তমাল কাণ্ড, মেয়রের কাঁধে ভর দিয়ে পূজা পরিষদে হুংকার

করোনার সময় এক মৃতব্যক্তির শেষ কৃত্যে বাঁধা দিয়ে সমালোচিত শ্মশান রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক তমাল মালাকার এবার জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সম্মেলনে মারধর করতে উদ্যত হয়ে আলোচায় এসেছেন। এবার অবশ্যই তিনি বরিশাল সিটি মেয়র সেরনিয়াবত সাদিক আবদুল্লাহর নাম ব্যবহার করে হুংকার দিয়েছেন। মেয়রের নাম ভাঙিয়ে পরিষদের গঠনতন্ত্রের প্রয়োজন নেই বলেও হুংকার দেন। তমাল মালাকারের ইচ্ছেমাফিক কমিটি ঘোষণার দাবি জানালে সেখানে হট্টোগোল লেগে যায়।
এদিকে সিটি মেয়রের নাম ব্যবহার করে উশৃঙ্খল আচরণ করায় মেয়রের ঘনিষ্ঠজন পূজা পরিষদের একাধিক নেতা দাবি করেছেন মেয়রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্যই তমাল মালাকার এমন নআচরণ করেছে। বাস্তবে মেয়র পূজা পরিষদের সকল কর্মকা-ে সহযোগী। কখনো তিনি পূজা পরিষদের কমিটি নিয়ে কথা বলেননি। বরিশাল মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভায় নির্বাচনী কমিটি গঠন নিয়ে এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য তারা ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। সংরক্ষিত কাউন্সিলর গায়ত্রী সরকার পাখিও তমাল মালাকারের কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কথা বলেন। তমাল মালাকারের হুংকারের সঙ্গে সংরক্ষিত কাউন্সিলর পাখির ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
আরো পড়ুন- শ্মশান রক্ষা কমিটির নেতা তমাল মালাকারের কাণ্ড
গত মঙ্গলবার দুপুরে বরিশাল নগরীর আর্যলক্ষ্মী ভবনের সভাকক্ষে মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদ আয়োজিত সভায় ওই কা- ঘটান তমাল মালাকার ও গায়ত্রী সরকার পাখি। ওই দুই ব্যক্তির হুংকার হট্টোগোলের মধ্য দিয়ে শেষ হয় সভা।
গভায় থাকা সদস্যরা জানান, মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদেও সভাপতি নারায়ণ চন্দ্র দে নারুর সভাপতিত্বে সভায় শুরুতে সাধারণ সম্পাদক সুরঞ্জিৎ দত্ত লিটু বার্ষিক আয় ব্যয়ের হিসাব পেশ করেন। হিসাব পেশ শেষে এক পর্যায়ে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নতুন কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে নির্বাচনী কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয় কার্যনির্বাহী পরিষদ। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সহসভাপতি বৃন্দ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকবৃন্দ, সাংগঠনিক ও অর্থ সম্পাদকসহ আরো বেশ কিছু পদধারী নেতারা নির্বাচনী পরিষদের সদস্য হওয়া কথা। গঠনতন্ত্রের এই নিয়ামাবলী ঘোষণা দেবার সময় তমাল মালাকার হট্টগোল শুরু করেন।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচনী কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদে সভাপতি পদ প্রত্যাশী ও বরিশাল মহাশ্মশান রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক তমাল মালাকার এবং মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী সিটি কর্পোরেশনের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গায়েত্রী সরকার পাখি চড়াও হয়ে ওঠেন কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের উপর। সভায় তমাল ও গায়েত্রী দাবী করেন, ‘গঠনতন্ত্র দিয়ে সব কিছু হয় না। পূজা পরিষদের কমিটি গঠনে গঠনতন্ত্রের এখন আর দরকার পরবে না। মেয়র মহোদয় (সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ) যে সভায় থাকেন, সেখানে তার সম্মতিই সব। সংগঠনের গঠনতন্ত্র লাগে না। কোন ভাবেই নির্বাচনী/সাবজেক্ট কমিটি গঠন করে পূজা পরিষদের কমিটি করতে দেয়া হবে না’।
সভায় অংশগ্রহণকারীরা জানান, তমাল ও গায়েত্রীর দাবি ছিলো, সম্মেলনের দিন যাদের পক্ষে বেশি লোক দাঁড়িয়ে হাত তুলবেন তারাই সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হবেন। তবে এই দাবি অযৌক্তিক জানিয়ে সভার অন্য সদস্যরা প্রতিবাদ করেন।
