নিখিল সেনকে স্মরণের দিন, জ্বালাও আলো, আপন আলো, সবার প্রাণে

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কে লইবে মোর কার্য কহে সন্ধ্যা রবি, শুনিয়া জগত রহে রিুত্তাপ ছবি, মাটির প্রদীপ ছিল সে কহিল স্বামী, আমার যেটুকু সাধ্য তা করিব আমি।’ অস্তগামী সূর্যের নীরেট আকুতিই এই লাইন কটির মধ্যে ফুটে উাঠেছে। যে সূর্য পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করে, দিন শেষে তাকেও বিদায় জানাতে হয়। তার অস্তাচলের পর অন্ধকার দূর করবে কে? তাই কবি সূর্যকে উদ্বৃত করে লাইন কটি লিখেছেন।
প্রদীপ শিখা অন্ধকার দূর করে আলোর দিশা দেখায়। একটি প্রদীপ শিখা অন্ধকারকে তাঁর আলোর রোশনাইয়ের দিকে আহ্বান জানায়। বলে, জ¦ালাও আলো, আপন আলো, উজ্জ্বল আলোর আভায় বদলে দাও। এমন প্রদীপশিখা জ¦ালাতে যারা সহযোগিতা দেয় তারা হলেন আলোর কারিগর। বদলের কারিগর। এমন এক বদলের কারিগরের নাম নিখিল সেন। আমাদের নিখিল দা। যার আলোকচ্ছটায় আলোকিত আমরা। আলোকিত এই মানুষটির বিচরণ ছিল শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতিসহ সর্বত্র। তাঁর কণ্ঠ দিয়ে মুগ্ধ করেছেন বরিশালসহ বাংলাদেশকে। আবৃত্তি, নাটক, যন্ত্রসঙ্গীতে পরঙ্গম বিজ্ঞানমনষ্ক নিরেট ভালো মানুষ নিখিল সেন। আলোকিত এই মানুষটি চলে যাওয়ায় অন্ধকার নামে আমাদের মনজগতে। যেমনটা দিবাকর অস্তাচলে গেলে ঘটে। তারপরও তাঁর আলোর যে রোশনাই রেখে গেছেন, সেই আলোতে আমরা আলোকিত হচ্ছি। তাই বলি, জ্বালাও আলো, আপন আলো, সবার প্রাণে। নিখিল সেনের শরীরী উপস্থিতি না থাকলেও তিনি সবার প্রাণে আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা করে গেছেন।
২০১৮ সালের ২৫ ফ্রেব্রুয়ারি এই দিনে তিনি তাঁর প্রদীপের আলো ছড়ানো বন্ধ করে দিয়ে নিরুদ্দেশে যাত্রা করেছেন। আজ আমরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তাঁর প্রাণের সংগঠন উদীচী এবং বরিশাল নাটকের কর্মীরা তাঁর রেখে যাওয়া প্রদীপ জ্বালিয়ে তাঁকে স্মরণ করছে।
আজন্ম একজন রাজনীতি সচেতন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বর নাম নিখিল সেন। একজন আধুনিক মানুষের নাম নিখিল সেন। একটি প্রতিষ্ঠানের নাম নিখিল সেন। আবৃত্তি, নাটক আর মানুষ গড়ার বাতিঘর নিখিল সেন। শিশুর মতো কোমল আর সমুদ্রের মতো বিশাল হৃদয়ের মানুষ নিখিল সেন। অকৃপণ হাতে তিনি গড়ে তুলেছেন শাণিত সোনার মানুষ। যার গর্বিত অংশিজন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বরিশাল জেলা সংসদ এবং বরিশাল নাটক। রাজনীতিকে তিনি সংস্কৃতির সুন্দরপাঠ দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করে গেছেন। বলতেন, রাজনীতি বিবর্জিত সংস্কৃতি সস্তা বিনোদন ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমাদের নিখিল দা কেবল আবৃত্তি দিয়ে কাছে টেনেছেন অনেক কঠিন ও নিরেট মানুষকে। ভালোবাসা আর ¯েœহ দিয়ে মুছে দিয়েছেন অনেকের দু:খ-কষ্ট। যে, যিনি কিংবা যারাই নিখিল সেনের পরশ পেয়েছেন তিনি বা তারাই সোনার মানুষ হয়েছেন। আজ হয়তো নিখিল দার শরীরী উপস্থিতি আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তবে তাঁর উপস্থিতি আমরা প্রতিটিক্ষণে টের পাই অন্তরে। তিনি চলে গেছেন ঠিকই। কিন্তু থাকবেন আমাদের হৃদয় মাঝে আজন্ম।
