দুর্যোগ ঝুঁকিতে চরাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা

দুর্যোগ ঝুঁকিতে চরাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে প্রতি বছর অতিবৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙন ও খরা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটছে। আইলা, সিডরের মতো ঘূর্ণিঝড় ঘনঘন আঘাত হানছে বাংলাদেশের উপকূলে। এতে করে বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে চর অঞ্চলের দরিদ্র পরিবার এবং পরিবারের শিশুরা। দুর্যোগের চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের পিরোজপুর, ভোলা, ঝালকাটি, বরগুনা ও পটুয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলগুলো। এইসব জেলার নদী তীরবর্তী ও চরাগুলোতে দুর্যোগ প্রতিনিয়তই আঘাত হানে। সরেজমিনে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার দুর্যোগপ্রবণ এলাকা ‘মাঝের চর’-এ গিয়ে এখানকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র দেখা যায়। মাঝের চরে বসবাসরত ১০ বছরের শিশু রফিক বলে- ‘বর্ষার সময় চার দিকে হাটু সমান পানি থাকে, বেশি ঝড় হইলে তো ঘরের মধ্যেও পানি চইলা আসে। তহন পানির মধ্যেই ঘরবন্দি থাকতে হয়। ওই সময় ঘর থেকে বের হইতে পারি না। ঠিকমত খাবার পাই না, খুব কষ্টের মধ্যে দিন কাটে আমাদের। বন্যার সময় তাদের স্কুলে যাওয়ার মত অবস্থা থাকে না। তাদের একমাত্র ১৫৯ নং মাঝেরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এই চরের শিশুরা শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে।’ এই চরের স্থায়ী বাসিন্দা দুলাল হাওলাদারের সাথে কথা বলে জানা যায়, মাঝের চরের চার দিকে বলেশ^র নদী দ্বারা ঘেড়া। যার ফলে বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, ক্রমশই দ্বীপটিতে আঘাত হানে। ফলে তাদের পড়তে হয় দুর্যোগে ঝুঁকিতে। এই দুর্যোগের ভোগান্তি থেকে বাঁচতে প্রায় ২০০ পরিবার অঞ্চল থেকে অন্যত্র চলে গেছে। দুলাল হাওলাদারের ছোট দুই শিশু সন্তাকেও জীবিকার তাগিদে পারি জমাতে হয়েছে শহরে। তিনি বলেন- ‘বন্যার সময় আমরা কোন কাজকর্ম করতে পারি না। সব সময় খাবারের অভাব থাকে, তাই বাধ্য হয়েই সন্তানদের কাজে পাঠিয়েছি। অসুখ-বিসুখ হলে স্বাস্থ্য সেবা নিতে পারি না। আর আমাদের এই সমস্যা নিরসনে কেউ কোন কাজও করছে না।’ জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করেন ওয়ার্ল্ড ভিশন এর ম্যানেজার সাবিলা নূপুর। শিশুদের দুর্যোগ ঝুঁকি নিয়ে তিনি বলেন, বন্যা, খরা ও ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে শিশুরা আহত হয়। প্রতিনিয়ত প্রাণ হারায় শিশুরা। এ ছাড়া খাদ্য সংকট, আশ্রয়, পানি, চিকিৎসার অভাবসহ বিভিন্ন সংকটে পড়ে এসব শিশুরা। প্রাণঘাতি রোগ ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ডায়ারিয়া, আমাশয়, চর্মরোগ, কলেরা প্রভৃতিতে আক্রান্ত হয় তারা। এছাড়াও দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট বিশৃঙ্খল পরিবেশে মা, নবজাতক শিশুর মৃত্যু ও অসুস্থতার হার সবচেয়ে বেশি এবং দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের শিশুরা ভাষা দক্ষতা ও স্মৃতি শক্তিতে পিছিয়ে এবং অপুষ্টিতে ভোগে। বাড়িঘর, স্কুল, ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তারা শরনার্থী জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। তাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতিক সময়ে ইউনিসেফের প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধ্বংসী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয়গুলো বাংলাদেশে ১ কোটি ৯০ লাখের বেশি শিশুর জীবন ও ভবিষৎকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ইউনিসেফের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশিরা দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রশংসনীয় ক্ষমতা অর্জন করলেও দেশটির নবীনতম নাগরিকদের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপদ এড়াতে জরুরি ভিত্তিতে আরও সম্পদ ও উদ্ভাবনীমূলক কর্মসূচি প্রয়োজন। উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী আরও ৪৫ লাখ শিশু নিয়মিত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় দ্বারা আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে প্রায় ৫ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুও রয়েছে, যারা বাঁশ ও প্লাষ্টিকের দুর্বল কাঠামোয় গড়ে তোলা আশ্রয়স্থলগুলোতে বসবাস করে। ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি এডুয়ার্ড বেগবেদার বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যখন গ্রামাঞ্চলের পরিবারগুলো তাদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। তখন শিশুরা কার্যকরভাবে তাদের শৈশব হারায়। শহরে তারা বিপদ ও বঞ্চনার সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি শোষণ ও নিগ্রহের শিকার হয়। এসব ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তারা বাইরে কাজে যেতে চাপের মুখে পড়ে।’ দুর্যোগের এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সাবিলা নূপুর বলেন, এট সত্যি বাংলাদেশের শিশুরা দুর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে। এই দুর্যোগ ঝুঁকি থেকে শিশুদের বাঁচাতে হলে আমাদের নানা রকম কার্যকর পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। বিশেষ করে, মানুষের অপরিনামদর্শী কর্মকান্ডের ফলে প্রকৃতি ও জলবায়ুর যে পরিবর্তন ঘটছে তা প্রতিরোধ করতে হবে। যেমন, অপরিকল্পিত নদী খনন, বালু উত্তোলন, নদী তীরবর্তী গাছ পালা কাটা প্রভৃতি বন্ধ করতে হবে। এতে করে নদী ভাঙন অনেকাংশেই রোধ করা সম্ভব। পরিবেশ দূষণ রোধ করতে হবে ও কার্বনডাই অক্সাইড এর বৃদ্ধি কমাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানো সম্ভব হলে দুর্যোগের ঝুঁকি থেকে শিশুদের অনেকাংশেই রক্ষা করা সম্ভব হবে। লেখক: শিশু সাংবাদিক