বরিশাল রেখেই অশ্বিনী কুমারের নাম যুক্ত করা সম্ভব

বরিশাল রেখেই অশ্বিনী কুমারের নাম যুক্ত করা সম্ভব

গত কয়েকদিন ধরে বরিশাল উত্তাল। এরন কারণ একটি কলেজের নাম পরিবর্তন করা না করা নিয়ে। সেই কলেজটি হচ্ছে অশ্বিনী কুমার দত্তের বাস ভবনে থাকা সরকারি বরিশাল কলেজ। বাংলাদেশ সরকার কলেজটির নাম পরিবর্তন করে অশি^নী কুমারের নামে করার প্রস্তাবনা করেছে। ওই প্রস্তাবনার পর সরকারি বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন করে মহাত্মা অশ্বিনী কুমারের নামে নামকরণের সরকারি প্রস্তাবনার বিপক্ষে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে। কলেজের বর্তমান এবং সাবেক ছাত্রদের ব্যানারে যারা এই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন তারা বলার চেষ্টা করছেন অশ্বিনী কুমারের নামে কলেজের নাম হলে বরিশালের ঐতিহ্য নষ্ট হবে। বরিশাল হারিয়ে যাবে। আমাদের ধারনা এমন আশঙ্কা সঠিক নয়। মোটাদাগে যদি কলেজের নাম ‘সরকারি বরিশাল অশ্বিনী কুমার কলেজ’ করা হয় তাহলে বরিশালের ঐতিহ্য এবং বরিশাল হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে না। বরিশাল ঠিক রেখেই অশ্বিনী কুমারের নাম যুক্ত করার পক্ষে আহ্বান জানালে এই বিভ্রান্তি দূর হবে। তাই বরিশাল রেখেই অশি^নী কুমারের নাম যুক্ত করা সম্ভব।

কেউ কেউ বলছেন কলেজের নাম পরিবর্তন হলে সাবেক ছাত্রদের সনদের কি হবে? তাদের জন্য বলা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন হয়েছে। কোন শিক্ষার্থীর সনদ বাতিল হয়েছে এমন কোন নজির নেই। সুতরাং এই যুক্তি যারা দিচ্ছেন তারাও বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্যই দিচ্ছেন। সনদ দেয়ার কর্তৃপক্ষ হচ্ছে বোর্ড ও বিশ্ববদ্যালয়। তাই সনদ বাতিল হওয়ার কোন সুযোগ নেই। সরকারি বরিশাল অশ্বিনী কুমার কলেজ নামকরণ হলে কোনভাবেই সনদ বাতিল হবে না।

সবচেয়ে বড় শঙ্কা এবং ভয়ের কারণ হচ্ছে অশ্বিনী কুমারের নামের যারা বিরোধীতা করছেন তাদের মধ্যে একটা পক্ষ অশ্বিনী কুমারকে ধর্মীয় দিক থেকে বিচার করার চেষ্টা করছেন। মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চিন্তার বাংলাদেশে এটা এক অশনি সংকেত। যেহেতু অশ্বিনী কুমার হিন্দু, কেন তার নামে কলেজের নাম হবে। এখানে কোন মুসলমানের নাম হলে তাদের আপত্তি নেই। এমন মন্তব্য আমাদের জন্য উদ্বেগজনক।

যারা এমন খোড়া যুক্তি দিচ্ছেন, তাদের অনেকেই জেনে বুঝেই এই যুক্তি তুলে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। যাতে কেউ বিভ্রান্ত না হয় সেজন্য উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, মহাত্মা অশি^নী কুমার দত্ত অবিভক্ত ভারত বর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অন্যতম প্রবর্তক ছিলেন। তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি বরিশালের অবহেলিত মানুষের শিক্ষার জন্য দান করে গেছেন। বর্তমান ব্রজমোহন বিদ্যালয় এবং ব্রজমোহন কলেজ তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। ব্রজমোহন কলেজে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যন করছে। ব্রজমোহন বিদ্যালয় এবং কলেজ প্রতিষ্ঠার পর অশ্বিনী কুমার দত্ত একটি উইল করে গেছেন। তাতে লেখা আছে, ‘ব্রজমোহন বিদ্যালয় এবং ব্রজমোহন কলেজ থেকে আমার পরিবারের কোন সদস্য আর্থিকভাবে সুবিধা নিতে পারবে না।’ তাঁর ভাইয়ের ছেলে সরল দত্তর প্রচ- ইচ্ছা ছিল ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনা করার। কিন্তু ওই সিদ্ধান্তের কারণে অশি^নী কুমার দত্তের ভাইরে ছেলে সরল দত্ত অবিভক্ত ভারতে গণিতের সেরা ছাত্র হয়েও ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনা করতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর আগে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল পুনর্জন্ম হলে আপনি কোথায় জন্মাতে চান? তিনি বলেছিলেন বরিশালে। মায়ের গর্ভে জন্মানোর ইচ্ছা পোষন করলেও বাবা হিসেবে তিনি বাউফলের এক মুলমান ব্যক্তির নাম বলেছেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোনে দৃঢ়চেতা সাহসী মানুষ ছিলেন তিনি। আজন্ম ত্যাগি মানুষ অশ্বিনী কুমারকে নিয়ে যারা ধর্মীয় বিভ্রান্তি ছড়াতে চান, তারা একটু অশি^নীর জীবনকর্ম নিয়ে চর্চ করলে এই বিভ্রান্তি দূর হয়ে যাবে।

অশি^নী কুমার দত্তের বাড়িতে সরকরি বরিশাল কলেজ নিয়ে আরো একটি বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা চলছে। সেটা হচ্ছে অশ্বিনী কুমারের স্বজনরা তার বাস ভবন ও সম্পত্তি বিক্রি করে গেছেন। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট। পাকিস্তান সরকারের আমলে মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের বাসভবনটি সরকার রিকিউজিশন করে এবং তিনি সর্বদা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন বলে তার বাসভবনে ব্রজমোহন কলেজের কসমোপলিটান ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৬৩ সালে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা হওয়া বরিশাল নৈশ মহাবিদ্যালয়টি ১৯৬৬ সনে অশ্বিনী কুমার দত্তের বাস ভবনে স্থানান্তর করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নৈশ কলেজটিকে প্রথমে বরিশাল দিবা ও নৈশ কলেজে রূপান্তর করা হয়। পরে এটির নামাকরণ করা হয় ‘বরিশাল কলেজ’। কলেজটিকে ১৯৮৬ সনে জাতীয়করণ করা হলে কলেজটির নামাকরণ করা হয় ‘সরকারি বরিশাল কলেজ’। বসতবাড়ি পাকিস্তান সরকার একোয়ার করেছে। পরে ১৯৭০ সালে ১৯ আগস্ট বরিশাল নাইট কলেজের নামে ৪০ হাজার ২৯৫ টাকা ২৪ পয়সার বিনিয়ম হস্তান্তর করা হয়।

আমরা মনে করি মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের বাসভবনে থাকা সরকরি বরিশাল কলেজের সঙ্গে অশ্বিনী কুমারের নাম যুক্ত কর আমাদের দায়। সেই দায় থেকেই বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন শব্দটির ওপর গুরুত্ব না দিয়ে বরিশালকে ঠিক রেখেই অশ্বিনী কুমারের নাম যুক্ত করার আহ্বান জানই। এব্যাপারে সরকারের প্রস্তাবনার সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবীদের একজোট হওয়া দরকার।