এসময় বিশ্বজিৎ ঘোষ বিশু বলেন, সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটি গঠন করতে হবে। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে বিশুকে মারতে তেড়ে যান তমাল মালাকার। তবে সিনিয়র সদস্যরা দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। তমাল ও পাখির দাবি অযৌক্ত জানিয়ে প্রতিবাদ করেন এ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র দাস, নিতাই সাহা, শোভন দাসসহ আরো অনেকে।
আরো পড়ুন- শ্মশান রক্ষা কমিটির নেতা তমাল মালাকারের কাণ্ড
সভায় তমাল ও গায়েত্রী দাবি করেন, মেয়র তাদের নির্দেশ দিয়েছেন তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী কমিটি গঠন করতে হবে। পাল্টা জবাবে বিশ্বজিৎ ঘোষ বিশু বলেন, তার সাথেও মেয়রের কথা হয়েছে। মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ বলেছেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটি করতে। তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে। এরপরেই তমাল মালাকার ক্ষিপ্ত হয়ে বিশ্বজিৎ ঘোষ বিশুকে মারতে উদ্যত হন এবং হুমকি দেন।
এই ঘটনায় বরিশাল মহানগর ও জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের নেতাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করেছে গোটা হিন্দু ধর্মালম্বীদের মাঝে। অনেক নেতারাই জানান, পূজা পরিষদের কমিটি গঠনে কখনই রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ হয়নি। এবারও কেউ হস্তক্ষেপ করছে না। সিটি মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ সব সময়ই গণতন্ত্রের পক্ষে। সনাতন ধর্মালম্বীদের সুখে দুখে সিটি মেয়র পাশে থাকেন। অথচ মেয়র সাদিকের নামি ভাঙিয়ে একটি চক্র মেয়রকে বিব্রত করতে বিভিন্ন সংগঠনে এমন বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করছেন।
পূজা পরিষদের আইন বিষয়ক সম্পাদক এ্যাড সুভাষ চন্দ্র দাস নিতাই জানান, ধর্মীয় সংগঠন একটা অনুভুতির জায়গা। এটি কোন রাজনৈতিক সংগঠন নয়। চর দখল করার মতও নয় এসব সামাজিক ধর্মীয় সংগঠনগুলো। নেতৃত্ব পেতে কেউ যদি অগঠনতান্ত্রিক অযৌক্তিক কিছু করে সেটা মেনে নেওয়া যায় না।
এই বিষয়ে জানতে বরিশাল মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুরঞ্জিৎ দত্ত লিটু হট্টগোলের বিষয়টি স্বীকার করে জানান, আমার জানা মতে সিটি মেয়র সেরনিয়াবত সাদিক আবদুল্লাহ পূজা পরিষদের কমিটি নিয়ে কখনো কোন মন্তব্য করেননি। তার নাম ব্যবহার করায় আমরা বিব্রত হয়েছি।
পূজা পরিষদের মহানগরের সভাপতি নারায়ণ চন্দ্র দে নারু জানান, সব সংগঠনেই একটা গঠনতন্ত্র থাকে, পূজা পরিষদেও আছে। সভার সিদ্ধান্ত এবং গঠনতন্ত্র অনুয়ায়ীই তার পরিষদ নতুন কমিটি উপহার দিয়ে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে চান।
ঘটনার বিষয়ে তমাল মালাকার দাবী করেন, তার বিরুদ্ধে মিথ্যা রটানো হচ্ছে। তিনি কোথাও মেয়রের নাম ভাঙান না। তমালকে বরিশালের মানুষ এমনিতেই চেনে। মেয়রের নাম ভাঙানোর প্রশ্নই ওঠে না বলে তার দাবি তার।
সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গায়েত্রী সরকার পাখিকে বুধবার দুপরে দাবি করেন, অভিযোগটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে। আমরা চাই এটা মেয়র মহোদয় দেখবে। তার হস্তক্ষেপেই মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের কমিটি হবে।
আরো পড়ুন- শ্মশান রক্ষা কমিটির নেতা তমাল মালাকারের কাণ্ড
উল্লেখ্য, গতবছর করোনা মাহামারীর মধ্যে এক নরসুন্দরের মরদেহ বরিশাল মহাশ্মশানে ঢুকতেই দেয়নি তমাল মালাকার। ঘন্টার পর ঘন্টা মরদেহ শ্মশানের গেটে বৃষ্টিতে ভিজেছিলো। এনিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। বৃষ্টির মধ্যেও লাশ নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করার ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পরার পর তৎকালীন বরিশালেরও জেলা প্রশাসক বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে তার হস্তক্ষেপে ও সহযোগিতায় মরদেহ শ্মশানে সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়।