পদস্থ কর্মকর্তাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটুক

পদস্থ কর্মকর্তাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটুক

১৭৪২ সালের কথা। তখন ভারত উপমহাদেশে বর্গিদের আক্রমণে অতিষ্ঠ ছিল সাধারণ মানুষ। বর্গি মানে মারাঠা দস্যু। মারাঠা এই দস্যুরা অবর্ণনীয় অত্যাচার-নির্যাতন চালাত। তারা নির্বিচারে সমগ্র বাংলা জুড়ে লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। ওই সময় মারাঠা লুণ্ঠনের ভয়ে বণিক এবং তাঁতিরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে। বর্গি বা মারাঠাদের আক্রমণে খাদ্যশস্য দুর্লভ হয়ে পড়ে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সব ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়। বর্গিদের অত্যাচার ও লুটপাটের কারণে ঠিক মতো খাজনা পারতো না। মারাঠা বা বর্গির উৎপাত আজ আর নেই। তবে তাদের ভয়ের জুজু এখনও আছে।

‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গি এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেবো কিসে।
ধান ফুরালো, পান ফুরালো
খাজনার উপায় কি
আর কটা দিন সবুর করো
রসুন বুনেছি।’

প্রায় তিন’শ বছর আগের অত্যাচার নির্যাতনের কথা আজো আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। এরপর বৃটিশের ২০০ বছরের গোলামী। ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ। ১৯৪৮ সালের ভাষার বিরুদ্ধে জিন্নার ঘোষণা উর্দু প্রত্যাখান করে বাঙালির মাতৃভাষার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পরা। ৫২ দিয়েছে মায়ের মুখের বুলি। ৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা, ৭৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিটি পর্বে বাঙালি জাতির এগিয়ে চলার ইতিহাস। ৯ মাসের শসস্ত্র সংগ্রাম, ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখের বেশি মা-বোনের রক্তাক্ত আঁচল আমাদের মুক্তিপতাকা। স্বাধীন স্বার্বভৌম লাল-সবুজের জমিনের অধিকারী আমরা। মুক্তিযুদ্ধের ৫১ বছর পার করে চলেছি। বিশাল এই সময়ে আমরা জ্ঞান, বিজ্ঞানে অনেক উন্নত হয়েছি। উন্নয়নশীল দেশের সারি থেকে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে জোরকদমে এগিয়ে চলেছি। কিন্তু স্বাধীন দেশের কর্মকর্তাদের আচরণ দেখে মনে হয় আমরা নিজভূমে পরবাসী হয়ে আছি। বড় কর্তারা সাধারণ মানুষদের অনেকটা সেই বৃটিশ প্রজাদের মতোই মনে করেন।

এক সাগর রক্তের বিনিময় বাংলাদেশ স্বধীন হয়েছে। আমাদের সামনে যাবার পথ সুগম হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে আমরা আজো পরাধীন থাকতাম। পাকিস্তানীদের চাপিয়ে দেওয়া বোঝা বহন করে চলতে হতো। দেশ স্বাধীন না হলে শিক্ষা, সংস্কৃতি, উন্নয়ন, অর্থনীতি, কোন কিছুই আমাদের থাকতো না। আজ যারা সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব, আইজিপি, অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার কিংবা পদস্থ কর্মকর্তা আছেন তাদের পাকিস্তানী তাবেদারী করা ছাড়া আর কোন পথ থাকতো কি না সন্দেহ। অথবা জোর গলায় যারা বলেন, বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টরেট কিংবা জেলা প্রশাসক তারাই বা কি করতেন। হয়তো জুটতো পাকিদের কোন অফিসের আর্দালী, কেরানীর চাকুরী। আমরা বৃটিশ-পাকিস্তানী তাড়াতে সক্ষম হলেও বৃটিশ নীতি, পাকিস্তানী প্রেতাত্মা তাড়াতে পারিনি। তাই আজো আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তাদের সেই ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ হয়েই থাকতে হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের পদস্থ কর্মকর্তাদের আচরণে সেটাই বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে। ব্যতিক্রমও রয়েছে। তবে, তার সংখ্যা খুবই কম।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ক্লাইভ লয়েডের ধারণা নিয়েই কর্মসম্পাদন করে থাকেন। এই ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা একধাপ এগিয়ে। যদিও তারা মুখে বলেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। বাস্তবে তাদের আচার আচরণ, সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের ব্যবহার বলে দেয় তারা বৃটিশ প্রশাসন, বৃটিশ পুলিশ। একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘দারোগার চেয়ে দারোগার নায়ের মাঝির চোট বেশি।’ এই প্রবাদ একসময় পুরোটা সত্যি ছিল। আজো আংশিক সত্য। বর্তমানে দরোগার নায়ের মাঝি আর কর্তাদের আচরণের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন।

