কিউই বধে বাংলাদেশের নতুন ক্রিকেট

ঘুম ঘুম চোখে যারা আজ টিভি সেটের সামনে বসেছিলেন। তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি এমন গৌরবময় ভোরের সাক্ষী তারা হতে চলেছেন। যে ৫টি দিন পাঁড় ভক্তরা চোখে পানি ছিটিয়ে টিভির সামনে বসেছিলেন। সেই তারাই আবিষ্কার করলেন, মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের ঐতিহাসিক জয় তাদের চোখে এনে দিয়েছে আনন্দাশ্রু!
এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক? যে কিউই কন্ডিশন দুর্গম গিরি হয়ে উঠেছিল। টানা পাঁচটি দিন সেই কন্ডিশনেই অপ্রতিরোধ্য মূর্তিতে দেখা গেছে বাংলাদেশকে। তাতে ক্রিকেটের বহু পুরনো কথাই ঘুরে ফিরে আসতে লাগলো বাংলাদেশের বীরত্বে- ক্রিকেট ইজ আ গ্রেট লেভেলার! যা কেড়ে নেয়, তা আবার ফিরিয়েও দেয়। যেমনটা দেখা গেলো নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধ কন্ডিশনে।
মুশফিকের কাট শটে সফরকারীরা যখন জয়ের বন্দরে পৌঁছে, বাংলাদেশে তখন মাত্র ভোরে সূর্যের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ভোরের সেই আলোটা ছিল যেন গৌরবের। কিউইদের বিপক্ষে ৮ উইকেটের টেস্ট জয়টা তখন এমন বার্তাই দিতে চেয়েছে- নতুন সূর্যোদয়ের দেখা মিলতে চলেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে!
বাংলাদেশের জন্য এটি কেবল একটি জয়ই নয়, অনেক কিছুর প্রাপ্তিও। প্রথম টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে কোনও ম্যাচই জেতা হয়নি বাংলাদেশের। কেবলমাত্র একটি ম্যাচ ড্র করতে পেরেছিল। ফলে পয়েন্ট টেবিলেও জায়গা হয় তলানীতে। গত নভেম্বরে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ দিয়ে শুরু হয় নতুন চক্রে চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই। পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই লড়াইয়ের শুরুটা বাজে ভাবে হলেও নিউজিল্যান্ডে এসে কাঙ্ক্ষিত জয়ের দেখা মিললো অবশেষে। তাও আবার ইতিহাস গড়ে- বুধবার ৮ উইকেটে পাওয়া জয়টা আসলে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে যেকোনও ফরম্যাটেই বাংলাদেশের প্রথম।
অথচ ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ড বরাবরই বাংলাদেশের জন্য বিভীষিকার এক নাম। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের যেকোনও দলের জন্যই নিউজিল্যান্ডের কন্ডিশন আতংক ছড়িয়ে থাকে। তারপরও নতুন বছরে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে পুরনো ব্যর্থতা থেকে আলো খোঁজার মিশনে নেমেছিল মুমিনুলরা। স্বাভাবিক ভাবেই কিউই কন্ডিশনে ম্যাচ জয়ের কথা বলাটা খানিকটা বাড়াবাড়িই শোনায়। কেননা ঘরের মাঠে অনেকটা অপ্রতিরোধ্যই থাকে নিউজিল্যান্ড। যারা টানা ১৭ ম্যাচ অপরাজিত। এমন দলের বিপক্ষেও মুমিনুল প্রত্যাশার কথা শুনিয়েছিলেন এভাবে, ‘সবকিছু মিলিয়ে নতুন বছরে আমি খুব রোমাঞ্চিত। ভালো শুরুর প্রত্যাশায়ৃ।’
