খাল-পুকুর সংরক্ষণ করতেই হবে

বাংলার ভেনিস বরিশাল। অসংখ্য খাল দ্বারা বেষ্টিত অপরূপ সুন্দর দৃশ্য দেখে কবি সেই ভেনিস নগরের সঙ্গে বরিশালের তুলনা করেছিলেন। ছিল সেই নগরের মতো সুন্দর বরিশাল। খালগুলো দিয়ে জোয়ারের পানি যেমন নগরে প্রবেশ করতো, তেমনি ভাটার সময় নগরে সব আবর্জনা ধুয়ে মুছে নিয়ে যেত। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আমরা অনেক উন্নত হয়েছি। উন্নত হতে হতে আমরা ইট-কাঠের চাকচিক্যের মধ্যে প্রবেশ করেছি। এখন আর আমরা কেউ নগরের মধ্যে মাটি দেখতে চাই না। মাটি হচ্ছে নোংড়া, পঁচা। ওসব দেখবে গ্রামের চাষাভুষারা। আমরা আধুনিক শহরের বাসিন্দা, আমাদের কি ওসবে মানায়। তাই তো মাটির সব খাল ভরাটের উৎসবে মেতে উঠেছি। শহরের মধ্যে যতো মাটির খালে পানি প্রবাহিত হতো তার প্রায় সবগুলোর পথ চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেইসব খাল এখন এক-দুই ফুটের নান্দনিক ড্রেনে রূপ নিয়েছে। টাইলস সমৃদ্ধ ড্রেনরূপী খালের ওপর দিয়ে হাঁটছি আর প্রশংসা করছি, কতই না সুন্দর ফুটপাথ। এই সুন্দর আমাদের আজ পানিতে ডুবিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে তোমাদের খালগুলো ফিরিয়ে আনো। তা না হলে তোমাদের মুক্তি নাই। তাই আমাদের খাল-পুকুর সংস্কার এবং সংরক্ষণের দিকে নজর দিতেই হবে।
ধান-নদী-খালের বরিশাল আজ একটু বৃষ্টি কিংবা জোয়ারের পানিতে ডুবে যাচ্ছে। এমন অবস্থার জন্য দায়ী আমরা। আমরাই অতি অধুনিক হতে হতে আমাদের নগরের খাল এবং পুকুরগুলো ভরাট করে বড় বড় ইমারত নির্মাণ করেছি। আজকে নির্মিয়মান বরিশাল পৌরসুপার মার্কেট একটি সুবিশাল পুকুর ছিল। এই পুকুরের সঙ্গে ছিল খালের সংযোগ। যার মাধ্যমে নগরের আবর্জনা ধুয়ে-মুছে নিয়ে যেত কীর্তনখোলায়। বরিশালে মডেল স্কুল ও কলেজ নির্মাণের নামে ভরাট করা হয়েছে বিশাল দিঘি। যার সঙ্গে যুক্ত ছিল নাপিতের খাল। প্রবাহিত হয়ে নিয়ে যেত সাগরদি খালে। ভরাট করা হয়েছে ত্রিশ গোডাউনের দিঘি। অর্ধেক ভরাট হয়েছে পুলিশ লাইনের বিশাল পুকুর। অশ্বিনী কুমার দত্তের বাসভবনের সামনে সুবিশাল পুকুর ভরাট করে ডোবা তৈরি করা হয়েছে। কাউনিয়ার পুকুর ভরাট করে স্কুল হয়েছে। উন্নয়নের নামে এরকম অসংখ্য পুকুর-খাল ভরাট করে জঞ্জালের নগরে পরিণত করা হয়েছে বরিশালকে। ৮০ দশকের শেষ দিকে এবং ৯০-এর দশকের শুরুতে খাল-পুকুর ভরাটের মহোৎসব শুরু হয়। যার পরিণতি হচ্ছে আজকের বরিশাল। একটু বৃষ্টি এবং জোয়ারের জলে প্লাবন দেখা। বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ডুবে যায়। দিশেহারা হয়ে সাঁতরে বেড়াই আমরা আধুনিক শহরে।
অর্ধশতাধিক খাল ভরাট হয়ে গেছে। হাতে গোনা কয়েকটি খাল মৃতপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। এখনো সময় আছে অবশিষ্ট খাল খনন ও সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়ার। সঙ্গে সঙ্গে দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধার করার। একই সেঙ্গ নতুনভাবে ড্রেনেজ ব্যবস্থা সাজানোর চিন্তা করার। তাহলে অন্তত জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে। বাংলার ভেনিস বরিশালকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই এর খাল-পুকুর সংস্কার ও সংরক্ষণের দিকে নজর দিতে হবে। আর সেটা কেবল আশ্বাস নয়, বাস্তবমূখি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এখনও সময় আছে, বরিশালের অবশিষ্ট খালগুলো সংষ্কার এবং সংরক্ষণ করলে কিছুটা হলেও জলাবদ্ধতা কমবে। তা না হলে এক সময়ের ভেনিস খ্যাত বরিশাল নগরী বসবাসের অনুপযোগী শহর হিসেবে পরিচিতি পাবে। ভেনিস শহর না হোক, অন্তত জলাবদ্ধতা মুক্ত নগর গড়ে তোলা এখনও সম্ভব। সেজন্য আমাদের বর্তমান ড্রেনেজ ব্যবস্থার পরিবর্তন করা জরুরী। সেক্ষেত্রে ড্রেনের আউটলেট যাতে মূল খালের সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভব হয় সেদিকে নজর দেওয়া একান্ত জরুরী। আর জেলখালসহ অন্যান্য খালে যাতে পানি প্রবাহ বাড়ে তার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে।