কাজের মধ্যেই ধর্মকে পেয়েছেন অমৃত লাল দে

একজন কাজ পাগল মানুষ অমৃত লাল দে। বাহ্যিক ধর্মকে পাশে রেখে কেবল কাজ করে গেছেন আজন্ম। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষ বাঁচে তাঁর কর্মগুণে ধর্মে নয়। তাই নিজেই সৃষ্টি করে গেছেন ‘কর্মই ধর্ম’ এই মহান উক্তি। ধর্মীয় চেতনার উর্ধ্বে থেকে কর্মকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন অমৃত বাবু। আজন্ম ‘কর্মই ধর্ম’কে লালন করে গেছেন। অমৃত লাল দে বলতেন, মানুষ বাঁচে তার কর্মের মাঝে, ধর্মে নয়।’ তাঁর কর্মময় জীবনের মাঝেই তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। অমৃত লাল দে যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততোদিন তিনি কেবল কাজই করে গেছেন। কাজের মধ্যেই তিনি ধর্মকে পেয়েছেন। কোন বিশেষ ধর্ম দিয়ে তিনি মানুষকে বিচার করতেন না। তাঁর কাছে একটাই পরিচয় ছিল মানব জাতি। একই সঙ্গে মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিবেদন করে গেছেন। তিনি বলতেন, ‘কর্মই মানুষের প্রধান ধর্ম হওয়া উচিত’।
এমন অমৃত বাণি আজন্ম লালন করা একজন স্বশিক্ষিত, সমাজ সচেতন, আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগরের নাম হচ্ছে অমৃত লাল দে। কোন বিশেষ ধর্ম তাঁকে আবৃত্ত করতে পারেনি। মানব সেবা ধর্মই তাঁর কাছে ছিল প্রধান উপজীব্য। মানুষের মাঝে সেবার ব্রত নিয়ে ছিলেন সদা জাগ্রত। সমাজের নানা প্রতিকূলতার স্বাক্ষী হয়েছেন তিনি। স্রোতের অনুকূল এবং প্রতিকূল পরিবেশ ছিল তাঁর কাছে স্বচ্ছ কাঁচের মতো পরিচিত। নানা চড়াই-উৎড়াইয়ের মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠেছেন গর্বিত অমৃতভাষী, সদানন্দময় অমৃত লাল দে। ১৯২৪ সালের ২৭ জুন বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। অমৃত বাবু হিসেবে দক্ষিণাঞ্চলের সব ধর্মের মানুষের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। উদার চিন্তার এই মানুষটি ১৯৯৩ সালের ১৪ জুন ৬৯ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর প্রতি আমাদের বিন¤্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।
একজন স্বশিক্ষিত উদার সমাজ সচেতন মানুষ ছিলেন অমৃত লাল দে। যে বয়সে লেখাপড়া করার কথা সেই বয়সে তাঁকে সংসারের কঠিন জীবন সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হয়েছে। স্বশিক্ষিত অমৃত লাল দে তাঁর কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে একদিকে যেমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন। তেমনি মানুষের সুখ-দু:খে সহমর্মী হয়ে পাশে থেকেছেন আজন্ম। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র কোন বাদ বিচার ছিল না এই মানুষটির কাছে। তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখতেন। ধর্ম দিয়ে পার্থক্য করাকে তিনি মানুষের মধ্যে একধরণের বিভেদ বলে মনে করতেন। তাইতো তিনি উদার হস্তে সব ধর্মের অবহেলিত, সুবিধা বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সবসময়। ধর্মের প্রতি দুর্বলতা না থাকার কারণে তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে দাহ না করে সমাহিত করা হয়েছে। তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত ‘অমৃত বাতিঘর’ হিসেবে খ্যাত অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয় চত্ত্বরে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
সংসারের কর্ণধার হবার কারণে লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন অমৃত লাল দে। সংসারের হাল ধরার কারণে অমৃত বাবু স্কুলে পড়ার তেমন সুযোগ পাননি। তাই বলে বইয়ে গন্ধ তাঁকে দূরে রাখতে পারেনি। স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন তিনি। নিজের হাতে লিখে রাখতেন নিত্যদিনে ঘটনা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারায় এক ধরণের মনোকষ্ট ছিল অমৃতবাবুর। তাঁর মনোকষ্ট দূর করতে ছোট ভাইদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। এধরণের আত্ম দহন থেকে অমৃত বাবু মনে মনে ঠিক করেন শিক্ষা বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়াতে হবে। অর্থাভাবে যারা পড়াশুনা করতে পারছে না তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে এলেন তিনি। নিজে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় অমৃত বাবু তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে সবচেয়ে বেশি আর্থিক সহযোগিতা করেছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বরিশালের খুব কম সংখ্যক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা পাওয়া যাবে যেখানে অমৃত বাবু আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেননি। একজন শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক ও দানবীর হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিতি লাভ করেন। বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানসহ মসজিদ, মন্দির, সামাজিক সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রেই সমুজ্জল সাক্ষর রেখে গেছেন আর্থিক সহযোগিতার মধ্যদিয়ে।
