নেই সত্যের কেউ সাথী হায়

সত্যের কেউ সাথী নেই। এই সত্যই এখন দারুন কঠিন সত্য। আমরা স্বীকার করলেও সে সত্য আর না করলেও সে সত্যই। যদিও এ তেমন কোন বিষয়ই নয়। কি হয় সত্য না থাকলে? দেশ চলে না, মানুষ হাঁটে না, ছোটে না, নিত্য কর্মে মনোনিবেশ করে না যথাযথ? সত্য নেই তাতে কার কি আসে যায়? এই আক্ষেপে সত্য হয়তো বিলাপ করে বলে, ‘গোলাপের অলি আছে, ফাগুনের আছে বাহার, সকলের সাথী আছে, শুধু কেউ নেই আমার সাথী, কেউ নেই আমার।’
কি করে থাকবে? এখন যে জোয়ারের সাথে গা ভাসানোর সময়। জোয়ারের বিরুদ্ধে কে যায়, কেন যাবে? তার জন্যতো একধরনের জীবনী শক্তির প্রয়োজন। সে এখন আছে কার? এই যে জোয়ার যুদ্ধ, এই শব্দ যার নিজস্ব। সেতো নিজেই হারিয়ে বসে আছে তার শক্তি-সামর্থ। এমন কোন নদী আছে এখনো যে হারায়নি তার গতি প্রকৃতি। কোথায় আছে সেই জোয়ার? না এই জোয়ার শব্দের উৎপত্তি যেখানে আজ আর সেখানে সে নাই। সে এখন আভাস ছেড়ে দারুন অনুশীলনে ব্যস্ত, পানার মতো বেড়ে চলা মানব নদীতে। তাই বিপরিত শক্তীর ভাটির টান রুখে সামনে যাবার কেউ নেই। এ কারণেই এমন সত্য উপলব্ধিরও কেউ সাথী নেই।
এই যে সদ্য সমাপ্ত ফুটবল কাতার বিশ্বকাপ জ্বরে কেঁপেছি সবাই। না, সবাই নয়। কেবল এক শ্রেণি যারা ঐ মাঠে খেলবার যোগ্য নয়। যারা যেটা পারে না তারা সেটা পারবার সহজ উপায় খোঁজে। জানি এমন কথায় সমার্থক শব্দের যাতকরা ক্ষিপ্ত হবেন। মূলত সেটা আমারও হচ্ছে। তার পরেও সেইতো সত্য? আমরা অন্যের বিজয়ে যতোটা আনন্দিত হই তেমনটা নিজেদের বিজয়ে যেন হতেই পারি না। পেরেছি কি নারী সাফ ফুটবল বিজয়ের পর? তুলেছি একটিও পতাকা আকাশে, যেটা পতাকার থেকেও বড়? সাকিব আল হসান কত বড় মাপের খেলয়াড় সেকি আমরা জানি, বুঝতে পারি?
নেইমার বড় সন্দেহতো নেই। কোন সন্দেহ নেই মেসির বড়ত্তেও। রোনালদো পরাজিত হলো হয়তো, পরাজিত হয়েছে এম বাপ্পেও। কিন্তু তার কোনটাইকি আমাদের প্রত্যাশায় হবে বা হয়েছে? তারা যে এতো বড় হলো সেখানে আমাদের ভূমিকা কি? হ্যা আছে, মোটা দাগের বুদ্ধির কিছু ভূমিকাতো আছেই। দশ বন্ধু মিলে জার্সি কিনেছি বিভিন্ন দেশের। তাদের পতাকা তুলেছি আকাশে। একবারও কি নিজের কাছে জানতে চেয়েছি। আমরা মূলত: সমর্থক কার নেইমার-মেসির ফুটবল খেলার নান্দনিকতার, না কি আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল নামক দেশের?
আমাদের বিজয়ের ৫১তম বর্ষ দিনেও একমিনিটের জন্যও অবনমিত করিনি ভিনদেশীর প্রতি ভালোবাসা। আমাদের বিজয়ের একটি পতাকাও তাদের পতাকাকে অতিক্রম করতে পারেনি দেশাত্মবোধের ভালোবাসায়। সারা বাংলাদেশে কোথাও না! প্রমাণ করতে পারিনি আমরা, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা এই মুহূর্তে পৃথিবীর যে কোন পতাকার চেয়ে বড়। না পারিনি, সত্যিই পারিনি। জাতীয় পিতার জন্ম শতবর্ষ আর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তি পালনের ব্যাপকতার পরেও দেশাত্মবোধের কোন উম্মেষ ঘটেছে আমাদের, তার কোন উদাহরণ আছে? স্বীকার করতে পারি এমন সত্য? না পারি না। এমন সত্যের কেউ সাথী হবে?
