কামাল লোহানী ছিলেন সংস্কৃতি-রাজনীতি-সাংবাদিকতার বাতিঘর

‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পূণ্য করো দহনদানে...’ রবীন্দ্রনাথের এই গানের সুরে বাংলাদেশের রাজনীতি-সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতির বাতিঘর কামাল লোহানীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বরিশাল জেলা সংসদ। স্মরণ সভায় বক্তারা বলেন, কামাল লোহানী ছিলেন, সংস্কৃতি-রাজনীতি ও সাংবাদিকতার বাতিঘর। তিনি ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম মুক্তিযুদ্ধ শব্দসৈনিক। তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভা বাংলাদেশকে প্রগতিশীল ভাবধারায় এগিয়ে নিয়ে গেছে।
গতকাল রোববার সন্ধ্যা সাতটায় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বরিশাল জেলা সংসদ কার্যালয়ের অনুষ্ঠিত স্মরণ সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা।
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বরিশাল জেলা সংসদের সভাপতি সাইফুর রহমান মিরণের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্মরণ সভায় কামাল লোহানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তৃতা করেন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট মানবেন্দ্র বটব্যাল, মুকুল দাস, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট বিশ্বনাথ দাস মুনশী, বরিশাল নাটকের সভাপতি কাজল ঘোষ, বাংলাদেশ আাবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিম-লীর সদস্য ও বরিশাল নাটকের সাবেক সভাপতি আজমল হোসেন লাবু, বরিশাল নাটকের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক সঞ্জয় সাহা, উদীচী বরিশাল জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক স্নেহাংসু বিশ্বস।
স্মরণ সভায় বক্তারা বলেন, কামাল লোহানী ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনে জড়িত হন। ১৯৫৩ সালে এডওয়ার্ড কলেজে নুরুল আমিন ও অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতাদের আগমনের বিরোদ্ধে শিক্ষার্থীদের এক প্রতিবাদী বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের রাজনৈতিক মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে গ্রেপ্তার হন। তখন তিনি শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কারাবাস করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন।
১৯৫৫ সালে কামাল লোহানী দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তাসহ বিভিন্ন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে নৃত্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং পাকিস্তান সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হিসেবে বেশ কিছু দেশে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ নাট্যে অংশ নেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের উপর তৎকালীন পাকিস্তান করকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ওই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ছায়ানটের নেতৃত্বে জন্মশতবার্ষিকী পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কামাল লোহানী। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছায়ানট সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৭ সালের ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে কামাল লোহানী সমস্ত আন্দোলনে সঙ্গে থেকে কাজ করেছেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কামাল লোহানী। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জনের সংবাদ বেতারে তিনিই প্রথম পাঠ করেন। বেতারে তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমরা বিজয় অর্জন করেছি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।’ একই বছরের ২৫ ডিসেম্বর তাকে ঢাকা বেতারের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ধারাবিবরণী এবং ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমানের কলকাতা সফর উপলক্ষে তৎকালীন দমদম বিমানবন্দরেও ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন।
১৯৭৩ সালে তিনি পুনরায় সাংবাদিকতায় ফেরেন। তিনি ১৯৭৪ সালে বঙ্গবার্তা, এরপর দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে যোগদান করেন কামাল লোহানী। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। পরে তিনি আবারো বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের দায়িত্ব নেন। ২০০৯ সালে তিনি পুনরায় তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর অবসর গ্রহণ করেন। তিনি চার বছর বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আজন্ম একজন প্রচারবিমুখ মানুষ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক চিন্তায় বিকশিত করার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন।