পরীক্ষার ফি নেই ময়নার। বড় ভাই রাজ্জাকেরও অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা সামনে। পটুয়াখালীর বাউফলের ধানদী গ্রামের অসুস্থ নানা আ. মজিদ (লেদু বিশ্বাস) আর নানী মাজেদা বেগমের কাছে আশ্রয় মিললেও ঠিকমতো দু’বেলা খাবার জোটে না ময়না-রাজ্জাকের। স্কুল-ড্রেস কিংবা ভালোমন্দ টিফিন কী জিনিস তা জানে না ওরা। খাতা-কলম কেনা আর স্কুলে পরীক্ষার ফি পরিশোধের চিন্তা তাড়া করে বেড়ায় ওদের। তাই সকাল-বিকাল মাঠে মাঠে মুগডাল কুড়াতে যায় ময়না ও রাজ্জাক। বেশি করে ডাল সংগ্রহ করতে পাড়লে ওই ডাল বিক্রি করে পরীক্ষার ফি দিতে পারবে।
ময়নার বয়স নয় বছর। ভাই রাজ্জাক তিন বছরের বড়। ময়নার বয়স যখন দেড় বছর তখন তাদের মা মারা যান। বাবা ইসহাক আকন বছরখানেক আগে মারা যান। ম্ াফজিলাতুন নেছা দ্বিতীয় বিয়ে করে পাশের গ্রামে স্বামীর স ঙ্গে থাকেন। দিনমজুর মামার সামান্য আয়ের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে ময়না ও রাজ্জাকের। দীর্ঘদিন থেকে অসুস্থ নানা মজিদের চিকিৎসাসহ পরিবারের সবার দুই বেলা খাবার ঠিকমতো জোটে না। এখন বিভিন্ন ধরণের ডাল ওঠার মৌসুম। তাই এ সময় কৃষকের ক্ষেতে ক্ষেতে মুগডাল কুড়িয়ে বেড়ায় ময়না-রাজ্জাক।
ময়না জানায়, দক্ষিণ ধানদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী সে। ভাই রাজ্জাক ধানদী আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। আগামী শনিবার (২৮ এপ্রিল) প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হবে তার। এক সের কুড়ানো ডাল বিক্রির ৬০ টাকা থেকে পরীক্ষার ফি পরিশোধ করা গেলেও সামনে ভাই রাজ্জাকের অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষা। স্কুলের বেতনসহ পরীক্ষার ফি দিতে হবে তার। এ কারণে ভাই রাজ্জাকও যোগদেন মুগডাল কুড়ানোর কাজে।
আমন ধান ওঠানোর মৌসুমের মতো এ সময়ও নানা-নানীর পরিবারের আয়ে সহযোগিতা করে তারা দুই ভাই বোন। বেশি করে ডাল তুলতে পারলে চাষির কাছ থেকে পাওয়া অংশে মিলবে তাদের পরীক্ষার ফিসহ খাতা-কলম ও জামা-কাপড় কেনার টাকা। জোটবে পরিবারের দু’বেলা ভালোমন্দ খাবার। দিনমজুর মামার পক্ষে পৃথক সংসারে স্ত্রী-ছেলেমেয়ের ভরনপোষণ করার পরে অসুস্থ বাবা-মায়ের চিকিৎসাসহ খাবার জোটাতেই হিমশিম খেতে হয়। উপরন্তু তারা দুই ভাই-বোন যেন বোঝা ওই পরিবারে। স্কুলের উপবৃত্তির সামান্য টাকায় খাতা-কলম কেনা গেলেও খাওয়া খরচ চলে না। রোজ এক-দেড় কেজির মতো ডাল পাওয়া যায়। দু’মুঠো খাবার জোটানো আর লেখা-পড়ার খরচ চালিয়ে যেতে এ ধরণে র কাজের বিকল্প নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেবল ময়না-রাজ্জাকই নয়, বাউফলের কয়েক শত হতদরিদ্র, জেলে, ছিন্নমূল, মানতা সম্প্রদায় ও চরের ভূমিহীন পরিবারের শিশুদের পুরো বছরের অন্ন-বস্ত্র, চিকিৎসা কিংবা শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা নেই। ময়না-রাজ্জাকের মতো বাকলা তাঁতেরকাঠি প্রাইমারি স্কুলের ৫ম শ্রেণির ছাত্রী ফারজানা, আলপনা, লাকি, ৪র্থ শ্রেণির মীম, ৫ম শ্রেণির হাসান, ৩য় শ্রেণির বাবু, তাঁতেরকাঠি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির তমা, ৯ম শ্রেণির তানিয়া, রবিউল, ১০ম শ্রেণির ময়না, ধানদী ফাজিল মাদরাসার ৯ম শ্রেণির মানিক, ৮ম শ্রেণির রবিউলসহ কয়েক শত শিশুর এখন বিভিন্ন চর এলাকাসহ ক্ষেতেই সকাল-বিকালের ঠিকানা। এসব হতদরিদ্র শিশুরা সারা বছরের ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা পেতে পরিবারের আয়ের সহযোগী হয়েছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে সরকারি-বেসরকারি উদ্দ্যোগে শিশুদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার নাগাল পায় না এসব শিশুরা।
ময়নার চাচাতো বোন রূপা আক্তার জানান, শৈশব থেকে এই দুই ভাই-বোন পেয়েছে সংসারের অভাব-অনটন। ভালো পোশাক পড়ে স্কুলে যেতে না পারার দুঃখবোধ আছে তাদের। বাবার মৃত্যুর পরে মা ফজিলাতুন নেছা ভরসা হলেও তা টেকেনি বেশিদিন। মায়ের অন্যত্র বিয়ে হলে ছেলে-মেয়ে দুটো কান্নায় ভেঙে পড়ে।
স্থানীয় নিমদী সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মো. মাসুম বিল¬াহ বলেন, ‘মা-বাবার আদর-স্নেহ বঞ্চিত সহায়-সম্বলহীন শিশু ময়না-রাজ্জাক পড়াশুনায় মনোযোগী। এদের প্রতি সবার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত।’
উপজেলা পরিসংখ্যান অফিস সূত্রে জানা গেছে, বাউফলে থেকে ১৫ বছর বয়সের ১০ হাজারেরও বেশি শিশু রয়েছে। এসব শিশুদের মধ্যে ৫০ ভাগ সংসার চালাতে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন ধরণের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। এসব শিশুরা দারিদ্র্যতার কারণে অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদন, নিরাপত্তার মতো মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে।
বিভিন্ন সময়ে চরের মানুষের জীবন-মান উন্নয়নে কাজ করা শে¬াভ বাংলাদেশ নামে স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বৈষম্যের শিকার কিংবা কৃষিভিত্তিক কাজের সঙ্গে জড়িত পটুয়াখালীর বাউফলের নিম্নবিত্ত ও চরাঞ্চলের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো সংস্থা কাজ করছে না। গণশিক্ষার অধীনে শ্রাবণ নামে এক উন্নয়ন সংস্থা এ সম্পর্কিত প্রকল্প হাতে নিলেও কবে নাগাদ তার কার্যক্রম চালু হবে তা ঠিক নেই। এমন বাস্তবতায় শ্রমজীবী ও কৃষিভিত্তিক কাজের সঙ্গে জড়িত শিশুদের শিক্ষায় যতœবান না হলে এসব জনগোষ্ঠী আরও পিছিয়ে পড়বে।