ডিসেম্বর মাসকে আমরা বলি বিজয়ের মাস। কেউ কেউ বলেন মুক্তিযুদ্ধের মহান অর্জনের মাস। এই ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ বাঙালি জাতি বিজয় অর্জন করে। ২০২২ সালের বিজয় দিবসের মাত্র ২দিন পর ১৮ ডিসেম্বর বরিশালে আর একটি নতুন অধ্যায় রচনা হয়। ১০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বরিশাল অশি^নী কুমার হল সংস্কার শেষে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। কালের সাক্ষি এই হলটির নামও ১৯৭১ সালে পাকিদের দোসররা পরিবর্তন করে আইউব খান হল নামকরণ করেছিল। সেই হলটির নতুন রূপ দিয়েছেন বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদ আয়োজন করে নান্দনিক অনুষ্ঠানের। সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়, বরিশালে কর্মরত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ সাংস্কৃতিককর্মীদেরও। 

সন্ধ্যা ৬টায় আনুষ্ঠানিকভাবে অশি^নী কুমার হলের সম্মুখে নব রূপায়িত হলের ফলক উন্মোচন করেন মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ। এরপর হলে আয়োজন করা হয় আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। অশি^নী কুমার হলটি আগের অবয়াব ঠিক রেখে নান্দনিকরূপে ফিরে পেয়ে সাংস্কৃতিক কর্মী-সংগঠকরা ছিল উজ্জীবীত। এমন একটা উদ্যোগের জন্য তারা মেয়রকে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে হাজির হন অনুষ্ঠানে। সবাই যার যার মতো করে ফুল নিয়ে আসেন। মঞ্চ থেকে ঘোষণা দেয়া হয় পর্যাক্রমে মেয়র মহোদয়কে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জাানাবেন সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মী-সংগঠকরা ফুল নিয়ে মঞ্চের দিকে যেতে শুরু করে। লোকসমাগম বেশি হওয়ায় ছন্দ ঠিক রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। তারপরও সবাই ফুল হাতে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে ছিল।

এমন সময় দীর্ঘদেহী এক পুলিশ সদস্যর হাঁকডাক স্যার আসছেন, স্যার আসছেন, সরেন, সরেন। ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা শিল্পীকর্মীদের অনেকটা ধাক্কিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিলেন ওই পুলিশ সদস্য। পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলেন স্যার কি এই দেশের না অন্য দেশের। তাতে অসন্তষ্ট হলেন ওই পুলিশ সদস্য। রেগে গেলেন। বিষয়টি ডিআইজি মহোদয় দেখেছেন ও শুনেছেন। কিন্তু কোন প্রতিকার করেননি। শিল্পীকর্মীদের সরিয়ে দিয়ে তিনি মঞ্চে উঠে গেলেন। এই দৃশ্য দেখার পর বেশ কয়েকজন আর মঞ্চে ফুল দিতে না গিয়ে মেয়রকে দূর থেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে গেছেন।

যাবার সময় বলে গেলেন, পাকিস্তানীরা তো ছিল ভীনদেশী, কিন্তু স্বাধীন দেশে এমন আচরণ কেন?

মজার ব্যাপার হলো, মঞ্চে গিয়ে তিনি যে বক্তব্যটি দিলেন, তাতে মনে হলো তার মতো সংস্কৃতিবান আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া কঠিন। তিনি ভালো ভালো কথা বললেন, গান শোনাবেন, সংস্কৃতিবান এমন কর্মকর্তার বক্তব্য শুনে আমরা সবাই গদোগদোও হলাম। হাততালিতে অভিনন্দিত করলাম তাকে। কিন্তু একটু আগে তিনি যা করলেন আর মঞ্চে যা বললেন, তার মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া গেল না। কেন এমন হয়। এমন কি হওয়ার কথা ছিল। ছিল না। তারপরও হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব দেখার কেউ নেই। যারা দেখবেন, তারা তো তাদের ওপর নির্ভর করে নির্ভার হয়ে আছেন।

এই কর্মকর্তারা মুখে বলেন, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তারা জনগণের সেবক। আর অন্তরে পোষণ করেন তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা এবং জনগণের শোষক। রাজনৈতিক নেতাদের মতোই এরা পান দয়িত্ব, আর দেখান ক্ষমতা। তাদের ক্ষমতার দাপটে সাধারণ মানুষ নিষ্পেষিত। এদের স্যার না বললে নাখোশ হন। সাধারণ মানুষের অর্থে লালিত কর্মকর্তারা একবারও ভাবেন না, যা তারা করছেন সেটা কতটা যৌক্তিক।

এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা খুবই দরকার বলে মনে হচ্ছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালে। সেই সময় কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা পাকিস্তানী প্রেতাত্মা ছিল। স্বাধীন হওয়ার পর যতোগুলো নিয়োগ হয়েছে তার সবগুলোই বাংলাদেশ সরকারের কর্মকমিশনের মাধ্যমে। কর্মকমিশন থেকে নিয়োগ পাওয়া এমনসব সচিব, আইজিপি, বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার, ডিসিরা ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পরও দেশের কোন না কোন জেলায়, উপজেলায়, বিভাগ কিংবা রাজধানীতে চাকুরী করেছেন। কোন দিন কাউকে গান, কবিতা, নাটকের সঙ্গে ছিলেন, বলতে শুনিনি। সেটাও যদি বাদ দেই ১৯৯০ সালের গণতন্ত্র রক্ষা আন্দোলনের সময়ও তারা চাকুরী করেছেন। কোনদিন কি শুনেছেন কোন ডিসি, এসপি, ডিআইজি, বিভাগীয় কমিশনার গান গাইছেন, আবৃত্তি করেছেন, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? গত ১৫ বছরে সব চিত্র পাল্টেছে। এখন শোনা যাচ্ছে ওমুক ডিসি ছাত্রলীগ করতেন, অমুক বিভাগীয় কমিশনার কবিতা লেখেন, গানের সুর করেন, নিজে গান পরিবেশন করেন। অমুক ডিআইজি মঞ্চে গান গেয়ে দর্শক মাতান। এরা এতোদিন কোথায় ছিলেন। না কি তারা তোতা পাখির মতো শিখানো বুলি বলে চলেন। না কি লোক দেখানো বুলি আওরান, বোঝা মুশকিল। মানে যুগে যুগে আবদুলের মতো।

আবদুল বলায় একটি গল্প মনে পড়ে গেল। গল্প নয়, সত্যি। যারা ব্রজমোহন কলেজের রসায়ন বিভাগে পড়েছেন তারা এর সত্যতা জানেন। আবদুল ছিল রসায়ন বিভাগের বেয়ারা। কিন্তু দীর্ঘদিন রসায়ন পরীক্ষাগারে কাজ করতে করতে সব লবনের নাম তার ঠোটস্থ হয়ে গিয়েছিল। লবনের নমুনা জিবে দিয়েই তিনি বলে দিতে পারতেন এটা কোন লবন। সেই জন্য তাকে সবাই ‘আবদুল টেস্ট’ বলতেন। যতোদিন আবদুল বেঁচে ছিলেন ততোদিন রসায়নের লবনের পরীক্ষা নিয়ে ছাত্রদের দুশ্চিন্তা ছিল না। এমনও হয়েছে পরীক্ষা নিতে আসা শিক্ষকরা আবদুলকে আটকে রেখেছেন। কিন্তু কোন এক ফাঁকে আবদুল এসে ছাত্রদের সহযোগী হয়েছেন। আবদুলের কাছে কোন সরকার ছিল না। সে সব সরকারের সময়ই ছাত্রদের সঙ্গে ছিলেন।
আজকে যারা পদস্থ কর্মকর্তা তারা কিন্তু আবদুল হতে পারেননি। তেমনটি হতে পারলে আমাদের শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি আরও গতি পেত। তারা যখন যে সরকার ক্ষমতায় ছিল, তখন তাদের মতো করে চলেছেন। কখনো কখনো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধের সরকারের সঙ্গেও কাজ করেছেন। এমন নজির পাওয়া কঠিন হবে, যারা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকা মন্ত্রী-এমপিদের তাবেদারী করেননি।  তাদের মর্জি অনুযায়ী চলেননি। আবার এখন তারাই মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র ধ্বজাধারী হয়ে সরকারের উন্নয়ন অগ্রগতির কারিগর বনে হচ্ছেন।

কর্মকর্তাদের অবশ্যই মর্যাদা আছে। সাধারণ মানুষ তাদের সম্মান ও মর্যাদা দেন। তাদের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি, বাড়ি বরাদ্দ হয় সাধারণ মানুষের রক্ত-ঘামে। কিন্তু তারা কি একবারও ভাবেন যে কোন অনুষ্ঠানে তাদের চেয়েও মর্যাদাবান মানুষ থাকতে পারে। সংস্কৃতির কথা আর কি বলব। এসব কর্মকর্তারা ভাবেন সংস্কৃতি করেন সব ভ্যাগাব-রা। যাদের কোন চাল চুলা নেই তারাই, কবিতা, গান, নাটক করেন। তাদের আবার এতো মর্যাদা দেয়ার প্রয়োজন কি। তাই সংস্কৃতি আজও অবহেলিতই রয়ে গেছে। এমনসব চিত্র দেখে দেখে মহারাজার অনুপ্রবেশ নাটকের একটা সংলাপ মনে পড়ে গেল, ‘রাজা আসেন রাজ যান, আমরা গাই তার জয়গান।’ এই ধারার পরিবর্তন হওয়া অত্যন্ত জরুরী।

সাইফুর রহমান মিরণ

সম্পাদক 

দৈনিক ভোরের আলো