২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর, সিলেটের এমসি কলেজ প্রাঙ্গণে খাদিজাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করে এক ছাত্রলীগ নেতা। ঘটনার পর মোবাইলে ধারণ করা একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, দূর থেকে অনেকেই ঘটনাটি দেখছিলেন এবং একপর্যায়ে তারা ছুটোছুটি শুরু করেন। আবার কেউ কেউ দূরে দাঁড়িয়ে কোপানোর দৃশ্য মোবাইলে ভিডিও করলেও আক্রান্তখাদিজাকে রক্ষায় কেউই এগিয়ে যাননি।
প্রায়তিন বছর পর একই ঘটনা দেখা গেলো বরগুনাতেও। গত বুধবার (২৬ জুন) স্ত্রীর সামনেই রিফাতকে যখন রামদা দিয়ে কোপাচ্ছিল দুর্বৃত্তরা, কোনও একজন দূর থেকে সেই দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ করেন। তবে নৃশংস ঘটনার সাক্ষী এই ভিডিওটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় বিতর্ক। প্রশ্ন উঠেছে, নাগরিকের কর্তব্য কি এ ধরনের হামলার দৃশ্য ভিডিও করা, নাকি দুর্বৃত্তদের রুখে দাঁড়ানো।
সমাজ গবেষকরা বলছেন, মানুষের বিপদে মানুষের এগিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্তব্যক্তি নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারছে, ততক্ষণ পর্যন্তসে এগিয়ে যাবে না। ফলে রাষ্ট্রকে সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, অবশ্যই ভিডিও ধারণ জরুরি। কেননা, এটি একটি ঘটনার সূত্র ধরতে ও তদন্তেসহায়ক ভূমিকা পালন করে। যে ব্যক্তি ভিডিও ধারণ করছেন, তিনি চাইলে প্রতিবাদও করতে পারেন। কিন্তু তিনি যদি সেটা করতে না চান, তবে তাকে জোর করার কোনও বিধান নেই।
পারিবারিক ও সামাজিক নৈতিকতার অভাবে মানুষ বিপদে-আপদে অন্যের পাশে দাঁড়ানো ছেড়ে দিয়েছে, উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, ‘আমরা বিচ্ছিন্ন বোধ করে সমাজ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছি। বিভিন্ন ধরনের হয়রানি এড়াতে এ ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষ হিসেবে যা করণীয়, সেটি না করে নিজেকে নিরাপদ করার কথা ভাবার প্রবণতা বেড়েছে। এজন্য আপনি কাউকে দায়ী করতে পারবেন না। রাষ্ট্র নিরাপত্তা না দিলে এ ধরনের জটিল পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণ করা কঠিন।’
আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম মনে করেন, বিষয়টি প্রতিবাদের দিক থেকে বিবেচনা করতে হবে। তিনি বলেন, ‘যিনি ভিডিওটি করেছেন, তিনি কিন্তু ওটা অন্য কোনও ইনটেনশন থেকে করেছেন, তা বলা যাবে না। তিনি দেখছেন যে, সামনে আসার অনেক বিপদ, পুলিশি ঝামেলায় পড়ার চেয়ে ভিডিও করাকেই তিনি বিচার চাওয়ার পথ মনে করেছেন। তবে নাগরিকের দায়িত্ব হচ্ছে পুলিশকে জানানো। এমনকি আইনে বলা হয়েছে, আমলযোগ্য অপরাধের ঘটনা ঘটলে নাগরিক দায়ী ব্যক্তিকে আটকে পুলিশকে খবর দিতে পারেন।’
এ ধরনের কোনও পরিস্থিতিতে যদি কেউ একজন ভিডিও করেন, তাহলে ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি বলে মনে করেন ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম। তিনি বলেন, ‘ধরুন তিনি ওপর থেকে ভিডিও করছেন, ওই সময়ে তিনি হয়তো দৌড়ে গিয়ে বাঁচাতে পারতেন না। কিন্তু তদন্তের ভালো একটি সূত্র তিনি ধারণ করলেন।’ যদি ভিডিও না পাওয়া যেত, কেবল নিউজ আকারে বরগুনার ঘটনাটি সামনে এলে, এ ধরনের প্রতিক্রিয়া হতো কিনা—সেই প্রশ্ন তুলে তিনি আরও বলেন, ‘বীভৎসতা সামনে এসেছে বলেই এখন প্রতিবাদের ঝড় উঠছে। তবে সামনে থেকে দেখলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেউ ভিডিও করুক এমনটা বলবো না। ভালো বা মন্দ দিয়ে এই পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা যাবে না। তবে সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী, আইনের দৃষ্টিতে এই ভিডিও’র এভিডেন্সিয়াল ভ্যালু নেই। কিন্তু অবশ্যই এ ধরনের ভিডিও পরিস্থিতি বুঝতে সহায়ক হয়।’
ডিএমপি’র সাইবার সিকিউরিটি টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘যদি সুযোগ থাকে তবে এসব ঘটনার ভিডিও করা জরুরি। কেননা, এতে ক্লু পাওয়া যায়, যা তদন্তেসহায়ক। ব্যক্তি তার মানবিক জায়গা থেকে প্রতিবাদ করতে পারেন। কিন্তু সেটা তিনি করবেন কিনা, তা অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।’ তিনি বলেন, ‘ঘটনা যখন ঘটছে, তখন উপস্থিত ব্যক্তির নিরাপত্তাহীনতার বোধ তাকে প্রতিবাদ করা থেকে বিরত রাখতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে রুখে দাঁড়ানো উচিত বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। কিন্তু ব্যক্তিকে রুখে দাঁড়াতেই হবে, এমন কোনও বিষয় আইনে নেই, সংবিধানেও নেই। এসবের জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল নানা ইউনিট রয়েছে, নাগরিক তাদের অবহিত করেও দায়িত্ব পালন করতে পারেন।’