আমরা জানি দেশ, জাতি, স্বাধীনতা, বিজয় ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের প্রত্যয়ে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি কর্ণার নির্মিত হয়েছে। যার নাম বঙ্গবন্ধু কর্ণার। উদ্বোধনের দিনে ভিসি, প্রিন্সিপাল, হেডমাস্টার, ডিসি, এসি, কমিশনার এরা কেউ বাদ যায়নি। সবাই উপস্থিত। উপস্থিত রাজনীতির সকল শাখা। তার পরে কি হয়েছে সেই কর্ণারে? কি হচ্ছে? কি বেশি জমেছে ধুলো নাকি মুজিব ভক্ত, কিংবা আধুসারিদের আনাগোনা, কোনটা বেশি? প্রতিদিন খোলা থাকে, থাকবে সেই কর্ণার? কে খোঁজ রাখে, কার সে দায়িত্ব অছে? এমন সত্য উচ্চারণের কেউ সাথি নেই।
বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের রণাঙ্গনের অন্যতম সাথী ভারত। আশ্রয়, রাজনীতি, খাদ্য, অস্ত্র এবং রক্ত দিয়েছে সে আমাদের মুক্তির যুদ্ধে। এমন সত্য উচ্চারণে সাথী কে আছে এখন এই দেশে। এখন বাংলাদেশ শাসনে আওয়ামী রাজনীতি মানেই দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর ধারণা হিন্দুদের দ্বারা ডমিনেটেড হচ্ছে দেশ। এমন পরিবেশ কেমন করে সৃষ্টি হলো কে বা কারা করালো? এই সত্য উন্মোচণের কেউ সাথী নেই। দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মনের মধ্যের এই ভীতির বাঘ হত্যা করে আস্থা স্থাপন অত্যন্ত জরুরী। প্রশ্ন হতে পারে বুঝবো কেমন করে? জানি না। তবে বুঝতে হবেই। যেমন বুঝতে হবে পিনাকী ভট্টাচারিয়াকে, বুঝতে হবে একজন গায়েশ্বর রায়কে দেখে। ওরা যতই গাইল পারুক আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনারে। তাতে কি আড়াল হবে ওদের ধর্ম জাত। তাই বলে ওরা দুজনই যে বিষাক্ত বিষ সেটা বুঝবো না? বুঝতে যে হবেই কারন এই দেশে বা উপমহাদেশে ধর্মের প্রভাব অতিক্রম সম্ভব নয়। ওদের ধর্ম বোঝার কি কোন পথ নাই? নিশ্চই আছে। এর একটি চমৎকার উদাহরণ আছে আমাদের একটি চলচ্চিত্রে। দুই প্রখ্যাত অভিনেতার অভিনয়ের মধ্যে, একজন রাজিব অন্যজন হুমায়ুন ফরিদি।
রাজিব বলছে ফরিদিকে ‘এই তোর তো মা বাপ কিছু নাই। তাইলে তুই বুঝলি কেমনে তুই হিন্দু? ফরিদির নির্বিকার উত্তরটা ছিল ‘নুনু দেইখ্যা।’ পিনাকী আর গয়েশ্বরের কি ধর্ম বিচার দরকার নয়? ওরা যে ভাবে আওমী লীগের বা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে বিকৃত করছেন তাতে কি একবার দারকার নয় ওদের ধর্ম বিচার? নাকি এই দুই অর্বাচিনই কেবল এই পৃথিবীতে একমাত্র সেকুলার? জানি এই সত্য উচ্চরণেরও কেউ সাথী নেই।
