলো? যাদের চেহারা সুরাতের সঙ্গে স্বাদ, গন্ধের কোন সম্পর্কই নেই একেবারে। যাকে দেখলেই মুখ ভরে ওঠে রসে, আর মুখে পুড়লেই মুখখানা বিকৃত হয়ে ওঠে বিষ স্বাদে। এ যেন প্রকৃতির বলে দেওয়া। ‘সাবধান থেকো মানুষ থেকে’। সব রসালো মানুষের ভিতরটা কিন্তু সুন্দর নয়। বেতফলের মতো তার ম্লান চোখের পাশে ওর-ই বিষাক্ত কাঁটার রক্তাক্ত আঘাত অপেক্ষায় থাকে!! অতএব সাবধান! সমাজ সংসার রাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রে।
সাবধান! করোনা দাঁড়িয়ে আছে সবার দুয়ারে। তাই পৃথিবীর মতো করে আমরাও চলছি িি.ি নেটে ভর করে। ভাগ্যিস এমন একটি পথ খোলাছিল। কি যে হতো তা না হলে? বোধ করি মানুষ পাগল হয়ে যেত ঘরে বসে বসে। তাই পৃথিবী, করোনাকে ফাঁকি দিতে নির্ভুল চলেছে এই অনলাইনের পথে। স্বীকার করতেই হবে চলেছে। সকল কিছুই যে খুব ভালো চলেছে তেমনটা কিন্তু ঠিক নয়। খরাপটাও ছিল। খারাপের পরিমানকে মেনে নিতে হয়েছে। থেমে যাওয়ার চেয়ে বরং ভালো, এই মনে করে। দেখেছি, অনুভব করেছি এই অনলাইনের সকল ধরন। এখানেও দেখেছি ক্ষমতার নানান ব্যবহার আগেরই মতো করে। ওকে রাখবে না, ও পড়লে আমি পড়বো না। ও গাইলে আমার সঙ্গে না। আবার এমনো দেখেছি। একজন এক অনলাইনে বসে বলছে আমাকে একটু আগে দিতে হবে, এর পরেও আমরা আরো দুই বা অনেক প্রোগ্রাম আছে। কিছু করবার ছিল না। বাইরে যে করোনার নিষেধ? তবু সাধুবাদ জানাই তোমাকেই, হে অনলাইন। সব দিয়েছো। শুধু পারোনি দিতে স্পর্শ আর রসনায় স্বাদ আস্বাধনের সুযোগ।
তা হলেই চলে যেতাম অন্তত ত্রিশ বছর পূর্বের কলেজ করিডোরে। দৌড়ে যেয়ে দাঁড়াতাম ওই উত্তরণ নামের সাংস্কৃতিক সংগনঠটির পাশে। বলতাম দারুন উৎসাহে। জানতে চাইতাম ‘তোমাদের এবারের জৈষ্ঠ উৎসব হবে গো? করবে না আয়োজন এবার’? এই দুর্বিসহ সময় আর ভালো লাগছে না। মনে পড়ছে তোমাদের জৈষ্ঠ উৎসবের কথা। কী চমৎকার ফলজ মধুময় আয়োজনটা। ততধিক মধুময়, ততধিক অর্থবহ ছিল তোমাদের সম্পর্কের বাঁধনটা। কি চমৎকার, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্থ সংগ্রহে সবাই মিলে এই বৃহৎ আয়োজন। যার নাম দিয়েছিলো জৈষ্ঠ উৎসব। না গো উত্তরণ, তোদের আগে আর কেউ এখানে করেনি এই আয়োজন। এই যোগ্যতা তোদের, এ আয়োজন তোদের, এর সকল প্রশংসাও তোদের। এই শহরের জৈষ্ঠ উৎসব আর উত্তরণ। এক এবং অভিন্ন। যে যেখান থেকে যেভাবে পেরেছে ফল সংগ্রহ করেছে। পওয়া যাচ্ছে না, সময় শেষ? না হবে না। কোথায় আছে খোঁজ। পেতেই হবে।
আজও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ফলের সেই সম্মোহিত আয়োজন। আম, কাঠাল, লিচু, জাম, জামরুল, আনারস, কামরাঙ্গা, কাঠল, লিচু, বইচি, মৌরি, পানিতাল, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, বেতফল, করমজা, দেশি খেজুর, কাউফল, ডেও। সিজন শেষ কি হয়েছে তাতে। রং-বেরঙের তরমুজও তো এখনো পাওয়া যাবে অনায়াসে। পাওয়া যাচ্ছে ড্রাগন ফল এখন এই মাটিতেই জন্মায়। সরবতী আর আতা, কেন ভুলে যাই ওদেরও তো এই সময়েই পাই? আরো মনে পরে অনেক নাম যে নামগুলো এই ফলের স্েগ মিলেমিশে আজো আছে মনের গভীরে মধুময় হয়ে। শুধু পারছি না এক হতে, কাছে যেতে। কেবলই ভয় করোনায়। কি বা কোরবার আছে এভাবেই মেনে নিতে হয় কবি নজরুলের কথায়, ‘চীরদিন কাহারো সমান নাহি যায়’। এই জৈষ্ঠেই জন্মেছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ এই কবি নজরুল। তাই জৈষ্ঠের এগারো এলেই জৈষ্ঠ যেন রূপ-রসে, ফুলে-ফলে ভরিয়া অঞ্জলি প্রকৃতিকে করে তোলে দারুন মধুময়। যেখানে নজরুলের গান কথা বলে, ‘নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মম, চীর মনোরম চীর মধুর। অথবা এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল, মিঠা নদীর পানি খোদা তোমার মেহেরবানী’।