নতুন সূর্য সব দুর্যোগ দূর করে দিক

‘তাপষ নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে বৎসরের আবর্জনা...’। সব আবর্জনা ধুয়েমুছে শুভ্র-সুন্দর হোক পৃথিবী। নতুন বছরে সবাই উন্মুক্ত পরিবেশে নির্মল প্রকৃতির পরশ পাক। নববর্ষ আসে পুরাতন-জীর্ণ সব কিছুকে বিদায় দিয়ে নতুন আনন্দে। যদিও মহাদুর্যোগে সেই আনন্দ অনেকটাই ফিকে। নেই মঙ্গল আহ্বান, নেই ঢাকে কাঠির আওয়াজ, নেই বন্ধন দৃঢ় করবার রাখি, নেই বৈশাখী মেলার আয়োজন, নেই লাঠি খেলা, থৌলসহ লোকজ ঐতিহ্যের সমাহার। তারপরও বৈশাখকে স্বাগত জানাতেই হয়। ‘শুভ নববর্ষ’। নতুন বছর কতটা শুভ হবে সেটা বলা মুশকিল। তবে সকল দুর্যোগ মোকাবেলা করে অবশ্যই শুভ পথের দিশা পাবো। করোনা মহামারীর এই দুঃসময়ে বাংলা নববর্ষে এমন প্রত্যাশা ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে?
আজ বুধবার বাংলা নববর্ষ ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। ১৪ এপ্রিল ২০২১ খ্রিষ্টাব্দ। চৈত্র সংক্রান্তি পার করে একটি বছরের সূচনা হলো। এই বছরটি পেছনের আবর্জনাকে ধুয়ে মুছে দিয়ে শুভ পথের দিকে আমাদের নিয় যাবে কি না আমরা জানি না। অগ্নিস্নানে সব পাপ পুড়ে ছাই হবে কি না তাও জানি না। তবে আমরা বিশ্বাস করি সকল অশুভ ছায়া দূর করতে কোন না কোন শুভ সকালের দরকার। সেই সকাল যেন এই নববর্ষ হয়। এই নববর্ষ যেন আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যায়। আমরা যেন আলোর সকালে আলোর আহ্বান দেখতে পাই। যে আলো করোনাসহ সকল কালো, অন্ধকার, জঞ্জাল ধুয়ে-মুছে প্রকৃতিকে সুন্দর ও সতেজ করে দেবে। নুতুন বছরের এই আলো আমাদের সুন্দরভাবে বাঁচার পথ দেখাবে। আজকের বাংলা নববর্ষে আমাদের সেই প্রত্যাশাই থাকলো। গত বছরও করোনা মহামারীর মধ্যেই কেটেছে বাংলা নববর্ষ ১৪২৭ খ্রিষ্টাব্দ। একই প্রত্যাশা ছিল আমাদের। আমরা একটু সুন্দর পথের দিকে যাত্রাও শুরে করেছিলাম। হঠাৎ আবার থমকে দিয়েছে করোনা। তারপরও বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত মানুষের জয়, বিশ্বমানবতার জয় হবেই।
গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা এক চরম সংকটের মধ্য দিয়ে চলছি। আজ গেটা বিশ্ব করোনা নামের এক দুর্যোগ মেকাবেলায় ব্যস্ত। মানুষের দৈনন্দিন জীবন স্তব্ধ করে দিয়েছে করোনা। সারা পৃথিবীর সঙ্গে বাংলাদেশেও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সব আয়োজন বন্ধ করা হয়েছে। প্রকৃতির এই বৈরী প্রভাবে বিপর্যস্ত। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ আজ থমকে দাঁড়িয়ছে। বাঙালির প্রাণের উৎসব চৈত্র সংক্রান্তি, বাংলা নববর্ষ, মঙ্গল শোভাযাত্রা কিংবা বৈশাখী মেলার আয়োজন নেই কোথাও। আজ আমরা যার যার ঘরে অবস্থান করতে বাধ্য হচ্ছি। এই দুর্যোগ থেকে মুক্তির পথ খুঁঁজতেই হবে।
