জিপিএ ফাইভ এর নেশা জন্ম দেয় তথাকথিত ভালো শিক্ষার্থী

জিপিএ ফাইভ এর নেশা জন্ম দেয় তথাকথিত ভালো শিক্ষার্থী

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি নাম সকলের নজর কেড়েছে। সাদা কালো পর্দায় অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে এক কিশোরী। হ্যাঁ, কথা বলছি রেবেকা শফিকে নিয়ে। ১৯৯৩-৯৪ জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বের এই বিতার্কিকের বাচনভঙ্গি মুগ্ধ করেছে সকলকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে এই বিতার্কিকের পরবর্তী জীবনের সাফল্যেরে কথা কারোরই অজানা নয়।

জ্ঞাতার্থে সংক্ষেপে বলে রাখতে চাই, এই বিতার্কিক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তরের পর কৃষ্ণবিবরের ঘুর্ণন গতির উপর ডক্টর অব ফিলোসফি (পিএইচডি) ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর মস্তিষ্কবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ থেকে শুরু করেন গবেষণা। বর্তমানে তিনি একজন সফল বায়োমেডিক্যাল রিসার্চার। এমন সাফল্যের গল্প শুনলে কার না ইচ্ছে হয় রেবেকা শফি হতে। কিন্তু এই ইচ্ছে আর বাস্তবতার মেলবন্ধনের সম্ভাবনা মাপজোখ করতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছিলাম বারবার।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোর বক্তব্যে প্রায়শই একটি আহ্বান উঠে আসে। আহ্বানটির সারবস্ত কিছুটা এরকম ‘আপনার সন্তানকে সাংস্কৃতিক পরিবেশের সাথে পরিচিত করুন। শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ করুন।’ এই আহ্বান যথারীতি বহু মানুষের কর্ণ অবধি পৌঁছালেও কজন যে সে আহ্বানে কর্ণপাত করেন, সেটা আমার কিংবা আপনার কাছে অজানা নয়। যে কারণে হোঁচট খাচ্ছিলাম এবার সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। আজ এমন একটি ভিডিও দেখার পর সন্তানকে হার্ভার্ডে পড়ানোর স্বপ্নে হয়তো কেউ সন্তানকে নিয়ে যাবেন কোনো বিতর্ক কিংবা আবৃত্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সম্ভব হলে নিজেও শিখে নেবেন কিছুটা। তারপর সন্তানের ওপর চলবে জোরদার প্রশিক্ষণ ‘বাবা, এভাবে নয়, ওভাবে’। কিন্তু এর ভবিষ্যত! বর্তমানে তথাকথিত ভালো শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক কিংবা সহশিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হতে খুব বেশি দেখা যায় না। এই তথাকথিত ভালো শিক্ষার্থীদের আত্মপক্ষ সমর্থনযোগ্য যুক্তি কিছুটা এরকম ‘এসব অনেক সময়ের ব্যাপার। এগুলো করলে পড়াশোনার সময় থাকে না।’ তবে ব্যতিক্রম শ্রেণি যে একেবারে অস্তিত্বহীন তা কিন্তু নয়।

সেই নগন্য সংখ্যার মানটা প্রকাশ করে ক্ষীণ আকাক্সক্ষাকে নষ্ট করতে ইচ্ছে হল না। এই সংখ্যালঘুদের সমস্যাটা আরো জটিল। এক ধরণের দোদুল্যমান অবস্থায় বিরাজ করে এরা এবং তথাকথিত সবলদের সাথে লড়াইয়ে টিকে থাকতে অপারগ হয়ে পড়ে এক সময়।

এবার প্রথম পক্ষের প্রদেয় যুক্তিটি বিশ্লেষণ করা যাক। এখানে দুটো শব্দ কিংবা বিষয়ের মধ্যে তুলনা করা হয়েছে -‘এসব’ এবং ‘পড়াশোনা’। তাদের ভাষ্যমতে, ‘এসব’ দ্বারা তারা বোঝাতে চান সংস্কৃতি চর্চা কিংবা সহশিক্ষা কার্যক্রম। অর্থাৎ সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি কিংবা বিতর্ক চর্চা। আর ‘পড়াশোনা’ দ্বারা বাঝাতে চান কমপক্ষে একশো দুশো পাতার দশ থেকে বারোটা বই একবার....দুবার....তিনবার পড়া। তা থেকে কমপক্ষে দেড়শো পাতা মস্তিষ্কে প্রোগ্রাম কোডের মত ধারণ করা এবং সবশেষে পরীক্ষার খাতায় পরীক্ষকের বোধগম্য ভাষায় লেখা। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের কাছে এই শব্দ দুটো অত্যন্ত সহজাতভাবে পৃথক করে উপস্থাপন করা হয়েছে। কাজেই আমরা যারা এ প্রজন্মের মানুষ, আমাদের কাছে এ শব্দ দুটোর রয়েছে পৃথক সত্তা।

