কর্মই ধর্মের স্রষ্টা অমৃত লাল দে
‘কর্মই মানুষের প্রধান ধর্ম হওয়া উচিত’। এমন অমৃত বাণি আজন্ম লালন করা একজন স্বশিক্ষিত, সমাজ সচেতন, আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগরের নাম অমৃত লাল দে। কোন বিশেষ ধর্ম তাঁকে আবৃত্ত করতে পারেনি। মানব সেবা ধর্মই তাঁর কাছে ছিল প্রধান উপজীব্য। মানুষের মাঝে সেবার ব্রত নিয়ে ছিলেন সদা জাগ্রত। সমাজের নানা প্রতিকূলতার স্বাক্ষী হয়েছেন তিনি। নানা চড়াই-উৎড়াইয়ের মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠেছেন গর্বিত অমৃতভাষী, সদানন্দময় এমনই একজন মানুষ অমৃত লাল দে। ১৯২৪ সালের ২৭ জুন বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। অমৃত বাবু হিসেবে দক্ষিণাঞ্চলের সব ধর্মের মানুষের কাছে বিশেষভাবে পরিচিতি। উদার চিন্তার এই মানুষটি ১৯৯৩ সালের ১৪ জুন ৬৯ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।
ধর্মীয় চেতনার উর্ধ্বে থেকে কর্মকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন অমৃত বাবু। আজন্ম ‘কর্মই ধর্ম’কে লালন করে গেছেন। অমৃত লাল দে বলতেন, ‘কর্মই মানুষের প্রধান ধর্ম হওয়া উচিত। মানুষ বাঁচে তার কর্মের মাঝে।’ তাঁর কর্মময় জীবনের মাঝেই তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। যে বয়সে লেখাপড়া করার কথা সে বয়সে তাঁকে সংসারের কঠিন জীবন সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হয়েছে। সংসারের কর্ণধার হবার কারণে লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন তিনি।
স্বশিক্ষিত অমৃত লাল দে তাঁর কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে তিনি একদিকে যেমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন। তেমনি মানুষের সুখ-দু:খে সহমর্মী হয়ে পাশে থেকেছেন আজন্ম। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র কোন বাদ বিচার ছিল না এই মানুষটির কাছে। তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখতেন। ধর্ম দিয়ে পার্থক্য করাকে তিনি মানুষের মধ্যে একধরণের বিভেদ বলে মনে করতেন। তাইতো তিনি উদার হস্তে সব ধর্মের অবহেলিত, সুবিধা বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সবসময়। ধর্মের প্রতি দুর্বলতা না থাকার কারণে তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে দাহ না করে সমাহিত করা হয়েছে। তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত ‘অমৃত বাতিঘর’ হিসেবে খ্যাত অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয় চত্ত্বরে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
সংসারের হাল ধরার কারণে অমৃত বাবু স্কুলে পড়ার তেমন সুযোগ পাননি। কিন্তু ছোট ভাইদের শিক্ষত করে গড়ে তুলতে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন তিনি। নিজের হাতে লিখে রাখতেন নিত্যদিনে ঘটনা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারায় এক ধরণের মনোকষ্ট ছিল অমৃতবাবুর। এধরণের আত্ম দহন থেকে অমৃত বাবু মনে মনে ঠিক করেন শিক্ষা বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াতে হবে। অর্থাভাবে যারা পড়াশুনা করতে পারছে না তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে এলেন তিনি। নিজে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় অমৃত বাবু তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে সবচেয়ে বেশি আর্থিক সহযোগিতা করেছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বরিশালের খুব কম সংখ্যক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা পাওয়া যাবে যেখানে অমৃত বাবু আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেননি। একজন শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক ও দানবীর হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিতি লাভ করেন। বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানসহ মসজিদ, মন্দির, সামাজিক সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রেই সমুজ্জল সাক্ষর রেখে গেছেন আর্থিক সহযোগিতার মধ্যদিয়ে।