গতকাল ছিল বসন্তের শেষ দিন। চৈত্য সংক্রান্তি। কোকিল তার বিদায়বেলার গানে মুখরিত করেছিল প্রকৃতিকে। তাঁর কণ্ঠের পরিবর্তনের ভয় তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। টাকা এব বছর তাকে অপেক্ষা করতে হবে কুহুতানের জন্য। এই তাড়ণার মধ্যেও অবিরাম কুহুতানে প্রকৃতিকে আশ^স্ত করছিল কোকিল। কোকিলের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছিল ‘মরি হায়, চলে যায়, বসন্তের দিন চলে যায়’। তাঁর গান গওয়া থেমে যাবে সেই ভয়ে অস্থির ছিল সে। তারপরও নতুন বছরে নতুন আলোর পরশ পাওয়ার ব্যাকুলতায় তাকে শান্ত করে দেয়। তার স্বপ্ন, বছর ঘুরে আবার বসন্ত আসবে। কিন্তু আজ যে নতুন সূর্য আলো ছড়াচ্ছে সেই আলো কি কোকিলের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে? না কি কোকিলের স্বপ্নের সঙ্গে আমাদের স্বপ্নও চর্ণ হয়ে যাবে। আমরা কোকিলের মতো আশায় বুক বেঁধে থাকতে চাই। চাই, কোকিলের মতো মুক্ত কণ্ঠে বাঙালি সংস্কৃতির জয়গানে মুখরিত করতে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে লিখেছেন, ‘ফিরে চল মাটির টানা, যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে’। মাটি মানুষকে আশ্রয় দিতে আঁচল পেতে রেখেছে, আজ আমরা সেই আঁচলেও আস্থা রাখতে পারছি না। সেই আঁচল দিয়ে শরীর আচ্ছাদন করতে সাহস পাচ্ছি না। মায়ের শ্যামল আঁচলে সবুজ বৃক্ষ এবং সবুজ প্রকৃতিকে যেন অসহায় মনে হচ্ছে। এই স্নিগ্ধ, কোমল অপরূপ সবুজের হাতছানিকে স্বাগত জানাতে পারছি না। এতো সবুজ, এতো আলো, তারপরও মনে হচ্ছে অন্ধকার আমাদের গ্রাস করতে চাইছে। কোন অন্ধ গহ্বর আমাদের সমস্ত সুন্দরকে গ্রাস করতে উদ্যত হচ্ছে।
আমরা যে সময়টা অতিক্রম করছি সেটা কতটা ভয়াবহ তা বিশে^র উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়। সেসব দেশে মানুষের মৃত্যুর মিছিল আমাদেরও নির্বাক করে দিয়েছে। করোনার টিকা আবিষ্কার হয়েছে। করোনার টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। তারপরও মহামারী আমদের অক্টোপাসের মতোই আকড়ে ধরে আছে। যেন কারো কিছু করার নেই। আমাদের সব অর্জন, সব দম্ভ-অহংকার চূর্ণ করে দিয়েছে একটি ভাইরাস। মহাদুর্যোগের মধ্যেও একদল মানুষ স্বাস্থ্যখাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির বাজার বসিয়েছে। করোনা যেমন আমাদের থামিয়ে দিয়েছে, সেই সঙ্গে এই চক্র আমদের চরম শঙ্কার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। থামিয়ে দিয়েছে আমাদের চিরচেনা প্রকৃতিকে। আজ আলোর শিখা কালো হয়ে জ¦লছে মনে হয়। এসব কারণেও প্রকৃতি রুষ্ঠ হচ্ছে। থেমে গেছে আমাদের অর্থনীতির চাকা। এই অমানিশা কাটতে আমাদের জোট বাঁধতে হবে। আমরা বাঙালি একজোট বেঁধে করোনা ও দুর্নীতি মোকাবেলায় কাজ করবো। প্রকৃতিকে শান্ত করতে আমাদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রকৃতিকেও করতে হবে।
আমরা জানি না, আমাদের বৈশাখ, মেলা, পার্বন, আনন্দ আয়োজন কবে প্রাণ ফিরে পাবে। আজ যখন নতুন বছরের নতুন সূর্য আমাদের পরশ দিচ্ছে, তখন গোটা দেশ স্তব্ধ। নতুনের ছোঁয়া আমাদের অজানা আতঙ্ক থেকে মুক্তি দেবে কি না জানি না। আমরা চাই, বাংলা নতুন বছর করোনার দুর্যোগ থেকে আমাদের মুক্তি দেবে। একদিন এই অমানিশা কাটবে। অগ্নিস্নানে শুচি, সুন্দর ও নির্মল হবে এই পৃথিবী। আমরা এবারের বৈশাখকে আগামীর শান্তির আহ্বান হিসেবে দেখতে চাই। আবার আমরা প্রাণে প্রাণ মিলে এক সঙ্গে গাইতে পারবো ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো, তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা’। এই প্রত্যাশা হোক সবার।