দুর্গাপূজা শুধু সনাতন ধর্মের অংশ নয়, এই বাণী যেন সত্য হয়

দুর্গাপূজা শুধু সনাতন ধর্মের অংশ নয়, এই বাণী যেন সত্য হয়

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘অশুভ শক্তির বিনাশ এবং সত্য ও সুন্দরের আরাধনা শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য। দুর্গাপূজা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসবই নয়, এটি আজ পুরো মানব জাতির কল্যাণে সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।’ শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী সকল নাগরিককে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে শেখ হাসিনা বাণীতে এমন মন্তব্য করেছেন। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই বাণীর সত্যতা দেখতে চাই। তাঁর এই বাণী যেন সত্য হয়। এই বাণীকে ধারণ করে যেন আমরা সামনে যেতে পারি। তাহলেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ সত্যিকার সোনার বাংলায় রূপ নেবে।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর দেওয়া বাণীতে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের নিরাপদ আবাসভূমি। আমার প্রত্যাশা, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- এ মন্ত্রে উজ্জীবীত হয়ে আমরা সবাই একসাথে উৎসব পালন করব।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘সকলে মিলে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। তাই এই দেশ আমাদের সকলের। আমাদের সংবিধানে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সমান অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। আমি আশা করি, বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলবো।’ আমরা প্রধানমন্ত্রীর এই বাণীর প্রতি বিশ^াস এবং আস্থা রাখতে চাই।

কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার উচ্চারিত বাণী ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ সেটা তো অনেকাংশে সবার হয়ে উঠতে পারছে না। আপনাকে বাদ দিলে আপনার দলের অনেক নেতা ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এবং ‘ধর্ম যার যার, রাস্ট্র সবার’ এই বাণী রাজনীতির মঞ্চে বলেই দয়িত্ব শেষ করেন। এর বাইরে সরকারি অনেক আমলাদের মুখেও এই বাণী ঘুরেফিরে শোনা যায়। কিন্তু আমরা কি সব ধর্মের মানুষ মিলে উৎসব পালন করতে পারছি?

শিশু থেকে বড় হতে হতে শিখেছি নিজের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রাখো। একই সঙ্গে অন্যের ধর্মকে ঘৃণা করো না। ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠো। কিন্তু কোন ধর্মকে খাটো করে নয়। তুমি তোমার ধর্ম পালন করো। অন্যকে তার ধর্ম পালন করতে দাও। বড় হয়ে শিখেছি বাংলাদেশ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে সব ধর্মের মানুষ একজন অন্যজনের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্নার সঙ্গী। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের উৎসব-পার্বনে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকবে। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু ঘটনা আমাদের দীর্ঘদিনের চেনা পরিচিত রূপে কালো তিলক দিয়ে ঢেকে দিতে চায়। সেটা কখনো সাম্প্রদায়িক উস্কানী, ধর্মে ধর্মে বিভেদ সৃষ্টিসহ নানা উদ্যোগ। বাংলাদেশের মানুষ সেগুলো মোকাবেলা করে আবারো সম্প্রীতি অটুট রাখতে চেষ্টা করে চলে। তারপরও কখনো কখনো সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রণালয় এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মকা-ে সম্প্রীতির বাংলাদেশ বিব্রতবোধ করে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের ধর্মীয়ভাবে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। এর একটি হচ্ছে নির্বাচন কমিশন, অন্য দুটির দায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। এই তিনটি কর্মসূচিই হতে যাচ্ছে হিন্দু ধর্মের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজার মধ্যে। যার একটি মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষর সময়সূচি অনুযায়ী ষষ্ঠীর দিন এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় (বুয়েট)-এর পরীক্ষা সপ্তমীর দিনে। অন্যদিকে রংপুর উপ-নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। 

যারা এই সময়সূচি নির্ধারণ করছেন তারা ধর্মীয় উৎসব সম্পর্কে জানেন না এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। নিঃসন্দেহে তারা বাংলাদেশের ক্যালে-ার দেখেই সময়সূচি করেছেন। কিন্তু তারা ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে পারেননি। তাই তারা দ্বিতীয় বৃহত্তম একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসবের মধ্যে পরীক্ষা রেখেছেন। রেখেছেন সংসদ নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি। দয়িত্বশীল মন্ত্রণালয় এবং নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে এমন দায়িত্বহীন কর্মকা- আশা করি না। তাহলে কেন এমন হলো? এর জবাব কে দেবে? তারপরও আমরা চাই আমাদের সম্প্রীতি বজায় থাকুক। এই সমস্যার সমাধান হোক। এই সমস্যা সমাধান না হলে আমাদের অনেক অর্জন ম্লান করে দেবে।

বাংলাদেশে প্রায়শই একটা শ্লোগান জোরেসোরে বলতে শোনা যায়, সেটা হচ্ছে ‘ধর্ম যার যার, রাস্ট্র সবার’ আবার ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী আমলারা কথাগুলো বেশি বেশি বলেন। বাস্তবের সঙ্গে এই কথার মিল খুঁজে পাওয়া অনেক সময়ই কষ্টকর হয়ে পড়ে। অনেক সময় মনে হয় লোক দেখানো বুলি আওরান কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা। কারণ সব ধর্মের উৎসব সবার জন্য হয়ে ওঠে না। এক ধর্মের উৎসবকে অন্য ধর্মের অনুসারীরা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয় না, নিতে পারে না। তাই উৎসবও সব ধর্মের মানুষের হয়ে ওঠে না। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয়। সব ধর্মের কিছু মানুষ আছে যারা ধর্মীয় উৎসবকে সার্বজনীন রূপ দিতে চেষ্টা করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ে না।

দুর্গা পূজার মধ্যে দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুটি ভর্তি পরীক্ষা এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ সেটা কি না বুঝে করেছেন? আমাদের কাছে কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। জেনে বুঝেই করেছেন বলে মনে হচ্ছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলে আমরা যে গর্ব করি, সেই গর্বের মুখে কালির আচড় ফেলা হলো কি না সেটা ভেবে দেখা দরকার। ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার কিংবা ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এই শ্লোগান দেওয়ার মুখ কি আমাদের থাকবে? গুরুত্বপূর্ণ দুটি ভর্তি পরীক্ষা এবং একটি উপনির্বাচন এক সপ্তাহ আগে কিংবা পুজার এক সপ্তাহ পরে নিলে কি খুব সমস্যা হতো? যারা এই ক্ষুদ্র চিন্তা না করে স্থূল চিন্তা থেকে পরীক্ষার সুচি নির্ধারণ করেছেন তাদের থেকেও আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার।

তারপরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাণী ‘অশুভ শক্তির বিনাশ এবং সত্য ও সুন্দরের আরাধনা শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য। দুর্গাপূজা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসবই নয়, এটি আজ পুরো মানব জাতির কল্যাণে সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হোক। প্রধানমন্ত্রীর মতো আমরাও সেই প্রত্যাশা করছি।