কদম যেন বর্ষার হাসি

কদম যেন বর্ষার হাসি

ঋতুচক্রে বছরান্তে ফিরে আসে বর্ষা। বৃষ্টিময় প্রকৃতি তার আগমনী বার্তা দেয় নানা উপায়ে। সেই আগমনী বার্তারই প্রমাণ দেয় কদম ফুল। বৃষ্টির ছোঁয়ায় যেন সবুজ প্রকৃতির মধ্যে হেসে ওঠে হলুদ-সাদা কদম। তাই বলাই চলে, কদম যেন বর্ষার হাসি। বৃষ্টিভেজা প্রকৃতিকে আরও রাঙিয়ে দেয় কদম ফুল। পাতার আড়াল থেকে বৃষ্টির জলে নিজেকে ধুয়ে-মুছে কদম যেন হেসে ওঠে। তবুও আমাদের কোথায় যেন কষ্ট লুকিয়ে আছে- পৃথিবীজুড়ে মহামারী করোনা ভাইরাসের কবলে পরে মানুষের জীবন-জীবিকা থেমে আছে। কারো মুখে হাসি নেই। করোনার প্রভাব আমাদের দেশজুড়েও। প্রতিদিন কেউ কারও প্রিয়জন হারিয়ে ভালো নেই। সময় যত পেরিয়ে যায় মনে হয় মৃত্যু ততো কাছে আসে। তবুও একটু হাসতে চায় মানুষ। এই বর্ষাই যেন নিয়ে আসে বর্ষামঙ্গল। 

হলুদ শুভ্রতার সংমিশ্রণে কদম ফোটার সময় এসেছে। চারপাশে কদম ফুলের সমারহ। এই ফুল এখন শোভা পাচ্ছে গাছে গাছে। সাক্ষী হচ্ছে প্রেমিক যুগলের প্রেমময় স্মৃতিতেও। কোনো প্রেমিক যুগল যখন একই ছাতার নিচে বসে বর্ষার প্রকৃতি অনুভব করে, তখন বাতাসে মিশে থাকে কদমের স্পর্শ। গোপনে অনেক প্রেমিক বর্ষামঙ্গলে প্রেমের পরশ মেখে প্রেমিকার হাতে তুলে দেয় কদম। তবে এবার কিছুটা ভিন্ন মাত্রা লক্ষণীয়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি থাকার কারণে প্রেমিক-প্রেমিকারা অসহায়। প্রেম যেন আটকে আছে মনের গহীনে। হয়তো প্রিয় মানুষটিকে এবছরও বর্ষামঙ্গলে কদম ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হবে না। 

কদম আর বর্ষা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে অসংখ্য কাব্য, গদ্য। বর্ষামঙ্গল নিয়ে আমাদের দেশের কবি-সাহিত্যিকদের মনের হাজারও রঙিন কথায় গেঁথে আছে বাংলা সাহিত্য প্রাঙ্গন। এই বর্ষার আগমনী বার্তা নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতায় লিখেছেন, 
     
‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে
আঁধার করে আসে,
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
একা দ্বারের পাশে।’

এ যে কবিগুরুর বর্ষা নিয়ে প্রেমের বহিঃপ্রকাশ। অনুভূতি, প্রেম, আকর্ষণ, ভালোবাসা যেন এই ঋতুর শুভ্রতা আর পবিত্রতা ছড়িয়ে দিচ্ছে বর্ষার প্রতিটি মূহুর্তে। এমন সব মূহূূর্তকে আরও বেশি রাঙাতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন,

‘ওগো ও কাজল মেয়ে,
উদাস আকাশ ছলছল চোখ তব মুখে আছে চেয়ে।
কাশফুল সম শুভ্র ধবল রাশ রাশ শ্বেত মেঘে
তোমার তরীর উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে।’

বর্ষা ঋতুর প্রতি যে মানুষের ভালোবাসার এক অদ্ভুত টান তা যেন বাংলা সাহিত্যে অনন্য স্থান দখল করে আছে। বর্ষা যেন সাহিত্যের প্রেম। তাই আজ আষাঢ়ের শুরুতে কবি সাহিত্যকদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা যেতেই পারে।

বর্ষায় গ্রাম বাংলা সাজে নবরূপে। যাকে আমরা নারীর রূপও বলতে পারি। গাছে গাছে সজীবতা, চারিদিকে সবুজের সমারোহ। কদম ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গাছে। কদমের সু-ঘ্রাণ বইছে পাড়া-মহল্লায়। চারিদিকে দেখা যায় পাখিদের উচ্ছ্বাস। বাংলার কৃষকদের মুখে হাসি। এদিকে দেশ জুড়ে মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ। তাই এবার বুঝি একটু বেশিই সুযোগ পেয়েছে গ্রামের দুষ্ট-মিষ্টি কিশোর-কিশোরীরা। খেলতে ছুটে যায় মাঠে ঘাটে। এখনই যেন কদম নিয়ে মেতে ওঠার প্রকৃত সময়। শিশুরা অভিনব কৌশলে কদম ফুল দিয়ে তৈরি করছে বিভিন্ন আকৃতির মালা। 

বৃত্তপুষ্প, সর্ষপ, ললনাপ্রিয়, সুরভী, মেঘাগমপ্রিয়, মঞ্জুকেশিনী, কর্ণপূরক, পুলকিও নাকি কদমফুলের অন্যান্য নাম। হয়তো তার সৌন্দর্যে অধিকারের দিক থেকেই এত কিছু অর্জন। সংস্কৃত নাম কদম্ব, সেখান থেকেই কদম নামটি পেয়েছি আমরা। কদম্ব ‘যা বিরহীকে দুঃখী করে’। এদিকে মধ্যযুগের সাহিত্যেও কদম ফুল নিয়ে রাধা-কৃষ্ণের বিরহগাথা রয়েছে। হিন্দুধর্মের শাস্ত্র ভগবত গীতায়ও কদম ফুলের সরব উপস্থিতির দিকটি নজরে পড়ে।

এই বর্ষামঙ্গলে মহামারী ধুয়ে মুছে আবার যেন হেসে ওঠে মানুষগুলো কদম ফুলের মত। হাসুক আমাদের পিতা-মাতা, হাসুক প্রিয় মুখ। শিক্ষার্থী ফিরে পাক তার হারানো প্রাণ। যেমন করে হেসে উঠেছে কদম, এমন করেই হাসুক আমাদের পৃথিবী।


লিখেছেন: সুকান্ত অপি। ছবি তুলেছেন : টিটু দাস।