নিখিল সেন, আমরা তোমারই নাম গাই...

নিখিল সেন, আমরা তোমারই নাম গাই...

নিখিল সেন। একজন আধুনিক মানুষের নাম। সংগ্রাম ও সংস্কৃতির এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। গ্রীষ্ম ঋতুর শুরুর দিকের গনগনে রোদ মাথায় নিয়ে জন্মেছেন তিনি। কিন্তু আজন্ম শান্ত এবং বসন্তে বর্ণিল উজ্জ্বল ছিলেন নিখিল সেন। আমাদের নিখিল দা। তাই চির বিদায়ও নিয়েছেন শান্ত সুন্দর বসন্ত বাতাসকে সঙ্গে নিয়ে। নিখিল দা’র চলে যাওয়ার এক বছর আমরা যারা তাঁর ছায়াতলে ছিলাম তারা সবাই নিখিল দা’র নাম গান গেয়ে চলেছি। দাদা, আজ আমরা তোমারই নাম গাই।

নিখিল দাকে কোনদিন অন্ধকার ছুঁয়ে যেতে পারেনি। অন্ধকারকে তিনি দুহাতে তাড়িয়ে আলোর পথে আমাদের আহ্বান জানিয়ে গেছেন। ৪৭-এর ধর্মের নামে দেশ বিভাগ তাঁকে ব্যথিত করেছে। ৫২’র ভাষা সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছেন নিবিড়ভাবে। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের একজন হয়ে ছিলেন। বাম ঘরানার রাজনীতির ছাত্র নিখিল সেন রাজীতিতে সক্রিয় থাকেননি বেশিদিন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একজন বাচিক শিল্পী হিসেবে অবদান রেখে গেছেন। কিন্তু সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মহিরুহ নিখিল সেন ভেতরে ভেতরে রাজনীতিই লালন করেছেন। কারণ তিনি জানতেন, রাজনীতি বিবর্জিত সংস্কৃতি যে মূল্যহীন।

নিখিল সেন অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি। যখন যেটা সঠিক ভেবেছেন সেটাই তিনি করেছেন। সংস্কৃতি এবং রাজনীতি সচেতন একজন পরিশুদ্ধ মানুষ নিখিল দা সব সম্ভাবনার দর্শন বুঝতেন। তাঁর প্রাজ্ঞ চিন্তা সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। আমাদের সংস্কৃতি ও নাটকে অবদানের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদকে ভূষিত করেছে। ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি নিখিল সেন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

আবৃত্তি, নাটক আর মানুষ গড়ার বাতিঘর নিখিল ছিলেন সেন। শিশুর মতো কোমল আর সমুদ্রের মতো বিশাল হৃদয়ের মানুষ। অকৃপণ হাতে তিনি গড়ে তুলেছেন শাণিত সোনার মানুষ। যারা দেশকে সমৃদ্ধ করতে কাজ করে চলেছেন। একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ছিল নিখিল সেনের অমিত স্বপ্ন। ধর্মে ধর্মে বিবেধ এবং হানাহানি নিখিল সেনকে ব্যথিত করে তুলতো। এর বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার থেকেছেন আমাদের নিখিল দা।

কেবল আবৃত্তি দিয়ে কাছে টেনেছেন অনেক কঠিন ও নিরেট মানুষকে। ভালোবাসা আর স্নেহ দিয়ে মুছে দিয়েছেন অনেকের দু:খ-কষ্ট। যিনি বা যারা নিখিল সেনের পরশ পেয়েছেন তিনি বা তারাই সোনার মানুষ হয়েছেন। এমন ভালোবাসার মানুষ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন কিছু বুঝে ওঠার আগেই। আমরা নিরব হয়ে দেখলাম তাঁর চলে যাওয়া। আমাদের যেন কোন কিছুই করার ছিল না। তিনি চলে গেছেন ঠিকই। কিন্তু থাকবেন আমাদের হৃদয় মাঝে আজন্ম।

নিখিল সেন যেমন সবাইকে আপন করে তিনে পারতেন, তেমনি নিখিল সেনকেও সবাই তাঁদের একজন হিসেবে গ্রহণ করেছে। তার প্রমাণ আমরা দেখেছি নিখিল দা’র শেষ যাত্রা পথে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাই হেঁটেছেন শবযাত্রায়। শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। তাঁর প্রাণের সংগঠন উদীচী এবং বরিশাল নাটক তো তাঁর সন্তানতুল্য। তাদের আয়োজন তো ছিলই। এর বাইরে বরিশালের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ স্মরণানুষ্ঠান হয়েছে বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে। বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়বাত সাদিক আবদুল্লাহ ওই স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে হাজির হয়েছেন দেশের বরেন্য রাজনীতিক এবং সংস্কৃতি অঙ্গনের ব্যক্তিত্বরা। শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবত বরিশাল প্রেসক্লাবসহ বরিশালের অনেক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান নিখিল সেন স্মরণে আলোচনা ও স্মরণানুষ্ঠান করেছে। ঢাকায় শহীদ মিনারেও একই আয়োজন হয়েছে।

