এখনো নারী পুরুষের সমতা নারীদের নাগালের বাইরে

নারীর সমতা বলতে বুঝায় এক ধরণের স্বাধীনতা, যা সকল বয়সের মেয়ে ও নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। এই অধিকার হতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক, আইনানুগ, আঞ্চলিক সংস্কৃতি দ্বারা সিদ্ধ বা কোন সমাজের আচরণের বহি:প্রকাশ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই অধিকারকে অস্বীকার করতেও দেখা যায়। সীমান্ত পেরিয়ে বিভিন্ন দেশে সমতার ভিন্ন রকম সংজ্ঞা ও পার্থক্য দেখা যায়, কিন্তু সমতা মানেই অভিন্নতা। সমতার স্বপক্ষে আন্দোলনকারীদের দাবি যে, নারী ও মেয়েদের অধিকার প্রচলনের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দুর্বলতা রয়েছে। আর তাই নারী পুরুষের সমতা আজও নারীদের নাগালের বাইরে থেকে গেছে।
যে সব বিষয়ের ক্ষেত্রে নারী অধিকার প্রযোজ্য হয়, তা সুনির্দিষ্ট না হলেও এগুলো মূলত সমতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা কেন্দ্রিক। যেমন: পরিবার পারকল্পনায় সিদ্ধন্তের অধিকার, ভোটদানের অধিকার, অফিস আদালতে এক সঙ্গে কাজ করার অধিকার, কাজের বিনিময়ে ন্যায্য ও সমান সম্মনী প্রাপ্তি, বেতন ও অন্যান্য সুবিধা পাবার অধিকার, সম্পওি লাভের অধিকার, শিক্ষা অর্জনের অধিকার, সামরিক বাহিনীতে কাজ করার অদিকার, আইনগত চুক্তিতে অংশগ্রহণের অধিকার এবং বিবাহ ও ধর্মীয় অধিকার। নারী ও তাদের সহযোগীরা কিছু স্থানে পুরুষের সমতা আদায়ের স্বপক্ষে বিভিন্ প্রকার ক্যাম্পেইন ও কর্মশালা চালিয়ে যাচ্ছে।
করোনাকালে পুরো বিশে^র অর্থনীতি হয়েছে বিধ্বস্ত। বিপর্যস্ত হয়েছে বিশেষ করে নি¤œ আয়ের মানুষ। আর এর অনিবার্য প্রভাব বাল্যবিবাহের মত সামাজিক ব্যাধির প্রসার ঘটেছে। অসম সম্পর্কে পরিবার পরিকল্পনায় নারীরা অধিকার প্রতিষ্ঠায় পিছিয়ে পড়েছে সেই সঙ্গে বাড়ছে অসমতা।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) এক গবেষণায় বলা হয়, ২০২০ সালে করোনাকালে দেশের ২১ জেলার ৮৪ উপজেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। বাল্যবিয়ের অবস্থা দ্রুত বিশ্লেষণ: করোনাকালে ২০২০ শীর্ষক এক জরিপে বলা হয়েছে, করোনাকালে নি¤œ আয়ের মানুষ নানা ধরণের চ্যালেজ্ঞের মুখোমুখি হয়েছে। এসব চ্যালেজ্ঞের মধ্যে ছিলো আয় হারানো, ক্ষুদ্র ব্যবসা বিলীন ইত্যাদি। করোনাকালে দারিদ্র বৃদ্ধি ও পরিবারের সদস্যদের মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা করতে না পারা বাল্যবিবাহের বড় কারণ হিসাবে বর্ণনা করে ৩০ শতাংশ অংশগ্রহকারী। করোনাকালে বাল্যবিবাহের অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে আয় হারিয়ে যাওয়া দারিদ্র বৃদ্ধি, বিদ্যাদান সামাজিক নিয়ম-বিশ^াস, স্কুল বন্ধ, বাল্যবিবাহের মাধ্যমে অভিভাবকদের কিছু সুবিধা পাওয়ার আশা, কম পরিমাণ যৌতুক দেওয়ার সম্ভাবনা।
বাল্যবিবাহের মতো সমস্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি করোনাকালে বেড়েছে নারী নির্যাতনও। বিশে^র যেসব দেশে স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নির্যাতনের হার বেশী, সেসব দেশের তালিকায় সম্প্রতি এসেছে বাংলাদেশের নাম। দেশের ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৫০ শতাংশই জীবনে কখনো না কখনো সঙ্গীর হাতে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বিশে^র ১৬১টি দেশ ও অঞ্চলে ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নারী নির্যাতনের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আলাদাভাবে করোনা মহামারির মধ্যে সর্বশেষ ১২ মাসে স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নারীর শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ তালিকায়ও ১৬ তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশে। করোনাকালে বাংলাদেশে ২৩ ভাগ নারী নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন। এই চিত্র নারী অসমতার আশঙ্কাজনক চিত্র ফটিয়ে তুলে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনউইমেনের গত বছরের জুন মাসে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে ৫১ দশমিক ৭ ভাগ নারী তাদের স্বাস্থ্য পরিচর্যার সামগ্রীর অপ্রতুলতার কথা বলেছেন, বিশেষ করে নারীপ্রধান পরিবারের কাছে সমস্যা প্রকট। কোভিড-১৯ বাংলাদেশের র্যাপিড জেন্ডার অ্যানালিস্ট শিরোনামে ওই গবেষণাটি ছিল জেন্ডার ইন হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ নামের একটি জোটের উদ্যোগ।
নি¤œ বা স্বল্প আয়ের নারীরা কিভাবে তাদের মাসিককালীন ব্যবস্থাপনা করেছেন, তা জানতে গত বছরের মে মাসে আর্ন্তজাতিক সংস্থা ওয়াটার এইড বাংলাদেশ একটি গুণগত গবেষণা করে। তাতে দেখা যায় নি¤œ আয়ের নারীদের মাসিককালীন স্বাস্থ্য পরিচর্যার ক্ষেত্রে করোনার প্রভাব প্রকট।
অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি রওশন আরা বেগম বলেছেন, করোনাকালে গর্ভপাতের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। বেড়েছে ঘরে সন্তান জন্ম দেওয়ার হার। এসবের প্রভাব নারীস্বাস্থ্যের ওপর পড়বে। মাসিককালীন স্বাস্থ্য পরিচর্যার ক্ষেত্রে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল, এরও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আছে। তবে তা কতটা পড়েছে, তা বলার মত পর্যাপ্ত গবেষণা আমাদের হাতে নেই।
আর তাই নারী অধিকারে সমতার জীবন নিশ্চিত করতে পরিবার পরিকল্পনার মান উন্নয়নে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারী সেবা প্রদানে অনলাইন প্রযুক্তির ব্যবহারে সবাইকে আগ্রহী করতে সরকারী নীতি নির্ধারণে কার্যকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অশু প্রয়োজন।