ত্রাণের সঙ্গে লকডাউনের বৈপরিত্য

ত্রাণের সঙ্গে লকডাউনের বৈপরিত্য

করোনা বৈশ্বিক সমস্যা। গোটা দুনিয়ায় মহামারী আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশেও করোনা এক দুর্যোগের নাম। দিন দিন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। প্রায় এক মাস আগে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে গেছে। সরকার এবং স্বাস্থ্য বিভাগ নাগরিকদের সচেতন করতে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করছে। যা অব্যাহত আছে। কিন্তু আমরা এই মহামারীর ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হতে পারছি না। মানুষকে যতো ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে ততোই রাস্তাঘাট, হাট-বাজারে বাড়ছে ভীড়। লকডাউন দিয়েও মানুষ ঘরে রাখা যাচ্ছে না। লকডাউনের অভিযোগে কর্মহীন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে সবার ত্রাণ পাওয়া-না পাওয়ার ক্ষেদ বাড়ছে। লকডাউন, ত্রাণ আর করোনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রতিযোগিতাও।

একদিকে কর্মহীন মানুষের আহাজারী আর একদিকে রমজানের সিয়াম সাধন। কে কার সিয়াম সাধন করবে বোঝা যাচ্ছে না। সব বন্ধ। সমস্যা হচ্ছে রোজাদার কোভিড যোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষের। সামনে ঈদ। ব্যবসায়ীরাও হাসফাঁস করছে। কখন একটু শিথিল হবে লকডাউন। ইফতার পাওয়া না পাওয়া এবং রমজানের কারণে সরকার লকডাউন কিছুটা শিথিল করার ঘোষণা দিয়েছে। ব্যাস। এখন তো পোয়াবারো। কে থাকে ঘরে। নানা অজুহাতে দিনের বেলা চলে বাজারের মিছিল। করোনাকে এরা পাত্তাই দিতে চাইছে না। তার সঙ্গে আবার ধর্মান্ধ মানুষের ফতোয়ায় ইতিবাচক পথ নেতিবাচক দিকে হাঁটছে। আমরা চাইনা, করোনা আমাদের এমন অবস্থায় না ফেলে। পথে-প্রান্তরে লাশের মিছিল দেখতে না হয়। এখনও সময় আছে আমাদের আরো একটু সতর্ক হওয়ার।

করোনার কারণে নানা পেশার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তারমধ্যে কোন কোন প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের কর্মী আর কাজে যোগ দিতে পারবে কি না সন্দেহ। এমন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যারা সরকারের এমপিওভুক্ত নয়, কেবল শিক্ষার্থীদের বেতনে চলে। সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের অবস্থা ব্যাখ্যা করা কঠিন। তাদের বেতন যেমন বন্ধ আছে তেমনি কারো কাছে বলতেও পারছে না। তাই কাজের সন্ধানে বাইরে যাবার এক ধরণের তাড়না তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ আবার এরই মধ্যে ত্রাণের জন্য নানা কায়দায় ধরনা দিচ্ছেন। করোনায় আক্রান্তের ভয়ের চেয়েও তাদের কাছে মনে হচ্ছে যে কয়দিন আছি, সেকদিন অন্তত খেতে হবে। তাই এক ধরণের অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা চলছে।

এখন মানুষের দাবি কাজ ও খাবারের নিশ্চয়তা। লকডাউন মানাতে হলে ঘরে ঘরে খাবারের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সরকার নানা কায়দায় খাদ্য সামগ্রি পৌঁছে দেবার সর্বাত্মক চেষ্টা করার পরও এমন দাবি কেন? করোনা মোকাবেলায় সরকারের জরুরী খাদ্য সহায়তার সঙ্গে জেলেদের জন্য চাল বরাদ্দ অব্যাহত আছে। দেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা কেজি দরে চাল। এর সঙ্গে নতুন করে রেশনিং ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী ছাড়াও নানা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান খাদ্য সহায়তা নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। তারপরও ত্রাণের চাহিদা কমছে না। অনেকে বলেন আমাদের মানুষের চাহিদা কোন কিছু দিয়ে মেটানো সম্ভব হবে না। হয়তো এটা সত্যও হতে পারে। কিন্তু সর্বোতভাবে সত্য নাও হতে পারে।

একটু বিশ্লেষণ করা দরকার। আমাদের দেশের জনসংখ্যা কত? এর মধ্যে সরকারি চাকুরী কিংবা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন কত ভাগ? বেকার কত ভাগ? দরিদ্র কত ভাগ? আর খাদ্য সহায়তা কিংবা ত্রাণ দেওয়া সম্ভব হবে কতভাগ মানুষকে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে দেশের ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মানুষ আর্থিক এবং খাদ্য সংকটের মধ্যে আছে। সেই হিসেবে মাত্র সাড়ে ৫ কোটি মানুষের খাদ্য ও আর্থিক নিশ্চয়তা আছে। বাকি সাড়ে ১৩ কোটি মানুষের কম-বেশি খাদ্য, কাজ ও আর্থিক সংকট আছে। যদি তা ও না হয় মোট জনসংখ্যার অর্ধেক হলেও ৯ কোটি মানুষের খাদ্য সহায়তা একান্ত দরকার। এখন পর্যন্ত কি এত সংখ্যক মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে? যদি ধরে নেই হয়েছে। তাহলেও তো একবার দেওয়া হয়েছে। একবার পাওয়া ত্রাণে একটি পরিবারের কতদিন চলবে সেটাও ভাবতে হবে। তাই ত্রাণের সঙ্গে লকডাউনের এতটা বৈপরিত্য দেখা দিচ্ছে।

এই বাস্তবতার পরও বলতে হচ্ছে করোনা যেভাবে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে মহামারী হতে খুব একটা বাকি নেই। তাই আমাদের সাময়িক খাদ্য কষ্টকে স্বীকার করেও লকডাউন মেনে চলা জরুরী। জরুরী স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। এক্ষেত্রে লকডাউন মানতে অবশ্য অবশ্যই কঠোরও হওয়া দরকার। ঈদের আগে লকডাউন শিথিল করে নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল বসালাম কি না জানি না। তাই সরকারের ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের সতর্ক ও সচেতন থাকার কোন বিকল্প নাই।