গত ২৫ মে বাংলা ১১ জ্যৈষ্ঠ ছিল মানবতার কবি, প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২০তম জন্ম বার্ষিকী। ব্যাপকভাবে না হলেও কবির জন্মদিন পালন হয়েছে অনেক স্থান। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের শেষ ঠিকানা (সমাধিস্থল) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও জন্মজয়ন্তী পালন হয়েছে। আড়ম্বরপূর্ণ কিংবা আড়ম্বরহীন হলে দোষের কিছু নেই। শ্রদ্ধাবোধ থেকে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারলেই কবির জন্মদিন স্বাথক হয়। কিন্তু কবির জন্মদিন পালন করতে গিয়ে আমরা সাম্প্রদায়িক বনে যাই। এরকম স্থূল দৃষ্টি দিয়ে কবির জন্মদিন পালন করলে সেটা অবশ্যই দোষের। কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের নামে কবিকে সাম্প্রদাযিক বানানোর চেষ্টা বন্ধ হওয়া উচিত।
গত ২৬ মে ১২ জ্যৈষ্ঠ বাংলাদেশ উদীচী শিল্পগেষ্ঠী কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আনোয়ার তপনের একটি স্ট্যাটাস আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া ওই স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নামে কবি নজরুলের সমস্ত সাহিত্যকর্মকে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। পীর ফকিরের মাজার শরিফের মত আবহ সেখানে তৈরি করা হয়। যেকোন সংবেদনশীল মানুষের জন্য পরিবেশটি অস্বস্তিকর।’
তাঁর এই স্ট্যাটাসের মূল কারণ হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবির জন্মদিনে কেবল হামদ্, নাথ ও ইসলামি আলোচনার আবর্তে আটকে থাকবে কেন? যে আয়োজন নজরুলের সাহিত্যকর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সে আয়োজনের মানে কি? পূর্ণাঙ্গ নজরুলকে খণ্ডিত উপস্থাপনা কেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবি নজরুলকে নিয়ে গবেষণা করছে, তাঁর সমস্ত সাহিত্যকর্মকে নতুন প্রজন্মর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করে চলেছে। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান যদি নজরুলকে এভাবে খ-িত উপস্থাপন করে তাহলে নজরুল চর্চা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
বাস্তবে নজরুলকে নিয়ে টানাটানি আজ নতুন নয়। নজরুলের বয়স যখন ২২-২৩ বছর তখন থেকেই এই টানাটানি শুরু। ১৯২২ সালে যখন কবি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখেন তখন থেকে টানাটানির মাত্রা আরো বেড়ে যায়। এসময় কবিকে নাস্তিক আখ্যা দেওয়া হয়। এরপর কবি যখন শ্যামা সঙ্গীত লিখে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকেন, তখন তাকে হিন্দুর কবি বলে আখ্যা দেওয়া হয়। সেই দায় কিছুটা ঘুচে যায়, কবির ইসলামী গান এবং হামদ-নাথ লেখার কারণে। কিন্তু ধর্মীয় টানাটানি বন্ধ হয়নি। মুসলমানরা কেবল কবির ইসলামী গান ও হামদ-নাথের ওপর দাঁড়িয়ে কবিকে নিয়ে আলোচনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা তাঁর শ্যামা সঙ্গীতের ওপর ভর করে কবিকে সামনে নিয়ে যেতে চান। এই দুটোই চরম অপরাধ।
কবি এ দুটোর কোন একটি গোষ্ঠী কিংবা সম্প্রদায়ের নয়। কবি গোটা দুনিয়ার মানুষের জীবনবোধ ও দর্শণ নিয়ে আজন্ম লিখে গেছেন। তিনি কখনো হিন্দু-মুলমানকে পৃথকভাবে দেখেননি। তাই তিনি খিখেছেন ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান, মুসলিম তার নয়নমনি হিন্দু তাহার প্রাণ।’ কবির এই গানে আমরা মুগ্ধ হতে পারছি না। আমরা ব্যস্ত কবিকে হিন্দু-মুসলমানের দুই ধারায় ভাগ করার কাজে। তাই তো কবির লেখা কবিতার শব্দও বদল করি ধর্মীয় চিন্তা থেকে। (মহাশ্মশান পরিবর্তন করে গোরস্থান) বানিয়ে দিচ্ছি। এই কাজ করে আমরা আনন্দিত হই। কবি নজরুল যে, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সৃষ্ট গালাগালিকে গলাগলিতে রূপ দিতে চেয়েছিলেন, সেই দর্শন ও চিন্তার কথা মনে রাখছি না। এভাবে নজরুলকে খন্ডিত উপস্থাপন করলে আমাদের জাতীয় কবি সম্পর্কে আমাদের প্রজন্ম কি শিখবে।
জামশেদ আনোয়ার তপন তাঁর স্ট্যাটসে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছেন। তাঁ ওই প্রস্তাবনায় তিনি কবিকে সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকে মুক্ত করার জন্য শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে তাঁর জন্মদিনে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, ব্যক্তি ও শিল্পীদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করার কথা বলেছেন। যাতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করতে আসা কবির গুণগ্রাহী ও পথচারীরা মুগ্ধতার আবেশ নিয়ে ফিরতে পারে।
আমরা বলবো কেন কেবল শাহবাগ? গোটা দেশে কবির অসাম্প্রদয়িক চিন্তাকে নিয়ে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে পারবে না। এব্যাপারে বর্তমান সরকার সবচেয়ে বেশি ভূমিকা নিতে পারে। আমরা চাই সংস্কৃতিবান্ধব সরকার কবি নজরুলের সামগ্রিক সৃষ্টি সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগী হবেন।
কবি নজরুল তাঁর কবিতায় লিখেছেন, ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে, তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে’। বাস্তবে আমরা জেগে আছি না ঘুমিয়ে আছি সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। আমরা কি দেশ মাকে এমন কথা আর বলতে পারবো না? আমরা যদি এইভাবে সব দেখে শুনেও চোখ বন্ধ করে থাকি, তাহলে কি সত্যিকার রাত পোহাবে? আমাদের সামনের আঁধার দূর করতে হলে নজরুলকে নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের টানাটানি বন্ধ করতে হবে। নজরুল ইসলামকে তাঁর দর্শন ও চিন্তার জায়গায় রাখতে হবে। নজরুলকে সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে রাখতে হবে।