এতো কিছুর পরও তিনি তৃপ্ত হতে পারছিলেন না। অতৃপ্ত বাসনা তাঁকে সব সময় তাড়া করে বেড়াত। অর্থ কষ্টে জর্জরিত ছাত্রদের কিভাবে সহযোগিতা দিয়ে শিক্ষা জীবন নিশ্চিত করা যায় সেই চিন্তাই করতেন সর্বদা। সে তাড়ণা থেকেই তিনি কলেজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। ১৯৮৭ সালে জগদীশ সারস্বত বালিকা বিদ্যালয়ে একটি নাইট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘ ৬ বছর এ প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র-ছাত্রী ভাল ফলাফল অর্জন করে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে তৃপ্ত হতে পারছিলেন না অমৃতবাবু। মনে মনে চিন্তা করছিলেন একটি পুর্নাঙ্গ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার।
একটি পুর্নাঙ্গ কলেজ প্রতিষ্ঠায় ব্যাকুল অমৃত লাল বরিশালের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করেন। নানামূখি পরামর্শ ও আলোচনার পর উদ্যোগ নেন কলেজ প্রতিষ্ঠার। শুরু হয় কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কাজ। সবার ইচ্ছায় অমৃত লালের নামেই নামকরণ করা হয় কলেজের। অমৃত লাল দে তাঁর স্বত্ত্ব দখলীয় সাতশত আটাশ সহস্রাংশ জমি অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ের নামে দান করে দেন। শিক্ষা বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পূর্ব পর্যন্ত ৩ বছর কলেজের সকল শিক্ষকের বেতন ও অন্যান্য যাবতীয় খরচ ব্যক্তিগতভাবে তিনিই বহন করেছেন। অবশ্য এখনও কলেজটির উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কাজে প্রয়াত অমৃত লাল দের ছোট ভাই বিজয় কৃষ্ণ দে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছেন বড় ভাইয়ের পথ অনুসরণ করে। বিজয় কৃষ্ণ দে বড় ভাই অমৃত লাল দের কর্মময় জীবন এবং মানুষের সঙ্গে রেখে যাওয়া সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে চলেছেন। অমৃত ভান্ডার হিসেবে উদার হস্তে ধারাবাহিকভাবে সমাজের উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছে এই পরিবার।
১৯৯২-৯৩ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়। স্থাপনা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার দিক বিচারে একটি অনন্য সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করছে কলেজটিতে। ছাত্র রাজনীতি বিহীন একটি আদর্শ কলেজ হিসেবেই এটি দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক পরিচিত। উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে মানবিক বাণিজ্য ও বিজ্ঞান এবং স্নাতক (পাস) শ্রেণিতে বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিভাগ চালু রয়েছে।
কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠাতা অমৃত লাল দে’র স্ত্রী যোগমায়া দে’র নামে বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। প্রতি বছর ১৭জন মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের এ বৃত্তি প্রদান করা হয়। প্রত্যেককে মাসিক ৫০০ টাকা এবং বছরে দুই বার বই কেনার জন্য ১০০০+১০০০= ২০০০ টাকা প্রদান করা হয়। এমনকি অনেকের থাকা-খাওয়া পর্যন্ত পরিচালনা পরিষদের পক্ষে করা হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলে একমাত্র বেসরকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কলেজটি যশোর ও বরিশাল বোর্ডের মধ্যে অনন্য কলেজের স্বীকৃতি পেয়েছে।
একজন স্বশিক্ষিত মানুষ অমৃত লাল দে’র অবদান আজ সারা দেশের মানুষের কাছে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। নিজে শিক্ষার সুযোগ না পেলেও অর্থকষ্টে যেন কোন মানুষ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয় এটাই ছিল অমৃত লাল দে’র ব্রত। আজন্ম তিনি সেই ব্রত পালন করে গেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রে অবদান রেখে গেছেন অমৃত লাল দে। আজো সেই ধারা অব্যাহত রেখে চলেছে অমৃত পরিবার। তাঁর মেজো ভাই রাখাল চন্দ্র দে, ছোট ভাই বিজয় কৃষ্ণ দে বড় ভাই অমৃত লাল দে’র পথ অনুসরণ করে চলেছেন। অমৃতবাবু হয়তো আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু তাঁর অবদান এবং সৃষ্টি তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে। তাঁর দেওয়া অমৃত বাণি ‘কর্মই ধর্ম’র মাঝখানে। মানুষ ধর্মে নয়, কর্মে বাঁচবে সেই প্রত্যাশা রেখ অমৃত লাল দে’র প্রতি আবারো বিনম্র শ্রদ্ধা।