পারাপারের থাকলে ত্বরা সঙ্গে নিয়ো গাড়ি ভাড়া

মাত্র জানাজা শেষ হয়েছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি হেমায়েত উদ্দিন খেলার মাঠে। মুন্না চলে গেলো। এক সময়ের অত্যন্ত কাছের মানুষ ভাই, বন্ধু, আত্মীয় এই মুন্না। একটা সময়ে খুব কাছাকাছি ছিলাম। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে দেখা হতোই। মাঝখানে অনেক দিনের নীরবতাকে ভেঙ্গে আজ আবার সরব হলাম সেই মুন্নার খবরেই। খবরটা তার মৃত্যুর। জানাজায় দাঁড়িয়ে শুনছিলাম কাছের মানুষদের কথা, তাদের কান্নার শব্দে ক্রমশঃ হিম হয়ে যাচ্ছিলো মন, শরীর। মনে হচ্ছিলো যেন অতি বাস্তব কিছু কথা বেজে চলেছে সবার মনে। ‘অনেক কথা যাও যে বলে, কোন কথা না বলে।’ বিদায় বেলার শেষ পথের পথে বুঝি এই সুরই বাজে সবার প্রাণে?
ওকে নিয়ে যখন সবাই পা বাড়ালো, ঠিক সেই মুহূর্তেই এক অনুভূতি অনুভূত হলো। দেখলাম এক অদ্ভুত মিল, মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমরা তিনজন। একজন আমার অনুজ একজন অগ্রজ। আমরা তিনজনই কাকতলীয়ভাবে উন্মুক্ত হৃদয়ের মানুষ! মুন্নারও তাই ছিলো। ওর-ও ওপেন হার্ট হয়ে ছিলো। আজ ওর সময় নির্ধার্রিত ছিলো তাই চলে গেলো। কাল যে ছিলো বিলকুল, আজ সে নাই। কানে ভেসে আসছে নানান প্রশ্ন। কি কষ্ট ছিলো, কখন, কেন হলো? সবাই জানি এগুলি সবই অবান্তর প্রশ্ন। এর সহজ উত্তর হলো, ধর্ম বলবে ডাক এসেছে তাই চলে গেলো। বিজ্ঞান বলবে, সঞ্চালন প্রক্রিয়া ব্যহত অর্থাৎ ফুয়েল শেষ, ইঞ্জিন বন্ধ। এ দুটোর ভাষা একটু ভিন্ন হলেও কর্মগুণ অভিন্ন। তাই কান্না আর বেদনার মাঝেও কোন কোন মৃত্যু আমাদের কঠিন কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। মানুষ জানতে চায়, তারা জিজ্ঞেস করে। এই বাচ্চা, এই পরিবার কে কেমন করে বাঁচাবে? কেমন করে কাটবে সময়, কেমন করে চলবে তারা?
তারপর সময়-পথ, এক সময় এ সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। তখন আর সেই কঠিন পথ অতিক্রমের গল্প কেউ জানতে চায় না। তবে আছে কিছু ব্যতিক্রম, কিংবা যা স¦াভাবিক নয় এমন কিছু ঘটনা। যা সমাজকে ভাবায় চিন্তিত রাখে বেশ কিছুটা সময় ধরে। তখন মানুষ ঘর প্রতিবেশী পরিবেশ নিজেরাই নিজেদের প্রশ্ন করে জানতে চায় ব্যর্থতাটা কোথায়? তার জন্য কাহিনী নির্মাতাকে দেশ বরেণ্য হতেই হবে বিষয়টা ঠিক তেমন নয়। এইতো মাত্র কিছুদিন আগের ঘটনা। ঘুম থেকে উঠেই হঠাৎ খবর পেলাম। আমাদের সাংস্কৃতিক সাংগঠনিক সাথী, বন্ধু, বোন, সহকর্মী ‘নিপা’ নেই! জানি সবাই, মৃত্যু অমোঘ। সে আসবেই। তবু তাকেই আসতে বাধ্য করলো নিপা।
