চলে গেলেন দেওয়ান গাজী

আমাদের দেওয়ান গাজী চলে গেলেন। চলে গেলেন বাংলাদেশের নাট্যমঞ্চের অগ্রনায়ক, প্রধান পুরুষ, মহিরূহ জনাব আলী যাকের। চলে গেলেন টেলিভিশনের জনপ্রিয় নাটক বহুব্রীহির অত্যন্ত জনপ্রিয় চরিত্র মামা। চলে গেলেন ম্যাগবেথ। চলে গেলেন মহামহীম গ্যালেলিও। চলেই গেলেন বাঙালির মাটির নির্মোহ কৃষকনেতা নূরলদীন। চলে গেলেন কাঁধে হুলিয়া নিয়ে ফেরা মুক্তিযোদ্ধা আব্বাস। চলে গেলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক। চলে গেলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অভিনেতা আলী যাকের। গত শুক্রবার সকাল ৬টা ৪০ মিনিটের সময় না ফেরার দেশে চলে যান।
অনেক চরাই উৎরাই পেরিয়ে ৭৬ বছরের পথ চলার সমাপ্তি হলো। অথবা বলা যায় হাজার বছরের পথের পথে পা বাড়ালেন এই অসম্ভব গুণি মানুষটি। আবৃত্তিকার, বেতার, মঞ্চ টেলিভিশনের সুঅভিনেতা, নির্দেশক, লেখক, ক্রিকেটের ধারা ভাষ্যকার, সফল বিজ্ঞাপণ নির্মাতা, ফোটগ্রাফার, দেশের অন্যতম বেতিক্রমি বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিকের প্রধান এবং একজন নিখাদ রবীন্দ্র অনুরানী জনাব আলী যাকের। মাত্র থেমে গেলো যার পথ চলা, সেই পথের দিকে দৃষ্টি করিয়া স্থাপন, অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাকে স্মরণ করেছেন সকলে। অবনত শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, অভিব্যক্তি উচ্চারণ করেছেন।
বলেছেন আবুল হায়য়াত, ‘বাংলা মঞ্চের দেওয়ান গাজী, নূরলদীন, ম্যাকবেথ, গ্যালেলিও- তোমাকে টুপি খোলা বিদায় সম্ভাষণ, স্যালুট বন্ধু।’ আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন, ‘আমার জীবনের সার্বিকতায় আলী যাকের’। অসাধারণ বলেছেন সূবর্ণা মুস্তফা, ‘ছটলু ভাই, ভালোবাসা রইলো। আবার দেখা না হওয়া পর্যন্ত’। নূনা আফরোজ, ‘থিয়েটারের সব থেকে উজ্জলতম বাতিঘর, স্বাধীন দেশের প্রথম বিস্ময় অভিনয় প্রতিভা আলী যাকের, আমাদের ছটলু ভাই’। বিজরি বকতউল্লা বললেছেন, ‘এ কোন সকাল, এ যে রাতের চেয়েও অন্ধকার!’ কে যেনো বললেন, নাট্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরধা অথচ পদ আগলে না থাকা অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আলী যাকের, জীবন নাটকের মঞ্চ ছেড়ে চলে গেলেন। তিনি এমনটা করতে পেরেছিলেন কারণ তাঁর নাট্য ও সাংস্কৃতিক কর্মযোগ ছিলো মনের ক্ষুধা নিবারণের পথ। পেটের ক্ষুধা তিনি নিভিয়েছেন একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে। কখনোই তিনি সাংস্কৃতিক ব্যবসায়ী ছিলেন না। তিনি রেখে গেছেন তার অজস্র গুণমুগ্ধ দর্শক- স্রোতা। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা। রেখে গেছেন মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্রে অভিনিত অজস্র স্মরণীয় চরিত্র সম্ভার। যা তার নিপুন অভিনয় পারদর্শীতায় চির ভাস্বর হয়ে থাকবে প্রজন্মের মাঝে। তাঁর সেই গুণমুগ্ধরা কি করে ভুলে থাকবে তাকে। কি করে ভুলবে তারা টেলিভিশন নাটক বহুব্রীহির মামাকে? কি করে ভুলবে মঞ্চের দেওয়ান গাজী, ম্যাকবেথ, গ্যালেলিওর ও নূরলদীনের ভূমিকায় তার অবিস্মরণীয় অভিনয়?