মুমিনুল অবশ্য কথা রেখেছেন। আগের ৯ টেস্টের ৫টিতে ইনিংসে হারা দলটিই দুই সেশন আগে দাপটের সঙ্গে খেলে ৮ উইকেটে হারিয়ে দিয়েছে নিউজিল্যান্ডকে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে ইতিহাসে নিশ্চিত ভাবেই তা বিশাল প্রাপ্তি।
মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে ছিলেন না অভিজ্ঞ দুই ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল। তাদের ছাড়া অনেকটা অনভিজ্ঞ দল নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন মুমিনুলরা। কিন্তু অনভিজ্ঞ দল হলেও বিন্দুমাত্র ছাড় পায়নি নিউজিল্যান্ড। কেননা এই তরুণদের ছিল শক্ত মনোবল, জয়ের তীব্র তাড়না।
তাছাড়া টেস্ট ক্রিকেটে বরাবরই বাংলাদেশের ব্যাটারদের প্রসেস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে প্রতিনিয়ত। অন্তত এই টেস্টে সেই প্রসেস নিয়ে প্রশ্ন উঠার কোনও সুযোগ নেই। প্রত্যেকে ব্যাটারই প্রসেস মেনটেইন করে ব্যাটিং করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি জয়ের জন্য ৪০ রানের স্বল্প পুঁজি পাওয়ার পরও দেখা যায়নি আগ্রাসী কোনও মনোভাব। সহজাত ব্যাটিংয়ে ২ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে। এই কারণটাই মূলত ব্যাটারদের কঠিন কন্ডিশনে জয় পেতে সাহায্য করেছে।
প্রথম ইনিংসে সাদমান ও মাহমুদুল হাসান জয়ের ৪৩ রানের জুটিটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পুরো ১৮ ওভার খেলা সাদমান-জয়ের জুটি ভাঙে সাদমানের বিদায়ে। কিউইদের নতুন বলটি পুরনো হওয়ার পর শান্ত-জয়-লিটন-মুমিনুলদের জন্য কাজটা আরও সহজ হয়ে যায়। প্রত্যেকেই প্রচুর বল খেলার চেষ্টা করেছেন। তবে ১৩০ রানের লিড নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা ছিল মিরাজের। চতুর্থ দিনের সকালে ইয়াসিরকে সঙ্গে নিয়ে লোয়ার অর্ডারে দারুণ ব্যাটিং করেছেন এই স্পিনিং অলরাউন্ডার।
পরের গল্পটা সবারই জানা। বিমানবাহিনীতে কর্মরত পেসার এবাদত হোসেনের গতিতেই খেই হারায় স্বাগতিকরা। চতুর্থদিনের শেষ বিকালে কোনও রান না দিয়ে কিউইদের মিডল অর্ডার ধসিয়ে দিয়েছেন। বুধবার সকালেও ছিল একই চিত্র। ১৪৭ রান নিয়ে ব্যাটিং করতে নেমে নিউজিল্যান্ড থেমে যেতে বাধ্য হয় ১৬৯ রানে। এবাদত ও তাসিকনের তোপে মাত্র ২২ রান তুলতেই বাকি পাঁচ উইকেট হারায় নিউজিল্যান্ড।
তাতে সফরকারীরা পায় ৪০ রানের সহজ লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে খেলতে নেমে ইনজুরিতে ছিটকে যাওয়া জয়ের বদলে ওপেনিংয়ে নামেন নাজমুল হোসেন শান্ত। দলীয় ৩ রানে সাদমান ফিরে গেলেও জয় পেতে কোনও সমস্যা হয়নি। যদিও ৬ রান দূরে থাকতে শান্তও ফিরে গেছেন। ক্রিজে তখন ছিলেন মুশফিক। দু’বার সিঙ্গেল নিয়ে প্রান্ত বদল করেছেন। তার পর কাইল জেমিনসনের ওভারে চতুর্থ বলে বাউন্ডারি মেরেই মুশফিক ইতিহাস গড়তে সাহায্য করেছেন। যে ইতিহাসে নতুন দিনের ক্রিকেটের সূর্যোদয়টাও দেখা মিলতে শুরু করলো যেন!