সত্যের যে কোন সাথী নেই সে কথা সত্যের চেয়ে বেশি কে জানে। এইতো মাত্র শহরের অশ্বিনী কুমার হলটি, সংস্কার পরবর্তী এক আনন্দঘন সন্ধায় উন্মোচিত হলো। নি:সন্দেহে এটি এই শহরের একটি ঐতিহ্যের স্মারক। মাননীয় সিটি মেয়রের সংস্কার উদ্যোগে হলটি দারুন সুন্দর হয়েছে। এই কারণে শহরবাসী যারপর নাই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন তার প্রতি। তবে এই সৌন্দর্যের সাথে আরো কিছু সঠিকতার প্রয়োজন পরবে। যা নিতান্ত কারিগরি প্রয়োগ। যার মূল দুটি হলো, আলো এবং শব্দ ব্যবস্থাপনা। আর কম করে হলেও দুইশত খানা চেয়ারের ব্যবস্থাপনা এই হলের সাথে সংযুক্তকরণ অত্যন্ত জরুরী। যেমন জরুরী ছিল এই হল অবয়রের সাথে অশ্বিনী কুমারের একটি ছবি সংযোজন। যা আপনি করতে সক্ষম হয়েছেন এর জন্য আপনাকে অভিবাদন। এখন শুধু প্রয়োজন সাধারণের জন্য হলটির উন্মোচন।
যেমন সাধারণের সামনে উন্মোচিত হবার খুব প্রয়োজন ছিল, এই হল নির্মাণকালে যারা টাকা দিয়েছিলো তাদের নাম। যার পরিমাণ ছিল ১০০, ২০০, ৩০০, ৫০০, ১০০০ পর্যন্ত। সেই ডোনারদের সাথে আজকের সংস্কার কাজের টাকার পরিমাণ উল্লেখ পূর্বক সেই তালিকার একটি ফলক, এবং তার সাথে আপনার নামটি সংযুক্ত করা। তবেই এই শহরের চলমান গতির সাথে আপনার নামটি চলমান থাকবার প্রয়াস পেতো। যারা বক্তৃতায় আপনার সন্তুষ্টি প্রাপ্তির প্রত্যাশায় বলেছে ‘মাননীয় মেয়র একদিন এই দেশ থাকবে না, এই পৃথিবী থাকবে না, কিন্তু আপনার এই কাজের সাথে আপনি থাকবেন অনন্তকাল!’ যেহেতু হলের বাইরে দাঁড়িয়ে এই বক্তব্য শুনেছি তাই বক্তার নাম তার অস্তিত্ব অবস্থান ভালো বুঝতে পারিনি। তবে এইটুকু পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি। ঐদিন এই অশ্বিনী কুমার মঞ্চে এমন মতলববাজ অন্তর্সারশূন্য কথা আর কেউ বলেননি। অন্তত তাদের কারো কথা বলার ধরনে তেমনটা মনে হয়নি।
জানি প্রশংসা কিংবা তৈল ব্যবহারে আমরা খুশি হই। কিন্তু তারতো একটা পরিমান জ্ঞান থাকা চাই। যে তেলে দেশ ভেসে যাবে পৃথিবীই থাকবে না। সেই দুষ্ট তেল ধারন করে মাননীয় মেয়র আপনি কি মনে করেন অবিস্মরণীয় হবেন? এমন প্রশংসার পাত্র ত্যাগ করুন। নয়তো আমাদের এই দুর্বুদ্ধির অযোগ্যতা আপনাকেও পেয়ে বসতে পারে। আশাহত হতে পারে ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা। বিলক্ষণ জানি এমন নিষ্ঠুর সত্যেরও কেউ সাথী নেই। অতএব সত্য তুমি সাবধান হও!
