কর্মই ধর্মের শ্রষ্টা, অমৃত দা’র প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

প্রবাদ আছে, ‘জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো’। অর্থাৎ জন্মের স্থান কিংবা পরিবার, গোত্র কোন বিষয় নয়। মানুষ তাঁর কাজের মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করে। পৃথিবীর দেশে দেশে বরেণ্য ব্যক্তিদের জীবনী থেকে জানা যায়, অতি সাধারণ, কৃষক, দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তারা কর্মগুণে বিশ্বের দরবারে মর্যাদাবান ব্যক্তি হিসেবে সমাদ্রিত হয়েছেন। কর্মগুণে তারা স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছেন। মানুষের কল্যাণে নিবেদিত করেছেন তাদের মেধা ও মনন। সারা বিশ্বে এরকম মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। আজকে দুজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে মূল লেখায় ফিরতে চাই।
প্রথমজন ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট এপিজে আবদুল কালাম এবং দ্বিতীয়জন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রো মোদি। আবদুল কালাম অত্যন্ত গরীব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। তার বাবা তীর্থযাত্রীদের নৌকায় পারাপার করতেন। কিন্তু পরমানু বিজ্ঞানী ও ভারতের সাবেক রাষ্ট্রতি এপিজে আবদুল কালামকে চেনেন না, এমন মানুষ খুব একটা পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রো মোদি অত্যন্ত নিম্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রেল লাইনের পাশে বাবার চায়ের দোকানে সহায়তা করতেন এবং নিজেও চা বিক্রি করতেন। তিনি তাঁর কর্মগুণে এবং যোগ্যতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। যারা কাজের মাধ্যমে পৃথিবীতে খ্যাতিমান হয়েছেন। সেসব ইতিহাস অন্য একদিন দেওয়া যাবে। আজকের প্রসঙ্গ কর্মকে ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করা বরেণ্য ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তুলে ধরার চেষ্টা।
সুশিক্ষা এবং কাজের মাধ্যমে নিজেদের বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন অনেকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত হয়েও কেবল কাজের মাধ্যমে মানুষের মনিকোঠায় স্থান করে নেওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি নেই। আবার কাজকেই ধর্ম ভাবতে পারার উদার মানসিকতার মানুষ পাওয়াও কঠিন। সেই কঠিন কাজটি করে দেখিয়ে গেছেন বরিশালের অতি সাধারণ মানুষ এবং অসাধারণ গুণের অধিকারী অমৃত লাল দে। যাকে সবাই দানবীর খেতাবে ভূষিত করেছেন। কর্মের স্পর্শে মানুষকে আলোকিত করে গেছেন তিনি। শিক্ষা বঞ্চিত মানুষ অমৃত লাল দে শিক্ষার আলোয় সমাজকে আলোকিত করে গেছেন। তাঁর মত মানুষের পক্ষেই বলা সম্ভব হয়েছে, ‘কর্মই মানুষের প্রধান ধর্ম হওয়া উচিত’।
এমন অমৃত বাণি আজন্ম লালন করা একজন স্বশিক্ষিত, সমাজ সচেতন, আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর হচ্ছেন অমৃত লাল দে। কোন বিশেষ ধর্ম তাঁকে আবৃত্ত করতে পারেনি। মানব সেবা ধর্মই তাঁর কাছে ছিল প্রধান উপজীব্য। মানুষের মাঝে সেবার ব্রত নিয়ে ছিলেন সদা জাগ্রত। সমাজের নানা প্রতিকূলতার স্বাক্ষী হয়েছেন তিনি। নানা চড়াই-উৎড়াইয়ের মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠেছেন গর্বিত অমৃতভাষী, সদানন্দময় এমনই একজন মানুষ অমৃত লাল দে। ১৯২৪ সালের ২৭ জুন বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। অমৃত বাবু হিসেবে দক্ষিণাঞ্চলের সব ধর্মের মানুষের কাছে বিশেষভাবে পরিচিতি। উদার চিন্তার এই মানুষটি ১৯৯৩ সালের ১৪ জুন ৬৯ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।
ধর্মীয় চেতনার উর্ধ্বে থেকে কর্মকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন অমৃত বাবু। আজন্ম ‘কর্মই ধর্ম’কে লালন করে গেছেন। অমৃত লাল দে বলতেন, মানুষ বাঁচে তার কর্মের মাঝে।’ তাঁর কর্মময় জীবনের মাঝেই তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। যে বয়সে লেখাপড়া করার কথা সে বয়সে তাঁকে সংসারের কঠিন জীবন সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হয়েছে। সংসারের কর্ণধার হবার কারণে লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন তিনি।
স্বশিক্ষিত অমৃত লাল দে তাঁর কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে যেমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন। তেমনি মানুষের সুখ-দু:খে সহমর্মী হয়ে পাশে থেকেছেন আজন্ম। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র কোন বাদ বিচার ছিল না এই মানুষটির কাছে। তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখতেন। ধর্ম দিয়ে পার্থক্য করাকে তিনি মানুষের মধ্যে এক ধরণের বিভেদ বলে মনে করতেন। তাইতো তিনি উদার হস্তে সব ধর্মের অবহেলিত, সুবিধা বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সবসময়। ধর্মের প্রতি দুর্বলতা না থাকার কারণে তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সমাহিত করা হয়। তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত ‘অমৃত বাতিঘর’ হিসেবে খ্যাত অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয় চত্ত্বরে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