কেন কিভাবে কোথায়? এমন অনেক প্রশ্ন, উত্তর হয়ে ফিরে এলো। জানলাম নিপা আত্মহত্যা করেছে! ভালো আবৃত্তি করতো, নাটকের সুঅভিনেত্রী ছিল। ভালো সংগঠক ছিল, বাচ্চাদের আবৃত্তির শিক্ষক হয়েও উঠেছিলো। নিজস্ব সংগঠনের বাইরেও নিজের যোগ্যতাকে সমমাত্রায় সম্পৃক্ত করে ফেলেছিল সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যান্যদের সাথেও। শুনেছি করোনাকালীন সময়ে লাইভে আবৃত্তি অনুষ্ঠান নিজে পরিচালনা করতেন এবং অনবরত সংযুক্ত থাকতেন অন্যেদের অনুষ্ঠানেও। ‘হয়তো’ সেখান থেকেই পরিচিতির সম্প্রসারিত কোন পথের সন্ধান পেয়েছিল সে। সেই সম্প্রসারিত পথেরই কোন বাঁকে স্থানীয় বন্ধু বান্ধব সাথীদের অগোচরে। ঠিক জনি না, ‘হয়তো’ কোন অবিশ্বাস্য হাতকে সে বিশ্বাস করে ফেলেছিল। আবারও বলছি ‘হয়তো’ সেই হাত যতটা আস্থার, যতটা নির্ভরতার, যতটা প্রশংসার, যতটা দর্শনধারী, যতটা বাস্তবতার, যতটা সঠিক থাকবার কথা ছিল কিংবা আশা ছিল ‘হয়তো’ তার ব্যাত্যয় ঘটেছে সেখানে।
সেটা কার তরফে আমরা জানি না। সেটা জানা সম্ভব হয়নি। তবু আবারও বলি দূরেরর পহাড় যত সবুজ, যত নির্মল মনে হয়, কাছে গেলে হয়তো সে সব সময় ঠিক তেমনটা নয়। হতে পারে সেই অভিব্যক্তি কোন এক জনের কিংবা ছিল উভয়ের? এর বাইরেও হতে পারে অন্য অনেক কিছু। আমরা যা একেবারেই জ্ঞাত নই। কখনো হয়তো কারো মুখে হঠাৎ শুনেছি ‘ওকে কালো বলাটা ওর ভালো লাগেনি বা লাগতো না। হয়তো সেই সত্য। আবার পূর্ণ রূপে সেটা নাও হতে পারে। কারণ ওর এই রঙতো জন্মের। তাছাড়া এমন কথা অতিক্রম করবার সামাজিক সাংস্কৃতিক, পারিবারিক, এবং একাডেমিক শিক্ষা তো নিপার ছিল। অন্তত থাকাটা খুবই জরুরী ছিল। সেটা হলো না। কক্ষচ্যুত হলো সে স¦াভাবিক পথের। তার নিয়তি তাকে নিয়ে গেলো সমাধানহীন এক অনন্ত পথে।
আমরা স্তম্ভিত হলাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলাম। কষ্ট, দুঃখ, চরম হতাশায়ও স্থির থাকতে বাধ্য হলাম। সকলে মিলে কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হলাম। ভোর থেকে ডিসির বাংলো, পরবর্তীতে অপেক্ষা মেডিকেল দুয়ারে। খবর পেয়ে একে একে এই শহর সংস্কৃতির ছোট বড় ওর বন্ধু সাথী সবাই এলো। যে যার মতো করে যেখানে যা করবার সব কিছু যতো দ্রুত করা সম্ভব করে দিলো। পরিবারের ইচ্ছা ছিলো পোস্টমর্টেম না করবার। পরিবারের পক্ষে সে চেষ্টা করেছিলো সংগঠনের অগ্রজরা। সবিনয়ে আইন সেটা মানলো না। পোস্টমর্টেম হলো। অতঃপর সকল কাজ শেষে ধর্মীয় বিধান মেনে আমরা সবাই যখন মেডিকেলের পূর্ব গেটে নিপার জানাজায় দাঁড়ালাম তখন সকালের সূর্য অনেকটা পথহেঁটে মধ্যআকাশ অতিক্রম করেছে।
এবার নিপার গন্তব্যে যাওয়ার পালা। যেখানে চির শান্তির নিদ্রাঘর বানিয়েছে ওর স্বজনেরা। এই বিদায়ের পথ ওর নানাবাড়ি গৌরনদীর দিকে। হঠাৎ মারিফ বাপ্পির কন্ঠ স্বশব্দে বলে উঠলো ‘একটা সেফটিপিন হবে কারো কাছে? সবাই ব্যস্ত হলো সেফটিপিন সন্ধানে। নূসরাত নামের মেয়েটা সেই মুহূর্তে তার অস্তিত্ব অবস্থানের কোন তোয়াক্কা না করে শাড়ীর কুচির ভাঁজের সেফটিপিনটা খুব দ্রুতই খুলে বাপ্পির হাতে দিলো। দেখলাম নিপার মাথার কাছে ব্যাগের চেইনের যে অংশটা কাজ করছিলো না সেফটিপিনটা সেখানে লাগিয়ে দিলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো। এই শেষ।