আলোর কারিগর নিখিল সেন ১৯৩১ সালের ১৬ এপ্রিল বরিশালের কলশ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বরিশাল থেকে মাধ্যমিক পাস করে উচ্চ শিক্ষার জন্য কোলকাতা সিটি কলেজে ভর্তি হন তিনি। সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে আবার বরিশালেই ফিরে আসেন। 

বরিশালে ফিরে আলোকিত মানুষ গড়ার কাজে আত্মেনিয়োগ করেন তিনি। যোগ দেন শিক্ষকতা পেশায়। ছাত্র জীবন থেকে আবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত নিখিল সেন আবদুল মালেক খানের কাছে আবৃত্তিতে হাতেখড়ি নেন। তার হাত ধরেই নাটকের মঞ্চে আসা। ফাঁকে তিনি বইয়ের দোকনও দিয়েছিলেন। আবৃত্তি আর নাটক পাগল নিখিল সেন পূর্ণতা পায় উদীচী আর বরিশাল নাটকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। উদীচীর সংগঠক বদিউর রহমান, মানবেন্দ্র বটব্যাল, নারায়ন সাহা এবং অনুতোষ ঘোষ নিখিল সেনকে বইয়ের দোকান থেকে নিয়ে আসেন উদীচী, বরিশাল নাটকের মঞ্চ গড়ার কাজে। মঞ্চ তো তিনি গড়েছেনই। সেটা কেবল উদীচী আর বরিশাল নাটকের নয়। বরিশালের সব সংগঠন ছাড়িয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটেছেন তিনি। সঙ্গে গড়ে তুলেছেন অপার সম্ভাবনার আলোকিত মানুষ।

বাংলাদেশে প্রথম কোন প্রাতিষ্ঠানিক আবৃত্তি চর্চার প্রতিষ্ঠান গাড়ার কারিগরদের একজন নিখিল সেন। বরিশাল নাটক পরিচালিত আাবৃত্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের তিনি ছিলেন আমৃত্যু পরিচালক। তখন থেকে নিখিল সেন-এর পুনর্বার জন্ম হয়েছে। এরপর থেকে তিনি সৃষ্টি করে চলেছেন পরিশিলিত মানুষ। তৈরি করেছেন বাচিক শিল্পী। তৈরি করেছেন অভিনেতা-অভিনেত্রী। যারা আজ বরিশালসহ বাংলাদেশের গন্ডি ছাড়িয়ে প্রবাসেও অবদান রাখছেন।

আলোর কারিগর নিখিল সেন কেবল উদীচী আর বরিশাল নাটককেই লালন করেননি। তাঁর প্রজ্ঞা, মেধা আর যোগ্যতা দিয়ে গোটা বরিশালকে জয় করেছেন। সাংস্কৃতিক সংগঠন ছাড়াও বরিশালের সব সংগঠনের আপনজন হয়ে ছিলেন নিখিল সেন। সব কিছু ছাড়িয়ে একুশে পদক পাওয়ার পর তিনি গোটা জাতির শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে আজো আমাদের মাঝে আছেন এবং থাকবেন।

নিখিল সেন, আমদের নিখিল দা কেবল বরিশালের সম্পদ নয়। হাসি মাখা মুখচ্ছবি হয়ে নিখিল সেন আছে ও থাকবে সবার অন্তরে। জীবীত নিখিল সেন আমদের হাঁটতে শিখিয়েছেন। আজ অমৃতের সন্তান নিখিল সেন আমাদের সামনে চলার শক্তি যোগাচ্ছেন। তাই তাঁর চলে যাওয়াকে আমরা আর চলে যাওয়া বলতে চাই না। তিনি ছিলেন এবং আজো আমাদের মাঝে আছেন অনুপ্রেরণা হয়ে। নিখিল দা আছেন এবং থাকবেন আমাদের স্বত্বায়, আত্মায় ও কর্মে। তাই আমরা বলতে চাই, ‘আমরা তোমারই নাম গাই’।