এতো কিছুর পরও তিনি তৃপ্ত হতে পারছিলেন না। অতৃপ্ত বাসনা তাঁকে সব সময় তাড়া করে বেড়াত। অর্থ কষ্টে জর্জরিত ছাত্রদের কিভাবে সহযোগিতা দিয়ে শিক্ষা জীবন নিশ্চিত করা যায় সেই চিন্তাই করতেন সর্বদা। সে তাড়ণা থেকেই তিনি একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। ১৯৮৭ সালে জগদীশ সারস্বত বালিকা বিদ্যালয়ে একটি নাইট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘ ৬ বছর এ প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র-ছাত্রী ভাল ফলাফল অর্জন করে। বরিশালের এক সুধী সমাবেশে তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান আহসান হাবিব কামাল ও শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী অধ্যক্ষ মো: ইউনুচ খানসহ সকলের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই তিনি এ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় সম্মতি দেন। কিন্তু তৃপ্ত হতে পারছিলেন না অমৃতবাবু। মনে মনে চিন্তা একটি পুর্নাঙ্গ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
একটি পুর্নাঙ্গ কলেজ প্রতিষ্ঠায় ব্যাকুল অমৃত লাল বরিশালের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করেন। আলোচনার পর উদ্যোগ নেন কলেজ প্রতিষ্ঠার। শুরু হয় কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কাজ। সবার ইচ্ছায় অমৃত লালের নামেই নামকরণ করা হয় কলেজের। অমৃত লাল দে তাঁর স্বত্ত্ব দখলীয় সাতশত আটাশ সহস্রাংশ জমি অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ের নামে দান করে দেন। শিক্ষা বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পূর্ব পর্যন্ত ৩ বছর কলেজের সকল শিক্ষকের বেতন ও অন্যান্য যাবতীয় খরচ ব্যক্তিগতভাবে তিনিই বহন করেন। অবশ্য এখনও কলেজটির উন্নয়নমূল বিভিন্ন কাজে প্রয়াত অমৃত লাল দের ছোট ভাই বিজয় কৃষ্ণ দে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছেন বড় ভাইয়ের মতো। বিজয় কৃষ্ণ দে বড় ভাই অমৃত লাল দের কর্মময় জীবন এবং মানুষের সঙ্গে রেখে যাওয়া সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে চলেছেন। অমৃত ভা-ার হিসেবে উদার হস্তে ধারাবাহিকভাবে সমাজের উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছেন এই পরিবার।
১৯৯২-৯৩ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়। বর্তমানে বিভিন্ন বিষয়ে ৮০জন শিক্ষক শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত আছেন। স্থাপনা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার দিক বিচারে একটি অনন্য সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করছে কলেজটিতে। মহাবিদ্যালয়ের ৩ তলা বিশিষ্ট ৩টি একং চারতলা বিশিষ্ট একটি ভবন রয়েছে। ভবিষ্যতে একটি ছাত্রী নিবাস করার পরিকল্পনাও রয়েছে। ছাত্র রাজনীতি বিহীন একটি আদর্শ কলেজ হিসেবেই এটি দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক পরিচিত। ইতোমধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে মানবিক বাণিজ্য ও বিজ্ঞান এবং স্নাতক (পাস) শ্রেণিতে বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিভাগ চালু রয়েছে।