আর কোন কথা হবে না নিপার সাথে কোন দিন, কোন মাধ্যমে। সমসাময়িক মোহাবিষ্ট আধুনিক স্থূল সকল মাধ্যমের যোগাযোগের এখানেই সমাপ্তি। ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলো নিপার লাশবাহী গাড়ি। চলে গেলো নিপা। লাইক, কমেন্টস, শেয়ারের অর্থহীন সকল মোহ ছিন্ন করে। উপস্থিত সকলেই অশ্রুসিক্ত দাঁড়িয়ে রইলো নিপার চিরদিনের জন্য চলে যওয়া পথের পানে। আর কোন লাইভের সুখ্যাতি ওকে এলাইভ করতে পারবে না। এই সত্যটা জানলে, মানলে ওর বেঁচে থাকা হতো। এই পৃথিবীর অর্থহীন সুখ্যাতির কাছে নিজেকে এভাবে বোকার মতো সঁপে দিত না।
তারপরে বেশ কিছুটা সময় চলে গেল। চলে গেছে দিন, মাস। আবার সকলের স্বাভাবিক কাজে ফেরার তাগিদ। তবু চলছে কিছু কথা ভালো মন্দের। বলছে যে যার বুদ্ধির যোগ্যতায়। একটু পরিশুদ্ধ যারা মনে, বুদ্ধিতে। তাদের কথা আলোতে, আছে এমনও কিছু কথা অপ্রকাশ্যে, আড়ালে। অভিযোগ আছে আমাদের প্রতি দায়িত্ব এড়ানোর। সবকিছু যে ভালো বুঝতে পারছি তেমন নয়। তবু যে যা বলছে অনেকটা চুপ করেই শুনছি। ওর কষ্টের কথা শুনছি, সারল্যের কথা শুনছি। প্রশংসা এবং নিন্দা দুটোই শুনছি। দেশের বিভিন্ন স্থানের মানুষদের সাথে স্বাভাবিক স্বতস্ফূর্ত ছবি তোলার কথা শুনছি। নিজের ভালো মন্দ, কষ্ট আনন্দগুলির কথা, ঘর ছেড়ে অনেক দূরের কারো সাথে ভাগাভাগির কথা শুনছি। বলা চলে শুনতে এক ধরণের বাধ্য হচ্ছি।
হয়তো কারণ তার একটাই ওর মৃত্যুটা সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য কেউ অনুমোদন দেয় না। ধর্মতো নয়-ই। অথচ সে তাই-ই করলো। সমসাময়িক চলমান এই সময়টার যা রূপ। শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। যেন নিজের বাইরে এই পৃথিবীতে আর কোন কিছুরই কোন মূল্যমান বা অস্তিত্ব নেই। কেবল আমি, আমি আর আমি! আশাতেও আমি, হতাশায়ও আমি! আনন্দে আর চরম কষ্টেও আমি! যে কারণে ‘আমরা’ শব্দের সাথে জড়িতরা বড় অপ্রস্তুত আছি। তাই ওর এই চলে যাওয়ায় আমরা সবাই একত্র হয়ে যাকে বলে শোক প্রকাশ তাও করতে পারিনি! পাছে কেউ বলে বসে আপনারা এগুলি কি করছেন? এতেতো অন্যরা উৎসাহ পাবে। মানুষতো ইচ্ছা হলেই যা খুশি বলতে পারে।
এভাবে যারা বলে তারাই শুধু মানুষ আমরা কি মানুষ নই? তা হলে আমরা কেন বলবো না, বলতে পারবো না। আমাদের স্বজন, অত্যন্ত ছোট যার মৃত্যু আমাদের কাম্য ছিলো না। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি দারুণভাবে। বরিশাল নাটক, উদীচীর মতো সংগঠন একজন নিপা তৈরি করতে অনেক শ্রম ও সময় দিয়েছে। তবেইনা একজন নিপা তৈরি হয়েছে। বিগত দশ বছরে এমন সফল একজন অভিনয় ও আবৃত্তি শিল্পী, সংগঠক আমরা কে কোথায় কতজন তৈরি করতে পেরেছি? তার বিদায়ে আমরা আমাদের ভালো মন্দের অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটাতে পারবো না? তার জন্য কোন্ মানুষের অনুমতি লাগবে, কোন্ সে মানুষ কিসের অনুমতি?
