গণ গায়কের গান

গণ গায়কের গান

গণশিল্পী মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস হোসেন প্রয়াত হয়েছেন বেশ কয়েকমাস আগে। রাহাত আনোয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। প্রান্তিক সঙ্গীত বিদ্যালয়ের সম্পদাক দেবাশীষ জানিয়েছিল গত ৫ এপ্রিল আক্কাস ভাইয়ের শোকসভা অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল প্রান্তিক কার্যালয়ে। কিন্তু করোনা দুর্ভোগের কারণে শোক সভা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি।

জাীবদ্দশায় আক্কাস ভাই ছিলেন ‘প্রান্তিক’ এর সভাপতি। আক্কাস ভাইকে সম্পূর্ণভাবে জানতে হলে চলে যেতে হবে স্বাধীনতা পূর্বকালে। এই সময়ে তিনি ছিলেন বরিশাল আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। ৬৮ সালে যখন পাকি সরকার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দয়ের করে তখন আক্কাস ভাই এই মিথ্যে মামলার প্রতিবাদ জানিয়ে স্বরচিত গান ‘আগরতালা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু হইয়াছে’ পথে-ঘাটে পরিবেশন করেছেন।

৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানের সময় বরিশালে একটি গসঙ্গীতের স্ক্যোয়াড গড়ে ওঠে। এই স্ক্যোয়াডের দলনেতা ছিলেন আবু-আল-সাইদ নান্টু। এই গণসঙ্গীতের শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন সাহা, মনি দাস, আক্কাস হোসেন, নরেন দাস, মুকুল দাস, সেলিম-বিন আজম ও বাসুদেব সেনগুপ্ত। আক্কাস ভাইয়ের একটা পেটেন্ট গান ছিল নজরুলের ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’। গানটির সঞ্চারী অংশে ওরে মাভৈ, এই মাভৈ শব্দটিকে অনেক প্রলম্বিত করে গাইতেন। সেই গণসঙ্গীত স্ক্যোয়াডের আর নাম-নিশানা নেই এখন। একে একে নিভেছে দেউটি’র মতো। আক্কাস ভাই চলে গেলেন, আমি একা রয়ে গেলাম।

একবার, গণশিল্পী সংস্থা বরিশাল শাখা দুই দিনব্যাপী একটি গণসঙ্গীত প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন আক্কাস ভাই ও আমি। আক্কাস ভাই শিখিয়ে ছিলেন একটি এবং আমি তিনটি গান। প্রশিক্ষণ শেষে প্রর্শিক্ষনার্থীদের সদনপত্রে দুই প্রশিক্ষকেরই স্বাক্ষর লাগে। কিন্তু স্বয়ম্ভূ এবং আমি আক্কাস ভাইকে বারবার ফোন করার পরও আক্কাস ভাই ধরেন না। পরে আমাকে ফোন করে জানান, ‘আমার স্বক্ষর তুমি দিয়ে দাও’। বাংলাদেশ সংগঠন সমন্বয় পরিষদ বরিশাল বিভাগীয় সভাপতি ছিলেন তিনি। সম্পাদক বিশ্ব নাথ দাস মুনশী।

বাংলাদেশ সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ একবার দেশব্যাপী সঙ্গীত প্রতিযোগিতর আয়োজন করে। উল্লেখ্য বরিশালের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী তপন মাম্মুদ এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি। প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে বরিশাল বিভাগের চারটি জেলায়। যথাক্রমে বরগুনা, ঝালকাঠী, পুটুয়াখালী ও ভোলায়। বিচারক হিসেবে আক্কাস ভাই আগেই নির্ধারিত হয়ে আছেন। আমাকে নিয়ে একটু দোনামনা। আমি যেতে রাজি হই কিনা। নাট্যজন কাজল ঘোষ ফোন করে বাসায় আমার স্ত্রীকে বলে, বৌদি মুকুল দা চার দিন বরিশালের বাইরে থাকবেন। আপানার অনুমতি দরকার। আমার স্ত্রী আবর তার কাজল দা’র কোন অনুরোধই ফেলতে পারেন না। পরদিন তুমুল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বিআরটিসি বাস স্ট্যান্ড থেকে যাত্রা বরগুনার উদ্দেশ্যে। দুপুর তিনটায় বরগুনায় পৌঁছে বাসায় ফোন করি সকালে স্নান করে আসিনি, ‘এখন কি স্নান করবো’? একথা আক্কাস ভাই শুনে বরিশালে এসে সবাইর কাছে চাউর করে দ্যায় ‘মুকুল বউর কথা ছাড়া কোন কিছু করেনা’।
 
বিকেল প্রতিযোগিতা শেষে বরগুনার সাংবাদিক ও খেলঘর সংগঠক চিত্তরঞ্জন শীলের বাসায় চায়ের নেমন্ত্রন্ন গ্রহণ করি। পরদিন দুপুরে ঝালকাঠীর উদ্দেশ্যে রওয়না হই। ঝালকাঠীর জেলা প্রশাসাক দুপুরে খাওয়া এবং রাতের খাওয়াসহ সার্কিট হাউসে থাকারও ব্যবস্থা করেন। এই প্রতিযোগিতায় দলীয় সঙ্গীতে প্রথম স্থান অধিকার করে সাবকে উদীচী কর্মী ইকবাল হোসেন মন্টুর দল। পরদিন ভোলায় প্রতিযোগিতা। ভোলার সাংবাদিক-গায়ক আনসারউদ্দীন বাবুল আমাদের অভ্যর্থনা জানান। প্রতিযোগিতা ভালোভাবে শেষ হল। শেষ প্রতিযোগিতা পটুয়াখালীতে। পটুয়াখালীর গৌতমের অতিথেয়তায় এবং প্রতিযোগিতায়  আমরা অত্যন্ত খুশি হলাম।

বরিশালের সাবেক জেলা প্রশাসক শাহীদুল আলম সার্কিট  হাউসে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রর কণ্ঠযোদ্ধা বরিশালের জামাই ও আমার বন্ধু মনোরঞ্জন ঘোষালকে সংবর্ধনা দেয়। এসময় ঘোষাল ওর সাথে গাইতে আমাকে ডেকে নেয়। আমি ডাকি আক্কাস ভাইকে। ১৯৯৫ সালে বরিশালে প্রবীণ ও নবীন নাট্য শিল্পীদের সমন্বয়ে অপরাজেয় কথাশিল্পী সারৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। এ নাটকে ‘দেবদাস’ এর গৃহকর্মী ধর্মদাসের চরিত্রে অভিনয় করেন আক্কাস হোসেন। মঞ্চ পর্যালোচনায় আমি লিখেছিলাম ‘দেবদাস’ নাটকে ধর্মদাস চরিত্রে আক্কাস হোসেনের অভিনয় দেখে রবীন্দ্রনাথের পুরাতন ভৃত্য কেষ্টার কথা মনে পরে যায়। আক্কাস ভাই আজ আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু রয়ে  গেছে তাঁর গান ‘ও আমার বাংলা মা’।