একি হলো হায়

‘একি হলো হায়। ত্যাজিলাম যে শিশুরে ক্ষুদ্র অসহায়, সে কখন বল-বীর্য লয়ে ফিরে আসে’? আসে। নিশ্চয়ই আসে। তা না হলে এমন কথা লেখা হয় কেন? আমরা সকল কিছু বুঝতে পারি না বলে, সে যে হয় না, হতে নেই, হবেই না। কে তার গ্যারান্টি দিতে পারে? এই তো হলো। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম দেশের সর্বচ্চ আদালতের দরোজায় প্রতিকার চাইতে এসে দাঁড়ালো দুই শিশু যমজ। মহামান্য আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে তারা জানতে চাইলো তাদের মৃত্যুর কারণ! চাইলো মৃত্যুপূর্ব তাদের প্রতি যে দারুন অবহেলা, অবজ্ঞা, এবং বাঁচবার অধিকার হরনের প্রতিকার এবং শাস্তি।
কে নির্ধারণ করবে এই সাজা? রাষ্ট্র, দেশের জনগণ? দেশের চলমান রাজনীতি? না কি প্রচলিত ধর্ম? কার আছে সেই অবস্থা, অবস্থান, জ্ঞান, শিক্ষা? কে সে? জানি না কেন এই প্রশ্ন করি, যে প্রশ্নের কোন উত্তরই হয় না? তবে কেন প্রশ্ন করি আমি নিজেই যখন জানি না এর উত্তর? যখন আমার ভিতরের মানুষ নামক অবয়ব আমায় শক্তি দেয় না। বলে না তুমি প্রকাশ্যে এই আচরণের মুখে থুথু ছিটাও থুথু ছিটাও এই অনিয়মের বিরুদ্ধে। আমার, নিতান্তই আমার এই অযোগ্যতার দায় আমি কার ঘাড়ে চাপাবো? আমি কি করে কোন সাহসে বলবো এ দেশের একজন চিকিৎসকও মানবতার সেবক নন। এরা সবাই সেবা করেন অর্থের। এ দেশের আইন আদালত কেউ আইনের সেবক নন, তারা কেবল সেবা করেন অর্থের। এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় কেউ নেই, যারা উৎকর্ষ সাধন করেন শিক্ষার, জ্ঞানের, মনের, বোধের, মানসিকতার। এই সত্য উচ্চারণ সম্ভব নয় প্রকাশ্যে।
অথচ এর ব্যর্থ পরিনাম নিয়ে ভাবছি না কেউ। পায়ের নিচের রাস্তা ক্রমশ পাখা বিস্তার করে এখন মাথার উপরে উঠেছে। যারা তৈরি করেছেন এমন সুন্দর আর উন্নত শব্দের ব্যাসার্ধ। সেই সংশ্লিষ্ট জনেরা সবাই জানেন। কে কোন কাজ থেকে কতটা খেয়েছেন? পরিনামে কবে এটা ভেঙে পড়বে। আমরা জানি না। আমরা বুঝি না। তাই নিশ্চিন্তে মাথা পেতে দিয়ে চলেছি ওর নীচে। কবে ভেঙে পরে পিষে মেরে দেবে জানি না। এক কথিত অর্থনৈতিক দৃপ্ততায় ভ্রান্ত বিলাসী হয়ে গেছি সবাই। এখানে ভিখারিরও কোটি টাকা। এখানে সত্য উচ্চারণের খেসারত দিয়েছেন মাত্র সেদিনও সাংবাদিক লেখক পীর হাবিব। তার বাড়ি ভাঙচুরের মাধ্যমে। সত্যি উচ্চারণ করেছেন বলে লেখক সাংবাদিক নঈম নিজামকে খুঁজছে দুদক। হায় কি বিচিত্র এই সময়!
তাই বুঝতে পারছি না, ভাবতে পারছি না, বিশ^াস করছি না, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দরোজার সামনে দন্ডায়মান বিচার প্রার্থী ওই দুই মৃত শিশু, আমাদের সন্তান। আগামী দিনের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী। ওরাই আমাদের আগামীর সেনা, বিমান, নৌপ্রধান। ওরাই আমাদের আগামীর পুলিশ ও র্যাব প্রধান। ওরাই আগামীর এই দেশের প্রধান বিচারপতি। ওরা আগামীর শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী। হয়তো আগামীর ধর্মপথের দিশারীও ছিলো।
না এমন ভাবনা ভাবতে পারছি না কেউ। তাই সবাই স্থির, স্থবির। হয়ত, তাই এমন হত্যায় কাঁদছিনা কেউ। কেবল কাঁদছে ওই সদ্য ভূমিষ্ঠ দুই শিশুর বাবা, কাঁদছে ওদের মা। যারা বাঁচাতে ব্যর্থ হলেন তাদের সন্তানদের। কিছু অমানুষদের অর্থলিপ্সার হাত থেকে। আজ তারা চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে ‘দশ হাজার টাকা ছিলো না বলে আমাদের বাচ্চা, ওরা শিশু হাসপাতালেও ভর্তি করলো না’। গগনবিদারী সেই কান্নার সঙ্গে দেশ কাল পাত্র আর জাতিকে যা যা বলছে বিলাপের মধ্যে, আমরা তা শুনতে পাচ্ছি না। আমাদের তনু মোন প্রাণ তাকে স্পর্শ করছে না। হে আল্লাহ, তুমি আমাদের মাফ করো। ওই দুই মাসুম বেগুনাগার, যাদের তুমি এই পৃথিবীর কোলে দিয়েও নিশ্চিন্ত হতে পারলে না। তুমি ওদের শ্রেষ্ঠ স্থান জান্নাত দান করো।
হে মহান, সমগ্র পৃথিবী মুসলিম উম্মা আজ ক্ষুব্ধ। তোমার দোস্ত পেয়ারে হাবিব মোহাম্মদ মোস্তফা (সঃ) কে বেদ্বীনরা ব্যঙ্গ করেছে। (নাউযুবিল্লাহ) আমরা তার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছি। প্রতিবাদী হয়ে কুশপুত্তলিকা দাহ করেছি, ফরাসি প্রেসিডেন্টের। আমরা বক্তৃতায় ফরাসি পন্য বর্জনের ঘোষণা দিয়েছি। ঘোষণা দিয়েছি লংমার্চ করে ফরাসি যাবার। কিন্তু আমরা কি জানি ফরাসি কোন পথে? কি ভাবে যায়? কেন যেন আমরা না জেনে না বুঝে অনেক কিছু করতে চাই। সে কি সম্ভব?
এভাবে হয় না। এ জাতীয় আন্দোলন প্রতিবাদ, ওই প্রসূত শিশুর মত এ হাসপাতাল সে হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে একসময় প্রি-মেচিউর আখ্যা পেয়ে মৃত্যুবরণ করে। মানুষ বাঁচলে তবেই না ধর্ম বাঁচবে। আর সেই মানুষদের কর্মযোগ হতে হবে বিজ্ঞান মনষ্ক। তবেই না সেই ধর্ম সন্তানের প্রতিবাদ হবে তিক্ষè শানিত জ্ঞানসম্মত এবং অর্থবহ। যার প্রতিটা পদক্ষেপ হবে ধৈর্য আর মহানুভবতায় ভরা। যে শিক্ষা আমাদের বারবার দেখিয়েছেন নবী মোহাম্মদ মোস্তফা (সঃ)। আমরা যেন ভুলে না যাই রসুলইল্লাহ (সঃ) এর যথার্থ নির্দেশ যা তিনি নিজে পালন করেছেন এবং আমাদের পালন করতে বলেছেন। আমাদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে রসুলুল্লাহ (সঃ) এর পথে যে বুড়ি কাঁটা বিছিয়ে রাখতেন, তাকে কি প্রিয় নবী কোনদিন আঘাত করেছেন? তিরষ্কার করেছেন, তার প্রতি কি ক্ষুব্ধ হয়েছেন কখনো? যেদিন তিনি দেখলেন তার পথে আজ আর কাঁটা নেই। তিনি খোঁজ নিলেন বুড়ির, জানলেন তার অসুস্থতার কথা। তার পরে প্রিয় নবীর সেই বুড়ির প্রতি যে মহানুভবতা সে আমাদের সবার জানা। তবে আমরা সেই নবীর উম্মত হয়ে তার ধর্ম প্রচার ও প্রসারে, কোন স্বার্থের প্ররোচনায় এতোটা রুষ্ঠ ক্ষুব্ধ রূঢ় হয়ে যাই? কেন খবর রটে আল্লাহু আকবর বলে শিরচ্ছেদের? জানি না কারা কোন শিক্ষায় এমন নিষ্ঠুর পথে ইসলাম প্রচার করতে চায়? কারা এমন শান্তির ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করে পৃথিবীর মানুষের কাছে, আসলেই ওরা কি ইসলামী পথের কেউ?
খুব বলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সাহস হয় না। যদি বলতে পারতাম তবে বলতান এভাবে ওই সদ্য প্রসূত নিষ্পাপ শিশুদের যেভাবে দায় দায়িত্বহীন জ্ঞানশুন্য আচরণ করে পথে পথে ঘুরিয়ে অবশেষে হত্যাই করা হলো, যার পরিনামে হারিয়ে গেল আগামীর ধর্মশিশু। ঠিক সেইভাবে কারো বিচক্ষনহীনতার কর্মদোষে পৃথিবীর কোথাও যেন বিপদগ্রস্ত না হয় শন্তির ধর্ম ইসলাম।
লেখক: বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য।