মানুষ মঞ্চের কাছে এলেই মনে পড়বে তার অভিনিত নাটক- কবর, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, বাকি ইতিহাস, বিদগ্ধ রমনীকুল, তৈল সংকট, সৎ মানুষের খোঁজে, অচলায়তন, কোপেনিকের ক্যাপটেন, ম্যাকবেথ, টেম্পেস্ট এবং কবর দিয়ে দাও। আমরা মনে রাখবো নিশ্চয়ই। মানুষ যেভাবে মনে থাকে মানুষের। আমাদের মনে আছে সম্ভবত ১৯৮৫ সাল। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বরিশাল জেলা সংসদের আমন্ত্রণে বরিশালে এসেছিলেন আলী যাকের, সারা যাকের এবং নাট্য স্বারথী আতাউর রহমান।
ততদিনে ঢাকার নাট্যমঞ্চে নূরলদীনের সারা জীবন নাটক ব্যপক জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছে। দেশের সর্বত্র তখন নাট্যপ্রেমিরা সেই খবরের সাথে দারুনভাবে একাকার। ঠিক সেই সময় বরিশলে অশ্বিনী কুমার হলের মঞ্চে উদীচীর অনুষ্ঠানে নূরলদীনের সারা জীবন নাটকের কিছু অংশ অভিনয় করে দেখালেন অভিনেতা আলী যাকের। কি জীবন্ত সেই অভিনয় স্পষ্ট মনে আছে। এখনো কানে বাজছে সেই সংলাপ ‘শক্ত করি লাঙ্গল তুই ধরিবি ঠাশিয়া, টানি টানি মুঁই যাবো লাঙ্গল চষিয়া’। আজিও আমাদের সেই কথা ষ্পষ্ট মনে আছে। মনে আছে সেই দৃশ্যে আভিনেতা আলী যাকেরের অভিব্যক্তি। যা আমাদের দারুনভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলো। যে কারণে আমরা বরিশাল নাটক পেরেছিলাম ঢাকার বাইরে নূরলদীনের সারাজীবন নাটকের সফল মঞ্চায়ন করতে। সৈয়দ শামসুল হকের সারা জাগানো সেই নাটক ঢাকার নাট্য দল নাগরিকের বাইরে, বরিশালে কেবল বরিশল নাটকই সফল মঞ্চায়ন করতে পেরেছিলো। সেই নাটকের অসাধারণ অবিস্মরণীয় সংলাপ, দ্রোহের সেই উদাত্ত আহবান ‘জাগো বাহে কোণ্ঠে সবাই’। আজো এই শহরে সেই ডাক ডেকে চলেছেন মঞ্চে মাঠে শহীদ বেদীতে বরিশালে নূরলদীন ক্ষ্যাত কাজল ঘোষ। আমাদের প্রেরণা জাগানিয়া সেই বিশাল দেহি ততধিক সেই বিশাল অভিনেতা আলী যাকের, অজস্র গুণি মানুষদের মঞ্চের আলোতে রেখে চলে গেছেন দূর নিলাক্ষায়। একদিন আরন্যকের শ্রদ্ধেয় মামুনার রশিদের হাত ধরে শহীদ মুনির চৌধুরীর কবর নাটক দিয়ে যে মানুষটির মঞ্চ নাটকের পথ চলা, আজ আমাদের সবাইকে ছেড়ে সেই মানুষটি পৃথিবীর মঞ্চ ছেড়ে অন্য আর এক মঞ্চে পা বাড়ালেন যার নামও ‘কবর’। যে নাটকের নাট্যকার বিধাতা।