টিউটোরিয়াল পদ্ধতিতে পাঠদান, বছরে তিনটি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবীদের পুরস্কৃত করা, শ্রেণি কক্ষের বাইরেও ছাত্রছাত্রীদের বিশেষভাবে পড়াশুনায় সহযোগিতা করা। প্রতি ১৫ (পনের) জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন তত্ত্বাবাধায়ক শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ এবং সামগ্রিক তত্ত্ববধান করা। মেধাবী ও দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা। কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রী যোগমায়া দে’র নামে বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। প্রতি বছর ১৭জন মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের এ বৃত্তি প্রদান করা হয়। প্রত্যেককে মাসিক ৫০০ টাকা এবং বছরে দুই বার বই কেনার জন্য ১০০০+১০০০= ২০০০ টাকা প্রদান করা হয়। এমনকি অনেকের থাকা-খাওয়া পর্যন্ত পরিচালনা পরিষদের পক্ষে অমৃত লাল দের ছোট ভাই বিজয় কৃষ্ণ দে বহন করে চলছেন অমৃম লাল দের পথ অনুসরণ করে।
২০০২ সালে কলেজটি সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে মেধায় ৬ষ্ঠ স্থান অজর্ন করে। দক্ষিণাঞ্চলে একমাত্র বেসরকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কলেজটি যশোর ও বরিশাল বোর্ডের মধ্যে অনন্য কলেজের স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০০৪ সালে ফলাফলের দিক দিয়ে বরিশাল বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে।
১৯৯৮ সালে ঈশিতা রনি মানবিক বিভাগে সকল বোর্ডে প্রথম, ১৯৯৯ সালে ইনতেছার আলম মানবিক বিভাগে প্রথম, কামরুন্নাহার পপি মানবিক বিভাগে ১২ তম, ২০০০ সালে মো. কুদরতুল্লাহ্ বাণিজ্য বিভাগে সকল বিভাগে প্রথম, মো. আল-মামুন মানবিক বিভাগে দ্বিতীয়সহ ৩জন, ২০০১ সালে মায়মা আকতার রিপা মানবিক বিভাগে প্রথম, সুমনা গুপ্ত মানবিক বিভাগে দ্বিতীয়, মো. শহিদুল ইসলাম বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয়সহ ৮জন মেধা তালিকা স্থান করে নেয়। ২০০২ সালে ফাতেমা বিনতে আহাদ মানবিক বিভাগে সকল বোর্ডের মধ্যে প্রথম, মোসাম্মৎ ফজিলাতুন্নেছা মানবিক বিভাগে দ্বিতীয়, সুমন দেব মানবিভাগে তৃতীয়, মলয় রায় ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় প্রথম, তানভীরুল ইসলাম মাহিম ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় তৃতীয় স্থানসহ ১৮জন বরিশাল বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান দখল করে।
২০০৩ সালে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সর্বোচ্চ সংখ্যক ২৭ জন জিপিএ (এ) প্রাপ্ত, ২০০৪ সালে ১৬জন জিপিএ (এ)+ প্রাপ্ত হয়, ২০০৫ সালে ৩৮জন জিপিএ ৫, ২০০৬ সালে ৭২জন, ২০০৭ সালে ৪১জন, ২০০৮ সালে ১১২জন এবং ২০০৯ সালে ১৩৩জন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫প্রাপ্ত হয়। বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত সকল পরীক্ষায় প্রতিষ্ঠানটি শ্রেষ্ঠত্বের গৌরব অর্জন করে চলেছে। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বরিশাল বোর্ডের সর্বাধিক জিপিএ ৫ প্রাপ্তির গৌরবও এ কলেজটির দখলে রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে সন্তোষজনক ফলাফল করছে প্রতিষ্ঠানটি।
একজন স্বশিক্ষিত মানুষ অমৃত লাল দে’র অবদান আজ সারা দেশের মানুষের কাছে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। নিজে শিক্ষার সুযোগ না পেলেও অর্থকষ্টে যেন কোন মানুষ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয় এটাই ছিল অমৃত লাল দে’র ব্রত। আজন্ম তিনি সেই ব্রত পালন করে গেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রে অবদান রেখে গেছেন অমৃত লাল দে। আজো সেই ধারা অব্যাহত রেখে চলেছে অমৃত পরিবার। তাঁর ছোট ভাই বিজয় কৃষ্ণ দে বড় ভাই অমৃত লাল দে’র পথ অনুসরণ করে চলেছেন। অমৃতবাবু হয়তো আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু তাঁর অবদান এবং সৃষ্টি তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে। তাঁর দেওয়া অমৃত বাণি ‘কর্মই ধর্ম’র মাঝখানে। মানুষ ধর্মে নয়, কর্মে বাঁচবে সেই প্রত্যাশা রেখ অমৃত লাল দে’র প্রতি আবারো বিনম্র শ্রদ্ধা।