শুনেছি নিপার মৃত্যুর প্ররোচনাকারী হিসাবে কোন একজনকে নরসিংন্দী থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তার স্বীকারোক্তি সত্য হলে এবং দায়িত্ব নিয়ে তা যদি সে আদালতে স্বীকার করে তবে তার বিচার হোক। যা শাস্তি হবার হোক। মিথ্যা হলে দ্রুতই তার মুক্তি মিলুক। আইন তার নিজস্ব পথে চলুক।
শুধু আমরা যেন বিশ্বাস রাখি, কোন এক নিদারুণ কষ্টই ওকে দারুন সাহসী করেছিলো মৃত্যুর পথে যেতে। যদিও এটা কোন সাহস নয়, স্রেফ বোকামি। মানুষকে মানুষ রাখতে না পারার অযোগ্যতা। তার পরেও আমরা যেন ওর আত্মার সেই কঠিন কষ্টের নাজাত চাই। মহান আল্লাহকে বলি, তুমিই মহান, তুমিই শ্রেষ্ঠ, তোমার ক্ষমার জন্যতো কোন মানুষের অনুমতির প্রয়োজন নেই। তুমি ওকে মাফ করো, শান্তি দান করো।
শুনেছি নিপার প্ররোচনাকারীর জামিনের জন্য শহরের একজন স্বনামখ্যাত আইনজীবী দায়িত্ব নিয়েছেন। নিতেই হবে এটা যে তার পেশা। তাহলে? পেশার আবার ফাদার মাদার কি? তার আবার সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি, নীতি নৈতিকতা কি? তাকে কি বলা সম্ভব, জানি এটা আপনার পেশা। এটা করেই আপনাদের খেতে হয়। তবু যখন আইনের সামনে দাঁড়িয়ে বলবেন বা বলতে বাধ্য হবেন। টাকা কিংবা পেশার প্রয়োজনে, নিপার বিরুদ্ধে ভালো মন্দ অনেক কথা। তখন কি মনে পড়বে ওই মেয়েটিকে আপনি চিনতেন? বহুবার ওর প্রশংসা করেছেন। ও ভালো অভিনয় করে, ভালো আবৃত্তি এবং উপস্থাপনা করে। মনে কি পড়বে ওই নিপা স্বাধীনতা দিবসে, বিজয় দিবসে, একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারের সাংস্কৃতিক আলোচনার মঞ্চে দাঁড়িয়ে ডাকছে আপনাকে। এবারে আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখবেনÑ ‘বিশিষ্ট আইনজীবি, সাবেক সাংসদ, অনন্য রাজনীতিবিদ, আমাদের কাছের পরিশুদ্ধ প্রিয় মানুষ জনাব ...।
ঠিক জনি না, আপনি আমি আমরা এখন কি ভাবছি? ভাবছি কি এমন কোন কথা, যা আমাদের সবার জীবনে সার্বক্ষণিক সমান সত্য? ‘পারাপারের থাকলে ত্বরা, সঙ্গে নিয়ো গাড়ি ভাড়া। জবাবদিহি করতে হবে ধরলে টিকিট কালেক্টর। আমি পাপী তিনি জামিনদার।’ অনন্ত পথের পথে নিপার আত্মাও কি এই কথাগুলিই বলছে না? মহান আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে ভালো রাখুক, সুস্থ রাখুক। নিপার আত্মার চির শান্তি দান করুক মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আল-আমীন।