খলিলুর রহমান ফারুক জীবন নাটকের শেষ দৃশ্যে

খলিলুর রহমান ফারুক জীবন নাটকের শেষ দৃশ্যে

সাংবাদিক স্বপন খন্দকার নাট্যজন সৈয়দ দুলালের মালিকানাধীন ‘দৈনিক আজকের পরিবর্তন’ এর র্বাতা সম্পাদক থাকাকালীন আমাকে একটা অভিধা দিয়েছিল ‘অন্তিম প্রতিবেদক’। আজও সেই অভিধা আমি অক্ষরে অক্ষরে বজায় রেখে চলছি।

আজ যাকে নিয়ে আমার লেখা গুরুবাত তিনি প্রয়াত খলিলুর রহমান ফারুক। অনেক গুণে গুণী ছিলেন তিনি। নাট্যকার কবি ও নজরুল অনুরাগী। প্রথম জীবনে তিনি ফারুক খান বেবী নামে কবিতা লিখতেন। কবিতা লিখে এনে আমাকে দেখাতেন। আমি জীবনে কবিতা লিখিনি বরং গদ্য রচনায় স্বচ্ছন্দ। তবু কেন জানি তার মনে হত কবিতা বিষয়ে আমি প্রাজ্ঞ। এরই মধ্যে বেশ কিছু কবিতা তার ছাপা হতে থাকে বিভিন্ন পত্রিকায়। তারপর একদিন ‘কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি’ বলে কবি ফারুক খান বেবী হারিয়ে গেলেন। 

এরপর থেকে আমরা পেতে শুরু করি খলিলুর রহমান ফারুককে। বিরশালের সর্বজন শ্রদ্ধেয় একুশে পদকপ্রাপ্ত নিখিল সেনের তিনি সরাসরি ছাত্র ছিলেন কর্ণকাঠী গাউছে রহমানিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। নিখিল সেনের কাছে আবৃত্তির প্রথম পাঠ নেন। ভরাট কণ্ঠে যখন আবৃত্তি করতেন তখন যেকোন শ্রোতার মুগ্ধতা কেড়ে নিত। সেই সাথে শিখতেন নিখিল সেনের কাছে অভিনয়ের কলাকৌশল।

যতদূর জানি প্রথমে শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটারের সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও পরর্বতীকালে খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটারে যোগদেন। এ সময়ে মিন্টু বসু রচিত ‘অন্য এক কালপাহাড়’ নাটকে অভিনয় করেন। এই নাটকটি বিটিভিতে মঞ্চ নাটক হিসেবে সম্প্রচারিত হয়েছিল খেয়ালীর পরিবেশনায়। এরপরে তাঁকে পঞ্চসিঁড়ি গ্রুপ থিয়েটারের সভাপতি হিসেবে আমরা দেখতে পাই।

পঞ্চসিঁড়ির সম্পাদক মিজানুর রহমান জানায়, খলিলুর রহমান ফারুক তাঁর নিজের লেখা ‘মুকুন্দ দাস’ নাটকটি তাঁরই নির্দেশনায় অশ্বিনী কুমার হল মঞ্চে অভিনীত হয়। এ নাটকে তিনি নিজেও অভিনয় করেন। এছাড়া ‘পঞ্চসিঁড়ি’র আরও দুটি নাটকের নির্দেশনা দেন। একটি ‘কদম মুন্সীর ঠিকানা’ অপরটি ‘রক্তঝরা এদেশ’। তবে পঞ্চসিঁড়ি’র ‘মুকুন্দ দাস’ নাটকটি দর্শক প্রশংসিত হয়। নাটক নিয়েই মেতে রইলেন বেশ কিছুদিন। তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে ‘পঞ্চসিঁড়ি’ নাট্যদল একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই সময় বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদ আয়োজিত শহীদ মিনার কেন্দ্রিক অনুষ্ঠানে তাঁকে আলোচকের আসনেও দেখা যায়।

তানসেন সঙ্গীত বিদ্যালয় বরিশালের একটি পুরোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন। এই সংগঠনের সাথে একটি নাম জড়িয়ে আছে। যার নাম ওস্তাদ বিনয় ভূষন দাস বাহাদুর। তবলা গুরু। ওস্তাদ বিনয় ভূষণের তবলায় শিক্ষা নেয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে ক’জন তারা হল নাজির হোসেন, বিনয় দেবনাথ, উত্তম বড়ুয়া ও প্রবীর বণিক। এই তানসেন সঙ্গীত বিদ্যালয়েরও সভাপতি ছিলেন খলিলুর রহমান ফারুক। এই সংগঠনের রবীন্দ্র –নজরুল জয়ন্তী এবং বর্ষবরণ অনুষ্ঠনের আমন্ত্রণ পেতাম বিনয় ভূষণ মান্ডলের মাধ্যমে। নজরুল জয়ন্তীর অনুষ্ঠান গেলে খলিলুর রহমান ফারুক আগেই বলে রাখতেন ‘মুকুল দা, আমি বলবো নজরুলের সাহিত্য সম্পের্কে, আর আপনি বলবেন নজরুলের গান নিয়ে’। আমি মেনে নিতাম। পরে আলোচনা শেষে তিনি বলতেন, ‘আপনার কণ্ঠে নজরুলগীতি শুনতে চাই’। তখন অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে হত।

অনেক সময় তাঁকে আমি খরফা বলে ডাকতাম। খলিলুর রহমান ফারুকের আদ্যাক্ষর নিয়ে খরফার সৃষ্টি। যেমন করে কবি পলাশ বালা মানিক আমার কাছে পবামা। নজরুলের ওপর পড়াশুনোছিল তাঁর সুপ্রচুর। নজরুল বিষয়ে অনেকে তাঁর ধারে কাছেও যেতে পারবেন না। এ মন্তব্য অনেকের কাছে অতি কথন মনে হতে পারে, তবে অগ্রগন্য নজরুল প্রেমী হিসেবে তাঁকে আমি মানি। 

আমি তাঁর মৃত্যু সংবাদ পাই নজরুল ইসলাম চুন্নুর কাছে প্রথম। চুন্নু জিজ্ঞেস করে, ফারুখ সাহেবকে শেষ দেখা দেখতে যাবি? আমি সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে এসে চুন্নুর সাথে রিক্সায় উঠে পড়ি। গিয়ে দেখি শায়িত তাঁর শবদেহ। জীবিতাবস্থায় হাসি হাসি মুখে কথা বলতে, তবে হাসি মুখ আছে ঠিকই কিন্তু নির্বাক। শুনেছিলাম তাঁর মৃত্যু হয়েছিল বাথরুমে। তাঁর মৃত্যুর পরে ‘পঞ্চসিঁড়ি’ আয়োজিত একটি শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটার মিলানায়তনে। সেখানে আমি স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলাম, কোন এক কবির লেখায় পড়েছি, নাম মানে নেই ‘শোকের আয়ু বাহাত্তুর ঘন্টা’ কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যতদিন পঞ্চসিঁড়ি ও তানসেন সঙ্গীত বিদ্যালয় থাকবে ততদিন এই দুই সংগঠনের শিল্পী-কর্মীরা শোক বহন করবে অনেকদিন। সব শেষে বলি তিনি ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিখিল সেনের একলব্য শিষ্য।