অমৃত বাবু নিজে স্কুলে পড়ার সুযোগ পাননি। কিন্তু তাতে তার কোন খেদ ছিল না। নিজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আকাঙ্খা ছোট ভাইদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছেন। ছোট ভাইদের শিক্ষত করে গড়ে তুলতে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত হলেও তিনি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। নিজের হাতে লিখে রাখতেন নিত্যদিনে ঘটনা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারায় মনোকষ্ট ছিল অমৃত বাবুর। এমন আত্ম দহন থেকে অমৃত বাবু মনে মনে ঠিক করেন শিক্ষা বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াতে হবে। অর্থাভাবে যারা পড়াশুনা করতে পারছে না তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে এলেন তিনি। অমৃত বাবু তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে সবচেয়ে বেশি আর্থিক সহযোগিতা করেছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বরিশালের খুব কম সংখ্যক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা পাওয়া যাবে যেখানে অমৃত বাবু আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেননি। একজন শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক ও দানবীর হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিতি লাভ করেন। বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানসহ মসজিদ, মন্দির, সামাজিক সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রেই সমুজ্জল সাক্ষর রেখে গেছেন সহযোগিতার মধ্যদিয়ে।
এতো কিছুর পরও তিনি তৃপ্ত হতে পারছিলেন না। অতৃপ্ত বাসনা তাঁকে সব সময় তাড়া করে বেড়াত। অর্থ কষ্টে জর্জরিত ছাত্রদের কিভাবে সহযোগিতা দিয়ে শিক্ষা জীবন নিশ্চিত করা যায় সেই চিন্তাই করতেন সর্বদা। সে তাড়ণা থেকেই তিনি একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। ১৯৮৭ সালে জগদীশ সারস্বত বালিকা বিদ্যালয়ে একটি নাইট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘ ৬ বছর এ প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র-ছাত্রী ভাল ফলাফল অর্জন করে। বরিশালের এক সুধী সমাবেশে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই তিনি এ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় সম্মতি দেন। কিন্তু তৃপ্ত হতে পারছিলেন না অমৃতবাবু। মনে মনে চিন্তা একটি পুর্নাঙ্গ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
একটি পুর্নাঙ্গ কলেজ প্রতিষ্ঠায় ব্যাকুল অমৃত লাল বরিশালের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করেন। আলোচনার পর উদ্যোগ নেন কলেজ প্রতিষ্ঠার। শুরু হয় কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কাজ। সবার ইচ্ছায় অমৃত লালের নামেই নামকরণ করা হয় কলেজের। অমৃত লাল দে তাঁর স্বত্ত্ব দখলীয় সাতশত আটাশ সহস্রাংশ জমি অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ের নামে দান করে দেন। শিক্ষা বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পূর্ব পর্যন্ত ৩ বছর কলেজের সকল শিক্ষকের বেতন ও অন্যান্য যাবতীয় খরচ ব্যক্তিগতভাবে তিনিই বহন করেছেন। অবশ্য এখনও কলেজটির উন্নয়নমূল বিভিন্ন কাজে প্রয়াত অমৃত লাল দের ছোট ভাই বিজয় কৃষ্ণ দে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছেন বড় ভাইয়ের মতো। রাখাল চন্দ্র দে, বিজয় কৃষ্ণ দে বড় ভাই অমৃত লাল দের কর্মময় জীবন এবং মানুষের সঙ্গে রেখে যাওয়া সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে চলেছেন। অমৃত ভা-ার হিসেবে উদার হস্তে ধারাবাহিকভাবে সমাজের উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছেন এই পরিবার।
১৯৯২-৯৩ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়। বর্তমানে বিভিন্ন বিষয়ে ৮০জন শিক্ষক শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত আছেন। স্থাপনা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার দিক বিচারে একটি অনন্য সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করছে কলেজটিতে। মহাবিদ্যালয়ের ৩ তলা বিশিষ্ট ৩টি একং চারতলা বিশিষ্ট একটি ভবন রয়েছে। ভবিষ্যতে একটি ছাত্রী নিবাস করার পরিকল্পনাও রয়েছে। ছাত্র রাজনীতি বিহীন একটি আদর্শ কলেজ হিসেবেই এটি দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক পরিচিত। ইতোমধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে মানবিক বাণিজ্য ও বিজ্ঞান এবং ¯œাতক (পাস) শ্রেণিতে বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিভাগ চালু রয়েছে। ধারাবাকিভাবে এই কলেজটির শিক্ষার্থীরা মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছে।
একজন স্বশিক্ষিত মানুষ অমৃত লাল দে’র অবদান আজ সারা দেশের মানুষের কাছে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। নিজে শিক্ষার সুযোগ না পেলেও অর্থকষ্টে যেন কোন মানুষ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয় এটাই ছিল অমৃত লাল দে’র ব্রত। আজন্ম তিনি সেই ব্রত পালন করে গেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রে অবদান রেখে গেছেন অমৃত লাল দে। আজো সেই ধারা অব্যাহত রেখে চলেছে অমৃত পরিবার। অমৃতবাবু হয়তো আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু তাঁর অবদান এবং সৃষ্টি তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে। তাঁর দেওয়া অমৃত বাণি ‘কর্মই ধর্ম’র মাঝখানে। মানুষ ধর্মে নয়, কর্মে বাঁচবে সেই প্রত্যাশা রেখ অমৃত লাল দে’র প্রতি আবারো বিনম্র শ্রদ্ধা।