সর্বত্র সাবধানতার আজ বড় প্রয়োজন। যেমন মেয়রের নির্দেশে এবং সমন্বয় পরিষদের আয়োজন আর সঞ্চালনায়। এই নান্দনিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরুর প্রারম্ভে সঞ্চালকের ঘোষণা অনুযায়ী আমরা যখন আগাচ্ছিলাম মাননীয় মেয়রকে ফুলাভিনন্দন জানাতে। ঠিক সেই মুহূর্তে হলে প্রবেশ করলেন মান্যবর পুলিশের ডিাইজি। সমন্বয় পরিষদভুক্ত সাঁইত্রিশটি সংগঠন তখন ফুল হাতে মঞ্চের প্রবেশ পথে। একটু জটলা, একটু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি অথচ প্রাসঙ্গিক ভীড়। বিষয়টি বুঝতে চাইলেন না পুলিশ কর্তার সাথে আগত পুলিশ কর্মীরা। মুহূর্তেই অসুন্দরের সঞ্চালন ঘটালেন তারা। আমরা বিস্মিত হলাম তাদের আচরণে। হলে প্রবেশ দুয়ারের সিঁড়ির ঠিক মুখেই ডান পাশে দাঁড়ানো সাংস্কৃতিক কিংবা সংবাদ কর্মীদের ভিতর থেকে কেউ একজন বললেন ‘আরে ভাই আমরাতো সরতে চেষ্টা করছি সেতো আমাদের অতিথি তাকে জায়গা করে দেওয়াতো আমাদের দায়িত্ব। এভাবে ধমকালে আমরা কোথায় যাবো? এ কথা শুনবার পর পুলিশ কর্মীর রূপ যেন আরো অপরূপ হলো। এবার তিনি বললেন ‘ধমকাবেনা তো কি করবে?’ ইত্যাদি। বুঝতে বাধ্য হলাম যতোই কাছে যাই, পাশে ডাকি, এ পরিবর্তনযোগ্য নয়। মনে হলো দূরত্বের এই রূপ মূলত পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশ আর স্বৈরাচার সময়কেই প্রতিনিধিত্ব করছে এখনো! কেবল কেউ একজন সুরের সঙ্গীতের নাটকের কিংবা কবিতার লোক সেজে বসলেই চলবে? না চলবে না। চলে না, চালানো যায় না। হোঁচট লাগে। একে মনে নিয়ে, মেনে নিতে হবে এরাই এখন সময়ের সুবর্ণ গোলক! অথচ মান্যবর পুলিশ কর্তা মঞ্চে উঠে তার বক্তব্যে বললেন ‘আমি অবিভূত আমার তো এ আসরে গাইতে ইচ্ছা করছে।’ একবার মনে হয়েছিল প্রতিবাদের মতো করে কিঞ্চিৎ বলি সবার সাথে মিলে। পরে এক মত হলাম অন্যদের সাথে। বুঝলাম এখন কিছু বললে মঞ্চে অর্থটা ভিন্ন অর্থে উপস্থাপিত হবে। ঘরের আর বাইরের অসভ্যদের অসত্যে সহযোগিতায় সত্য হারিয়ে যাবে। তাই চুপ থাকতে বাধ্য ছিলাম। না এমন সত্যেরও কেউ সাথী নেই। নিশ্চয়ই এমন সত্য বিমূখতার পরাজয় আমাদের, সত্যের নয়। নিশ্চয়ই এ ব্যর্থতাগুলি নিতান্তই আমাদের, সত্যের নয়। বারবার আমাদের শঠতা আর লোভের কাছেই হয় সত্যের পরাজয়।
জয় শতবর্ষী অশ্বিনী কুমার হল সংস্কার কর্মযোজ্ঞের। জয় উদ্বোধনী সুব্যবস্থাপনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের। জয় উদ্বোধনী এ অয়োজনে মেয়রের ডাকে সাড়া দিয়ে শিক্ষা ও প্রশাসনের সতস্ফূর্ত উপস্থিতির। জয় হোক ব.বির ভিসির এবং বিভাগীয় কমিশনারের মুখে উচ্চারীত অমিত কথাগুলির। যে কথাগুলি সত্যকে জয়ী হতে, দৃপ্ত হতে, দৃঢ় হতে পথ দেখাবে। আমি এও জানি আজ এই স্বচ্ছ উচ্চারণের কেউ সাথী নেই। তাই মনের স্ব-বিস্মিত উপলব্ধিগুলি একটু থিঁথে হয়ে যেন প্রায়শই গাইছে এই গান ‘নেই দু:খের কেউ সাথী হায়।’ বুঝি না কেন বলতে চাই, কেন বলতে হয় ‘বর্গীরা আর দেয় না হানা নেইকো জমিদার। তবু কেন এ দেশ জুড়ে নিত্য হাহাকার? জেনেছ দেশতো স্বাধীন আছে ওরা বেশ তোমার মান্যবর পুলিশ, প্রশাসন আর তোমারই মহেশ।’
তবু যেন হতাশ না হই, সবাই মিলে সাংস্কৃতিক কর্মযোগ্যের জোয়াল কাঁধে টেনে চলতে হবে স্বাথের্র উর্ধ্বে উঠে। সমস্যার ‘মিটশেফটা খোলা রেখে বিড়ালকে উপদেশ দিয়ে কোন লাভ নেই। ফুটো চৌবাচ্চায় জল থাকবার কথা নয়, ওটাই জলের ধর্ম। শুধু কথার ফুলজুড়িতে চিড়ে ভিজবে না তার জন্য প্রয়োজনীয় পানীয় জলের ব্যবস্থাটা অত্যন্ত জরুরী।’
লেখক: আজমলহোসেন লাবু, বাচিক শিল্পী ও বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য।