আলোর কারিগর নিখিল সেন ১৯৩১ সালের ১৬ এপ্রিল বরিশালের কলশ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বরিশাল থেকে মাধ্যমিক পাস করে উচ্চ শিক্ষার জন্য কোলকাতা সিটি কলেজে ভর্তি হন তিনি। সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে আবার প্রদীপ হাতে বরিশালেই ফিরে আসেন। ছুটে যান প্রত্যন্ত গ্রামে। একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতে। রাতে প্রদীপ হাতে ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে পড়িয়েছেন। অসা¤্রদায়িক চেতনায় গড়ে তুলেছেন ছাত্রদের। আজন্ম তিনি রাজনীতি সচেতন মানুষ গড়ার কাজই করে গেছেন।
ছাত্র জীবন থেকে আবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত নিখিল সেন আবদুল মালেক খানের কাছে আবৃত্তিতে হাতেখড়ি নেন। তার হাত ধরেই নাটকের মঞ্চে আসা। ফাঁকে তিনি বইয়ের দোকনও দিয়েছিলেন। আবৃত্তি আর নাটক পাগল নিখিল সেন পূর্ণতা পায় উদীচী আর বরিশাল নাটকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। বরিশাল নাটকের মঞ্চ গড়ার কাজে নিবেদিত ছিলেন তিনি। মঞ্চ তো গড়েছেনই। সেটা কেবল উদীচী আর বরিশাল নাটকের নয়। বরিশালের সব সংগঠন ছাড়িয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটেছেন তিনি। সঙ্গে গড়ে তুলেছেন অপার সম্ভাবনার আলোকিত মানুষ।
বাংলাদেশে প্রথম কোন প্রাতিষ্ঠানিক আবৃত্তি চর্চার প্রতিষ্ঠান গাড়ার কারিগরদের একজন নিখিল সেন। বরিশাল নাটক পরিচালিত আবৃত্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের তিনি ছিলেন আমৃত্যু পরিচালক। তখন থেকে নিখিল সেন-এর পুনর্বার জন্ম হয়েছে। এরপর থেকে তিনি সৃষ্টি করে চলেছেন পরিশিলিত মানুষ। তৈরি করেছেন বাচিক শিল্পী। তৈরি করেছেন অভিনেতা-অভিনেত্রী। যারা আজ বরিশালসহ বাংলাদেশের গ-ি ছাড়িয়ে প্রবাসেও অবদান রাখছেন।
আলোর কারিগর নিখিল সেন কেবল উদীচী আর বরিশাল নাটককেই লালন করেননি। তাঁর প্রজ্ঞা, মেধা আর যোগ্যতা দিয়ে গোটা বরিশাল জয় করেছেন। নিখিল সেন আজ বরিশালসহ গোটা দেশের সম্পদ। বাংলাদেশ সরকার এই গণি ব্যক্তিকে একুশে পদকে ভূষিত করেছেন। তিনি তাঁর ¯েœহ ও ভালোবাসা দিয়ে সব সংগঠনের কর্মীদের একজন হয়ে ওঠেন। সব কিছু ছাড়িয়ে একুশে পদক পাওয়ার পর তিনি গোটা জাতির শ্রদ্ধার নিখিল সেন হয়েছেন। এবছর বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ ‘বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি উৎসব’ তাঁকে মরণোত্তর পদকে ভূষিত করেছে।
বরিশাল ছাড়িয়ে দেশের সম্পদ নিখিল সেন-এর হাসি মাখা মুখচ্ছবি হয়ে আছে ও থাকবে সবার অন্তরে। নিখিল সেন, সবার নিখিল দা ছবি হয়ে থাকবে আমাদের স্বত্বায়, আত্মায় ও কর্মে। নিখিল সেন তাঁর নিজের আলোয় আমাদের আলোকিত করে গেছেন। তাঁর অসীম আলো ছুঁয়ে যাবে সবার প্রাণে।