রাতারাতি আমরা এদের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটেই বিশ্বাসী। এদের মধ্যে যে সমান্তরাল সম্পর্ক বিরাজ করতে পারে তা যেন আমাদের কল্পনাতীত। কিন্তু ভিডিও দেখে যতটা অনুধাবন করা যায় তা থেকে এটি স্পষ্ট যে রেবেকা শফিরা আমাদের মত ‘পড়াশোনা’, ‘সংস্কৃতি চর্চা’ এর মাঝে পার্থক্য খুঁজে বেড়াননি। এসব পার্থক্য, তুলনা, সংজ্ঞা ঘেঁটে কালক্ষেপণ করেননি। তাঁদের কাছে এক এবং একমাত্র শব্দ ছিল পড়াশোনা। অর্থাৎ ‘পড়া’ এবং ‘শোনা’। যা কিছু অজানা, যা কিছু সুন্দর তার প্রতি মানুষের অনুসন্ধিৎসু মন সহজাতভাবেই আগ্রহী।

আবার সকলের আগ্রহের বিষয় যে এক হবে এমনটা নয়। এক্ষেত্রেও স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান। যদি কারো বিতর্ক শুনতে ভালো লাগে তবে তার বিতর্কের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক। তার কৌতূহল নিবৃত্তির জন্যই সে বিতর্ক শিখতে শুরু করবে; কারো কথায়, পরামর্শে কিংবা অনুকরণে নয়। যখনই সে বিতর্ক শেখা শুরু করল, তখন থেকে বিতর্ক আর তার পড়ার বাইরের কোনো বিষয় রইল না। তখন একজন শিক্ষার্থীর কাজ হলো এই শেখার বিষয়গুলোকে পরস্পর সংযুক্ত করা। এখানে যে যত বেশি কৌশলী সে তত বেশি সৃজনশীল। অর্থাৎ বিতর্ক, সংগীত, কবিতা কিংবা পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুকে সংযোগ করার দক্ষতা অর্জন।

আবারও হোঁচটের প্রসঙ্গে যেতে হচ্ছে। রেবেকা কিংবা এ প্রজন্মের তরুনদের অনায়াসে নেশাগ্রস্ত বলা চলে। কিন্তু হোঁচট খাচ্ছিলাম একারণে, রেবেকা ছিলেন অজানাকে জানার নেশায় নেশাগ্রস্ত আর আমরা জিপিএ ফাইভের নেশায়। জানার নেশাই এরকম রেবেকা শফির জন্ম দেয়। আর জিপিএ ফাইভ এর নেশা জন্ম দেয় বর্তমানের তথাকথিত ভালো শিক্ষার্থীদের। যাদের কাছে সংস্কৃতি চর্চা সময় অপচয়ের সমতুল্য।

এ প্রসঙ্গে আফিমখোরদের কথা না বললেই নয়। আফিমের ঝিমঝিম ভাব ভালো লাগে বলেই কিন্তু একসময় তা আমাদের নেশায় পরিণত হয়। আজ যে শিশুকে আমি আপনি বিদেশি ভাষার গান শুনিয়ে খাওয়াচ্ছি, সেই শিশুর কি করে আজ থেকে দশ বছর পর  রবীন্দ্র, নজরুলে নেশা ধরবে। এক ঘণ্টার বিতর্কের অনুষ্ঠানের থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধারাবাহিকে তার নেশা ধরবে এটাই তো স্বাভাবিক।
ফিরে যাই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সেই আহ্বানে- ‘শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চা’। একবার বুকে হাত রেখে বলুন আজকের সংস্কৃতি চর্চাকে কি প্রকৃত অর্থে শুদ্ধ বলা চলে! শিক্ষানবিশ সংস্কৃতি চর্চায় কি সত্যিই আত্মপ্রচারের অসুস্থ প্রতিযোগিতার স্থান হওয়ার কথা? যেখানে প্রতিনিয়ত চলে নিজেকে জাহির করার অসুস্থ; ক্ষেত্রবিশেষে হাস্যকর প্রয়াস। সেই সংস্কৃতির পবিত্রতার বিষয়ে সংশয় থাকাটা তো অস্বাভাবিক নয়।

যেখানে আবৃত্তির বিচারের ক্ষেত্রে বিচারক আবৃত্তি নয়; প্রতিযোগীর ধর্মকে মানদ- হিসেবে গ্রহণ করেন সেই সংস্কৃতি চর্চা কি করে প্রগতিশীল তারুণ্যের জন্ম দেবে! স্বাভাবিক ভাবেই এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম বিরাজমান। কিন্তু সেই আদর্শকে ধারণ করার প্রয়াসই বা কজনের রয়েছে। সব ক্ষেত্রে সহজ রাস্তা খোঁজার মানসিকতা এখন আমাদের অস্থি মজ্জায় প্রোথিত। শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার পথটা সহজ নয় বলেই সে পথে হাঁটতে সকলে সাহস করেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেকে উপস্থাপনের মাধ্যমে খুব সহজে সংস্কৃতিকর্মী বনে যাওয়া যায়। কিন্তু শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চা হয়তো এমন রাতারাতি সম্ভব নয়।
শিক্ষা এবং সংস্কৃতি পরস্পরের বিকল্প নয় বরং পরিপূরক। তবে সে শিক্ষা হোক অজানাকে জানা এবং সে সংস্কৃতি হোক প্রকৃত অর্থে শুদ্ধ। শুদ্ধ ও পরিশীলিত হোক জীবনবোধ।

লেখক: শামরী রহমান, অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী