করোনায় ঘরবন্দী শিশুরা বিপর্যস্ত, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গল্পোচ্ছলে পড়াতে হবে

করোনায় ঘরবন্দী শিশুরা বিপর্যস্ত, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গল্পোচ্ছলে পড়াতে হবে

করোনায় সমস্যায় আছে শিশুরা। টানা ৩ মাসেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। সরকারি নির্দেশে বন্ধ কোচিংও। পার্ক বা বেড়ানোর জায়গাও সংকুচিত হয়েছে। করোনা সংক্রমণ এড়িয়ে চলার কারণে সহপাঠী কিংবা বন্ধুদের সাথে একত্রে খেলাধুলাও করতে পারছে না তারা। পারছে না ঘরের বাইরে বের হতে। এ কারণে বদ্ধ ঘরে থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে উঠেছে শিশুরা। অনেকে স্কুলে ক্লাশে ফিরতে চায়। কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকায় শিশু সন্তানদের শুধুই শান্তনা দিচ্ছেন অভিভাবকরা।

করোনা সংক্রমণ এড়াতে গত ১৫ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শত বার্ষিকী অনুষ্ঠান সিমীত আকারে পালনের পরপরই বন্ধ হয়ে যায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

ছোট্ট শিশু জাহারা। নগরীর কালেক্টরেট স্কুলের ক্লাস ওয়ানের ছাত্রী। বাবার সাথে স্কুলে যেত প্রতিদিন। স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায়ই যেত বিভিন্ন পার্কে। আবার কখনও কিছু কেনার আবদার করে যেত মার্কেটে। কিন্তু স্কুল বন্ধ থাকায় ১৭ মার্চের পর থেকে আর স্কুলের আঙিনায় যাওয়া হয়নি তার। মার্কেট-পার্কে বেড়ানো তো চিন্তার বাইরে। ঘরের বাইরেও যেতে পারছে না জাহারা। এ কারণে অস্থির হয়ে উঠেছে সে। কিছুদিন ধরে সে স্কুলে যাওয়ার বায়না ধরেছে। অভিভাবকরা স্কুল বন্ধ থাকার কথা বললেও তা মানতে চাচ্ছে না সে। বন্ধ থাকা স্কুল ঘুরিয়ে আনার কথা অভিভাবকরা বললেও তাতে হবে না জাহারার। স্কুলের ক্লাসে ফিরতে চায় সে।

একই স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী তাহিরা স্টারের অবস্থাও একই। স্কুল-কোচিং বন্ধ থাকায় টানা ৩ মাস ১১দিন ঘরে বদ্ধ তাহিরার সময় কাটে ছবি এঁকে আর জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পাশের ভবনের জানালায় দাঁড়ানো দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া এক বন্ধুর সাথে গল্প করে।

তাহিরার মা বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সেবিকা মুন্নী হক বলেন, চাকুরীর প্রয়োজনে তার এবং তার স্বামীর বাসার বাইরে যেতে হয়। কিন্তু গত ৩ মাসে একবারের জন্য তাহিরাকে ঘর থেকে বের করেননি। ঘরে আর আটকা থাকতে চাচ্ছে না তাহিরাসহ তার সহপাঠী ও বন্ধুরা।

নগরীর নূরিয়া কিন্ডার গার্টেনের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মান্হা থাকে তাদের দোতালা ভবনে। করোনা প্রকোপের কারণে স্কুল-কোচিং বন্ধ থাকায় বাসার নিচেও তাকে নামতে দেয়নি তার বাবা-মা। আগে বাবা-মায়ের সাথে মাঝে মধ্যে পার্কে বা আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ পেলেও এখন সেই সুযোগ নেই। একগুয়ামির কারণে অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে শিশু মানহা।

অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা নুরুন্নাহার বলেন, তার দুই নাতীর একজন জিলা স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে এবং অপরজন পড়াশোনা করে কালেক্টরেট স্কুলের ওয়ানে। স্কুল বন্ধ থাকায় বাসায় পড়াশোনা নেই বললেই চলে। বড় নাতি গল্পের বই পড়ে সময় কাটায়, আর ছোট নাতি ঘুমিয়ে, পুতুল খেলে আবার কখনও তাদের সাথে বালিশ খেলে সময় পার করে। এভাবে গত প্রায় ৩ মাস স্কুল-কোচিং বন্ধ থাকায় বদ্ধ বাসায় ছটফট করছে তারা। বাইরে কিংবা বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করতে না পেরে অস্থির হয়ে উঠেছে তার দুই নাতি।

এই অবস্থা শুধু জাহারা, তাহিরা, মানহা, নাজিবা কিংবা তাসফির নয়, বরিশালসহ সারা দেশের লাখ লাখ শিশু এখন একই সমস্যায় আছে।

শিক্ষাবিদ নগরীর কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর খন্দকার অলিউল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকার স্কুল-কলেজ খোলা রেখেছিলো, বাঙালিরা ক্লাসে যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর ৩ বছরের উচ্চ শিক্ষা কোর্স সম্পন্ন করতে ৭ বছর লেগেছে। কিন্তু সার্বিক পড়ালেখায় তাদের ক্ষতি হয়নি। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শিশু শিক্ষার্থীদের ধৈর্য্য ধারণের শান্তনা দিতে হবে। পড়ালেখার জন্য চাপ দেয়া যাবে না। তাদের মানসিক শান্তির জন্য বাসায় বিভিন্ন ইনডোর গেমের ব্যবস্থা করতে হবে। এই সময়ে শিশুদের সাথে ভালো ব্যবহার এবং ভালো খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। পড়ালেখার চেয়ে জীবন বড় বলে মনে করেন তিনি।

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালের নবজাতক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. বিধান চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে গল্পচ্ছলে শিশুদের বোঝাতে হবে যে ইচ্ছেকৃত তাদের বাসায় আটকে রাখা হচ্ছে না। বাসার পরিবেশ আনন্দময় করতে হবে। তাদের মন ভালো রাখতে অভিভাবকদের নানাবিধ চেষ্টা করতে হবে। বাসায় ছবি আঁকা সহ নাঁচ-গানের ব্যবস্থা করে তাদের মন প্রফুল্ল রাখতে হবে। পড়াশোনার জন্য তাদের চাপ দেয়া যাবে না। বাবা-মাকে গল্পচ্ছলে শিশুদের পড়াতে হবে।

বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের এই সময়ে অভিভাবকদের উচিত হবে বাসায় সিমীত পরিসরে লেখাপড়া চালু রাখা। সময়টা কাজে লাগাতে হবে। শিশুদের অস্থিরতা (বোরিংনেস) কাটানোর দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবকদের। এই পরিস্থিতিতে শিশুদের বাইরে যাওয়া একেবারেই সমিচিন হবে না।